পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
রোজকার মতন আজও সকালে ঠিক ন’টার সময় অফিসে লগ-ইন করেছে শান্তনু। বছর দুয়েক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স-এ বিই কমপ্লিট করেছে শান্তনু। থার্ড ইয়ারের সিক্সথ-সেমিস্টার চলাকালীন অন-ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে একটা মার্কিন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সফট্ওয়্যার অ্যানালিস্টের চাকরি পেয়েছিল সে। ওর ফার্স্ট-পোস্টিং কলকাতায়; সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে। সেক্টর ফাইভের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে সুবিশাল ওয়াটার ফ্রন্টের ধার ঘেঁষে ওদের অফিস।
বছর দুয়েক কাটতে না কাটতেই, একটা প্রোমোশন পেয়ে শান্তনু এখন ওদের ডিপার্টমেন্টের টিম লিড। এই প্রোমোশনটা পাওয়ার খবরে শান্তনুর মনটা সেদিন আনন্দে একেবারে ডগমগ করে উঠেছিল। বাড়ি ফেরার পথে মা-বাবা-বোন, দাদু-ঠাকুমা সকলের জন্য একগুচ্ছ গিফট কিনে বাড়ি ফিরেছিল সে। সেদিন বাড়ি ফিরে বাবাকে ওর এই আনন্দ-সংবাদটা জানাতেই, বাবা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘টিম-লিড হয়েছ এ তো খুব আনন্দের কথা! কিন্তু তোমার টিমে এখন মেম্বার ক’জন?’
বাবার প্রশ্ন শুনে বার-কয়েক ঢোক গিলে শান্তনু জবাব দিয়েছিল, ‘আটজন, আই মিন এই মুহূর্তে আটজন! পরে আরও বাড়তে পারে!’
আরও পড়ুন-পাশে বজরং-সাক্ষী-সহ অনেকেই, বিমানবন্দরে মানুষের ঢল
‘ভবিষ্যতে বাড়তে পারে মানে, ভবিষ্যতে কমতেও পারে! কেউ ফরেন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বিদেশ চলে গেল ; কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল, তাহলে ভবিষ্যতে তোমার টিমের সদস্য সংখ্যা কমতেও পারে!’ একথা বলার পরে সোফা থেকে উঠে এসে, শান্তনুর কাঁধে হাত রেখে বাবা জানিয়েছিলেন, ‘দ্যাখো শান্তনু! তুমি মনে কোরো না যে, তোমার এই সাফল্যে আমি খুশি হইনি। এটা তোমার চাকরি জীবনের প্রথম উত্থান; অবশ্যই খুশি হওয়ার মতো একটা সংবাদ। কিন্তু এই রাইজটাকে মেমোরেবল করে রাখবার জন্য তুমি যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছ তা আমাকে মোটেও খুশি করতে পারেনি। আটজন নয়, যেদিন আটশো জন টিম-মেম্বারের উপরে ছড়ি ঘোরাতে পারবে, সেদিন সেই স্তরে পৌঁছনোর পরে তুমি যদি এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় কর, তাহলে তা সাদরে মেনে নিতে কখনই দ্বিধা করব না আমি!’
এরপরে শান্তনুর হাত ধরে ওঁর স্টাডি রুমে ঢুকে, স্টাডি টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা জার্নাল বের করে, শান্তনুর হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা দু-হাজার তেরো সালে প্রকাশিত একটা জার্নাল; নাম— জার্নাল অব মার্কেটিং রিসার্চ। বিগহাম ইউনিভার্সিটির কিছু গবেষণাপত্র এতে প্রকাশিত হয়েছে। সময় পেলে পড়ার চেষ্টা কোরো। শুধু পড়লে হবে না; এই গবেষণালব্ধ তথ্যগুলোকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে, দেখবে মনের মধ্যে হঠাৎ করে জেগে ওঠা বাসনাগুলোকে কত অনায়াসে লাগাম পরাতে সক্ষম হতে পারবে!’
বাবার সেদিনের সেই পরামর্শ শান্তনু হৃদয়মঙ্গম করতে পারলেও, আজ সে কিছুতেই হৃদয়মঙ্গম করতে পারছে না, অনিমেষদা কোথায় গেল। অনিমেষদা, মানে অনিমেষ চ্যাটার্জি হচ্ছে একদিকে শান্তনুর কোম্পানির অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর, অন্যদিকে ওদের ইউনিভার্সিটির সিনিয়রও বটে! শান্তনু যে বছর কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকছে, তার দু-বছর আগে অনিমেষদা কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বিই কমপ্লিট করে বেরিয়ে যায়। তারপরে এমবিএ কমপ্লিট করে ওদের এই কোম্পানিতে জয়েন করে। মাঝে দু-বছর মার্কিন মুলুকে চাকরি করে, আবার সেক্টর ফাইভে ফিরে এসেছে। শান্তনুকে খুব পছন্দ করে অনিমেষদা। শান্তনুর কোথাও কোনও অসুবিধা হলে নিজের চেম্বারে ডেকে এনে হাতে ধরে সব বুঝিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না; যদিও ধারে-ভারে সবদিক থেকেই অনিমেষদা বহুগুণ এগিয়ে শান্তনুর থেকে।
সেই অনিমেষদা গত বছরখানেক ধরে, বিয়ের পর থেকেই সবসময় কেমন যেন একটা মনমরা হয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে ডুবে থাকে। চোখে-মুখের হাসি কোথায় যেন উবে গিয়েছে একেবারে। আগে শান্তনুদের টিম ভাল কিছু করলে, কারও জন্মদিন থাকলে, নিজের কোনও বেতন বৃদ্ধি হলেই, শান্তনুদের সবাইকে নিয়ে পার্ক-স্ট্রিট পাড়ার বড় কোনও রেস্তোরাঁতে গিয়ে ট্রিট দিত। সেইসব ইদানীং কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে অনিমেষদার জীবন থেকে। বহুদিন ধরে এর কারণ অনিমেষদার কাছে জানতে চাইব-চাইব করেও, চাওয়ার সাহস পায়নি শান্তনু।
আরও পড়ুন-কালীঘাটকে সমীহ ডায়মন্ড হারবারের
শেষে, দিন-দশেক আগে একদিন লাঞ্চ-ব্রেকে সাহস করে অনিমেষদার কাছে প্রশ্নটা পেড়ে ফেলল শান্তনু, ‘আচ্ছা, অনিমেষদা বহুদিন তুমি কোনও ট্রিট দাও না, সকাল-বিকেল দেখা হলে আগে যেমন কাঁধে হাত দিয়ে হাসতে-হাসতে কাজের বাইরের কত কথা বলতে, ইদানীং এসবের ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে, সবসময় কেমন যেন গম্ভীর হয়ে থাকো তুমি! কিছু যদি মনে না কর, তোমার কী হয়েছে, জানতে চাইতে পারি কি!’
‘কী আবার হবে! দিনের পর দিন পকেট খালি থাকলে, মুখে আকর্ণ হাসি ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় কি!’ খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে গম্ভীর কণ্ঠে শান্তনুর প্রশ্নের জবাব দিল অনিমেষদা।
‘কী বলছ তুমি! আমাদের থেকে পাঁচ-ছ’গুণ স্যালারি পকেটে ভরেও, তোমার পকেট খালি করে ফেলছ!’
‘অবভিয়াসলি! তবে পকেটটা আমি খালি করছি না! খালি করে দিচ্ছে একজন; সে আমার বর্তমানেই হোক বা আমার অবর্তমানে। বড়-বড় মলে ঢুকে এমন সব উচ্চমূল্যের জিনিসপত্র কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন উনি যে, আমি কিছুতেই সামাল দিতে পারছি না সেই খরচ। সব বাজেট ফেল মেরে যাচ্ছে আমার! একেক সময় মনে হচ্ছে, বাড়ি-ঘর ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাই আমি!’ একইরকম গম্ভীরভাবে জবাব দিল অনিমেষদা।
অনিমেষদার কথা শুনে, শান্তনু খুব হালকা চালে জানাল, ‘সত্যিই তো, এরকমভাবে চলে নাকি! যে করেই হোক, সামাল তোমাকে দিতেই হবে!’
‘সামাল তো দিতে হবে বুঝলাম; কিন্তু কী উপায়ে! টয়লেটে ঢুকলেও পার্স সঙ্গে করে নিয়ে যাই; সব ফর্মুলাই তো ফেল করে যাচ্ছে!’
‘ওসব ফর্মুলায় কোনও কাজ হবে না। তোমাকে কিছু হিল-জুতো কিনতে হবে; আর ঘরে যত পুরনো চটি-জুতো আছে, হয় সেগুলো হাওয়া করে দাও, নয়তো চটির স্ট্র্যাপ বা আঙুলের আংটাগুলো ছিঁড়ে রেখে দাও। বাইরে যেতে হলে নতুন হিল-জুতো ওঁকে পরতেই হবে। হিল-জুতো পরলে উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এবং শরীরের ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে মস্তিষ্কের কোষে যে অনুভূতি তৈরি হয়, তা ক্রেতাকে উপযুক্ত বাজেটে পছন্দসই কেনাকাটা করতে বাধ্য করে। হিল-জুতো পরে কেনাকাটা করলে, ক্রেতা উচ্চমূল্যের পণ্য পছন্দ না-করে, কম দামের পণ্য কেনার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। তার ফলে খরচের পরিমাণ বহুল পরিমাণে হ্রাস পায়।’
শান্তনু একদমে নতুন এই তথ্য জানানোর সঙ্গে-সঙ্গে অনিমেষদা বিস্মিত চোখে শান্তনুর মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘এইসব তথ্য তুই জানলি কোত্থেকে? তুই তো এখনও পর্যন্ত বিয়েই করিসনি!’
অনিমেষদার বিস্ময় দূর করার জন্য শান্তনু তৎক্ষণাৎ নিজের ডেস্ক থেকে ওর বাবার দেওয়া সেই জার্নালটা বের করে জানাল, ‘অনেকদিন ধরে এই জার্নালটা আমার ডেস্কে পড়ে ছিল। এতে কয়েকটা গবেষণাপত্র আছে; মন দিয়ে সেগুলো পড়ে ফেলো আগে। তারপরে বাড়ি ফেরার পথে আজই কয়েকটা হিল-জুতো কিনে ফেলো। অনলাইনেও কিনতে পারো। অনলাইনে কিনলে কয়েকটা হিল-জুতোর নাম মাথায় রেখো তুমি। যেমন, স্টিলেটস; চার-পাঁচ ইঞ্চি হিল লাগানো চটির মতো দেখতে। ওয়েজেস; উচ্চতায় পাঁচ-ছয় ইঞ্চির ফ্ল্যাট হিল-জুতো। তারপরে, পাম্পস; খুব সুন্দর দেখতে, ব্যালেরিনা শ্যুয়ের নিচে মস্ত বড় ছুঁচলো হিল লাগানো। এছাড়া কিউবা হিলস, কিটেন হিলসের মতন বহু হিল-জুতো আছে। সবগুলোই এক্ষেত্রে খুব কার্যকরী। তবে তুমি যাই কেনো না কেন, দু-চারদিন তুমি বাড়িতে থেকে বাড়ির ভিতরেই চলাফেরা প্র্যাকটিস করিয়ে দিও বউদিকে। তারপরে তুমি দেখতে পাবে, এই হিল-জুতো পরে শপিংয়ে বেরিয়ে, কেনাকাটার উপরে কীরকম প্রভাব পড়ে!’
আরও পড়ুন-আরজি কর ভাঙচুর-কাণ্ড: তলব মীনাক্ষী-সহ ৭ বাম ছাত্র-যুব নেতাকে
অগত্যা, বিভিন্ন ধরনের বেশ কয়েকটা হিল-জুতো কিনে বাড়ি ফেরার পরে, পুরো একটা সপ্তাহের ছুটি কাটিয়ে, আজ সোমবার অনিমেষদার অফিসে আসার কথা। আজই আবার বেলা বারোটার সময় একটা বিদেশি ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং আছে। একটা নতুন প্রোজেক্টের উপর ডেমো প্রেজেন্ট করতে হবে। এই প্রোজেক্টের সাফল্যের উপরে নির্ভর করছে শান্তনুর কাঙ্ক্ষিত অফ-শোর পোস্টিং-এর ব্যাপারটা। কিন্তু অনিমেষদা পাশে না থাকলে এসব ক্ষেত্রে শান্তনুর একটু নার্ভাস বোধ হয়।
ন’তলার ডেস্কে বসে, কাচের ভিতর দিয়ে ওয়াটারফ্রন্ট সংলগ্ন পথের দিকে তাকিয়ে একমনে অনিমেষদার আসার অপেক্ষা করছে শান্তনু। এমন সময় হঠাৎ করে পিছন থেকে ওর কাঁধের উপরে হাত রেখে অনিমেষদা বলল, ‘কীরে, বসে-বসে ওয়াটারফ্রন্টের দিকে তাকিয়ে, একমনে কী এত ভেবে চলেছিস! হোমফ্রন্ট নিয়ে বসের মানসিক যন্ত্রণা হিল-আপ করার পরীক্ষায় তো একশোতে একশো পেয়ে গিয়েছিস।’
‘যেমন!’ অনিমেষদার মুখের দিকে কৌতূহল-ভরা দৃষ্টিতে তাকাল শান্তনু।
‘যেমন, তোর প্রেসক্রিপশন মতো হিল-জুতো পরে শপিংয়ের ফল হল— সপ্তাহে দশ হাজারের কেনাকাটা একধাক্কায় একহাজারে নেমে এসেছে। এরপরে, আজকের ডেমোটা সাফল্যের সাথে উতরে দিতে পারলেই, তোর অফ-শোর পোস্টিং নিয়ে তোর ভিতরে যে যন্ত্রণা চলছে, তা হিল-আপ হয়ে যাবে আজই!!!’