শুরুতেই কয়েকটা কথা পরিষ্কার করে বলে দেওয়া জরুরি।
বামফ্রন্ট সরকারের শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ক্রমবর্ধমান হচ্ছিল৷ প্রারম্ভিক সমর্থন, ভালবাসা, শুভেচ্ছা ও আস্থা ও আশা ক্রমশ কমছিল৷ তার একটা বড় কারণ ছিল টিকে থাকা গণতন্ত্রের সঙ্কোচন, স্বীকৃত অধিকারগুলোর উপর আঘাত ও গণআন্দোলনের উপর লাগাতার আক্রমণ, নিপীড়ন৷
২০০৬ সাল থেকে শুরু হওয়া সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকেই কিন্তু বামফ্রন্টের অবনতি শুরু হয়নি। অনেক আগে থেকেই বাম সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছিল৷
মরিচঝাঁপির ঘটনা দিয়ে শুরু। তার পর এসেছিল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, পালন ও বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস (১৭৭৭-পরবর্তী পর্বে), রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি সংক্রান্ত শর্ত পালন। কিন্তু বিচারবিভাগীয় কমিশনগুলোর অকার্যকরতা অথবা অর্চনা গুহ নির্যাতনের ঘটনায় অত্যাচারী পুলিশকে কীভাবে বামফ্রন্ট সরকার আড়াল করেছিল সেটাও মনে করা ও মনে রাখা জরুরি।
আরও পড়ুন-কনভয়ের গাড়ির ধাক্কা মহিলাকে দিলীপ ঘোষ ঘুরেও দেখলেন না!
সময় যত এগিয়েছে আইনের শাসন তত শিথিল হয়েছে; পুলিশ হেফাজতে বন্দিহত্যার তালিকা তত দীর্ঘ হয়েছে; দোষীরা আইনি অব্যাহতি পেয়েছে৷ পুলিশ ক্রমশ ‘ট্রিগার হ্যাপি’ হয়ে উঠেছিল— কীভাবে, কোনও কোনও ঘটনায় পুলিশ নাগরিককে হত্যা করেছিল ও পার পেয়ে গেছিল, সেটাও বিস্মরণযোগ্য নয়। গবেষকরা বলেন, গত শতাব্দীর আটের দশকে লাল ঝাণ্ডাকে ডান্ডা করে এসইউসিআই সহ বিরোধীদের ট্রাম-বাসভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলনকে দমন করার মধ্য দিয়ে যা শুরু হয়েছিল তার পথ পরিক্রমা শেষ হয়েছিল নেতাই কাণ্ডে— বন্দুক দিয়ে প্রতিবাদরত গ্রামবাসীদের হত্যার মধ্য দিয়ে৷ মনে করিয়ে দিই, ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক বন্দিদের নিঃশর্তে মুক্তিদান হেতু বামফ্রন্ট নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অভিবাদন পেয়েছিল৷ কিন্তু সেই বামফ্রন্ট ১৯৮০ সাল থেকে আবার ‘আজিজুল হক’ পন্থী নকশালদের ধরপাকড় শুরু করে; অত্যাচার করে; প্রায় দশ বছর ধরে আজিজুল হক, নিশীথ ভট্টাচার্যদের বিনা বিচারে বন্দি করে রাখে; রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা না দিয়েই৷ উন্নয়নের নামে হকার উচ্ছেদ অভিযান, টালির নালার ঝুপড়ি উচ্ছেদ, রাজারহাট, বেলেঘাটার খালপাড়ের ঝুপড়ি উচ্ছেদের সরকারি নির্মম, অমানবিক দিক, নারীদের উপর অত্যাচারের নানা ঘটনা, অত্যাচারিত নারীর চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করা, কোনওকিছুই কিন্তু বাদ যায়নি সেসব দিনগুলোতে। আজ তারই চিকিৎসকদের আন্দোলনের দখল নিতে চেয়ে মারমুখী হয়ে উঠছে, ফেক নিউজ ছড়াচ্ছে। বলা বাহুল্য, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড়ের আন্দোলনকে কীভাবে বামফ্রন্ট সরকারের মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের চেহারা দেখে কট্টর সমর্থকদেরও পার্টির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, দূরত্ব বেড়ে গেল; আমলাতন্ত্র ও দলতন্ত্রের নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ল; অহঙ্কার, দম্ভ ইত্যাদির চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটল, সর্বোপরি ২০০৯ সালের পরেও অর্থাৎ লোকসভায় বিপর্যয়ের পরেও দায়সারা ভাবে দোষ-ত্রুটিকে স্বীকার করার মানসিকতা, এসব দেখে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন৷ ‘মাওবাদীদের’ দমনের নীতিও আদিবাসীদের সঙ্গে হার্মাদ লাল পার্টির দূরত্বকে বাড়িয়ে তুলেছিল৷
আরও পড়ুন-আরজি কর: মামলা শুনবে সুপ্রিম কোর্ট
পেছন দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, খাদ্য আন্দোলনের সময়ে বিধানচন্দ্র রায়ের সরকারের পক্ষে অনেক খ্যাতিমান লেখক, বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন৷ বিপরীতে শিবিরও ভারী ছিল৷ পরস্পরের প্রতি সমালোচনা-তির্যক মন্তব্য কিন্তু কখনও প্রচলিত শিষ্টাচারের মাত্রা ছাড়ায়নি৷ বিপরীতে, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, রিজওয়ানুর, লালগড়ে আন্দোলনের সময় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বিরোধীদের প্রতি কুকথা, অবমাননাকর শব্দ ও ভাষার যথেচ্ছ প্রয়োগ যা মানুষকে স্তম্ভিত করেছে; মানুষ ধিক্কার জানিয়েছে৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মেধা পাটকরকে মারার উসকানি, হেনস্থা ও গ্রেফতার, নন্দীগ্রামের আন্দোলনরত মহিলাদের প্রতি কুৎসিত বাক্যবাণ বুদ্ধ-সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল না৷ তার থেকেও মানুষের কাছে বড় হয়ে দেখা গিয়েছিল, তাদের অস্বীকারের রাজনীতি। সমস্ত ঘটনাকে অস্বীকার কর, প্রশাসনের যাবতীয় কু-কর্মকে সমর্থন কর, তার পক্ষে সাফাই গাও, এবং অষ্টম বারের ক্ষমতায় এলে প্রতিশোধের হুঙ্কার দাও— মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল৷ তাপসী মালিকের ধর্ষণ ও খুনকে ব্যঙ্গ করে নাটক লেখা, অভিযুক্তদের সোচ্চারে সমর্থন করা এবং ধারাবাহিক মিথ্যাচার মানুষ মেনে নিতে পারেননি৷ দলীয় মুখপত্র তো পড়ার প্রায় অযোগ্য হয়ে উঠেছিল৷ আজ সেসব দিন ভুলিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে লাল পার্টি ফের নেমেছে।
বন্ধ কলকারখানার শ্রমিকের দুর্দশা, অনাহারের মৃত্যু, ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার ঘটনাগুলো, জেল হেফাজতে মৃত্যুর তালিকা, ইউপিএ-র প্রয়োগ, (দু’-দু’বার— একবার দার্জিলিংয়ে ও একবার কলকাতায়) প্রায় তিরিশটি বিচার বিভাগীয় কমিশনের হাল, মানবাধিকার, নারী কমিশনের সরকারি তোষণ নীতিও বিস্মরণযোগ্য নয়।
এই প্রেক্ষিতে ১৩ বছরের মা মাটি মানুষের সরকারের কথা এসেই যায়।
আরও পড়ুন-সব রাজ্যকে নির্দেশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের
এই ১৩ বছরে একটাও গণহত্যার ঘটনা ঘটেনি।
এই ১৩ বছরে গণ আন্দোলন দমনের অজুহাতে পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেনি।
এই ১৩ বছরে কামদুনি ধর্ষণ মামলায় দোষীদের ফাঁসি হয়েছে।
এই ১৩ বছরে স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রীর মতো সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে।
এবারেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকে দোষীকে ফাঁসি দেওয়ার আওয়াজ তুলেছেন। এবারে তিনিই প্রথম প্রয়োজনে তদন্তভার সিবিআইকে দেওয়ার কথা বলেছেন।
এবারেও তিনি গণরোষের যৌক্তিকতা অগ্রাহ্য করেননি।
তাও আজ নৈরাজ্য সৃষ্টির অদম্য প্রয়াস জারি রয়েছে। আর, চিতার আগুনে চা গরমের নোংরা অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা অব্যাহত। আঁচটা গনগনে করতে ব্যস্ত ওই হার্মাদ পার্টি। জনগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে ফের প্রাসঙ্গিক হওয়ার মরিয়া চেষ্টা।
আজকের এই ধ্বান্ত ধ্বস্ত প্রহরে মনে করিয়ে দিই হেব্বারমাসের সেই অমোঘ উক্তি।
দুঃস্বপ্নের ইতিহাস কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়৷
আজকের যৌবনকে সেই ইতিহাস ভুলিয়ে ঘুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যখন চলছে, তখনই স্মৃতির সলতে উসকে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখাটা সময়ের দাবি।
সরি কমরেড! মাফ করবেন।