হায়, আই এম চিট্টি দ্যা রোবট!
মনে পড়ে সুপারস্টার রজনীকান্ত এবং ঐশ্বর্য রাই বচ্চন অভিনীত সেই বিখ্যাত সিনেমা রোবটের কথা— ডাঃ বসিগারনের তৈরি সেই চমকপ্রদ সর্বগুণসম্পন্ন রোবট চিট্টি। তবে সিনেমার পর্দা থেকে এবার বাস্তবে ফিরে আসুন; ভাববেন না ওগুলো শুধুমাত্র সিনেমাতেই হয়! নাহ্, আজকে বাস্তবে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরাও এমনটা করে দেখাচ্ছেন— আপনিও পারেন তাদের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কেরামতি
আসলে এসবই হল জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Artificial intelligence) বা উৎপাদনক্ষম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কামাল। জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হল এমন একপ্রকার মেশিন লার্নিং যেখানে কোনও একটি যন্ত্র বা বৈজ্ঞানিক সিস্টেম প্রশিক্ষিত ডেটার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধারা এবং গঠনের প্রক্রিয়াকরণের পর একই বৈশিষ্ট্যের নতুন ডেটা উৎপাদন করে। ফলস্বরূপ তৈরি হয় নতুন নতুন কনটেন্টস, যেমন— টেক্সটস বা মূল পাঠ, ইমেজেস বা ছবি, ভিডিও-অডিও এবং আরও কত কিছু। এই প্রকার ফলদায়ক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহাবস্থানে আজকে ভারতবর্ষ তথা গোটা বিশ্বের নানা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাণিজ্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে।
প্রফেসর মালার
সম্প্রতি বাজারে এসেছে ভারতবর্ষের প্রথম দেশজ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Artificial intelligence) ইঞ্জিনিয়ার দেবিকা; এসেছে ভারতবর্ষের প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মানবীয় রোবট-শিক্ষিকা আইরিস। কেরালা রাজ্যের ‘কে টি সি টি হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল’ এবং ‘মেকারল্যাবস এডুটেক’-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি রোবট টিচার আইরিস ক্লাসরুমে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিজস্ব স্বরে কথোপকথন করতে সক্ষম। তবে এবার আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে, একেবারে বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বয়ংক্রীয় শিক্ষিকা নিয়ে উপস্থিত ভারতবর্ষের গবেষকরা। শিক্ষা জগতে আলোড়ন ফেলে দিতে এসে গেছে ‘মালার টিচার’।
ভারতবর্ষের চেন্নাই শহরস্থিত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্টার্টআপ স্টুডিও ‘হাইভ’-এর কর্ণধার অর্জুন রেড্ডি এবং দীপিকা লোগানাথনের রিসার্চ টিমের উদ্যোগে আমাদের সামনে হাজির ইউনিভার্সিটির এ আই প্রফেসর মালার। এই বৈজ্ঞানিক সিস্টেমটি প্রকাশ পাওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর সঙ্গে গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিটস, লার্নিং প্রসেসিং ইউনিটস, ইনটেন্ট আইডেন্টিফায়ার এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স লোড ব্যালান্সিং রাউটারের মতো বিভিন্ন প্রযুক্তি সংযুক্ত রয়েছে উন্নত পারফরমেন্স এবং মাপযোগ্যতার জন্য।
প্রফেসর মালার প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের হোয়াটসঅ্যাপের মতো বহুল ব্যবহৃত যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে শিক্ষা দিতে প্রস্তুত। ব্যবস্থাপনা খরচের কথা মাথায় রেখে প্রাথমিকভাবে অধ্যাপক মালার বিনা পয়সায় প্রতিটি ইউজারকে দৈনিক ২০টি প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি; তবে মক ইন্টারভিউ এবং অ্যাসেসমেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য ব্যবহারকারীদের একটি নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে। আশ্চর্যজনকভাবে মালার টিচার আন্না ইউনিভার্সিটির প্রতিটি ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার সমস্ত সিলেবাস আত্তীকরণ করে বসে আছেন; তিনি যে কোনও সময় যে-কোনও জটিল বিষয় একটি দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বোঝার মতো সহজ করে উপস্থাপন করতে পারেন।
হনুমান
উঁহু, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Artificial intelligence) শুধুমাত্র স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমেই সীমাবদ্ধ নয়; ওইসবের গণ্ডি পেরিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন কোনও দেশের ফরেন সার্ভিসের সহকারী হিসেবেও নিয়মিত কাজ করে চলেছে। সাম্প্রতিক কালে ইউক্রেনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌলতে বাজারে এসেছে ডিজিটাল ব্যাক্তিত্বের ‘ভিক্টোরিয়া শী’— তিনি বিদেশ মন্ত্রকের প্রতিনিধিত্ব এবং মিডিয়ার সঙ্গে কনস্যুলার কমেন্টেটরের ভূমিকা পালন করবেন।
অনুরূপভাবে ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীরাও জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগে বিশ্বের সামনে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন ৯৮টি বৈশ্বিক ভাষায় সমৃদ্ধ প্রথম দেশজ জেনারেটিভ এ আই প্ল্যাটফর্ম হনুমান। পৃথিবী জুড়ে ভারতবর্ষের ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক মাহাত্ম্যের প্রচার, প্রসার এবং জনপ্রিয়করণের উদ্দেশ্যে ‘এস এম এল ইন্ডিয়া’ এবং ‘৩ এ আই হোল্ডিং লিমিটেড’ যৌথ উদ্যোগে হনুমানকে বাজারে এনেছে।
দেশজ এই প্লাটফর্মটি ভারতবর্ষের প্রায় ১২টি ভাষায় দক্ষ এবং প্রভু রামের প্রতি লর্ড হনুমানের যেমন অবাধ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে আজ্ঞাবহ, ঠিক তেমনই উৎপাদনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হনুমানও। বর্তমানে এই প্ল্যাটফর্মটি অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের জন্য উপলব্ধ এবং ফ্রি-তে; আইওএস ইউজারদের জন্য শীঘ্রই আসছে। লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল-সহ এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বাস্থ্য পরিষেবা, প্রশাসন, অর্থনৈতিক কারবার এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পুরোপুরি সমৃদ্ধ। বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য এই বছরের মধ্যেই প্রায় ২০০ মিলিয়ন সংখ্যক গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাওয়া।
কবিতা
আমেরিকার ওয়াশিংটন স্কোয়্যারে বসে একদল তরুণ খোশমেজাজে আড্ডা দিচ্ছেন, হঠাৎ একজন অচেনা মানুষ এসে তাঁদেরকে অনেকটাই পোলারয়েড ক্যামেরার মতো একটি ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে তাঁর ছবি তুলে দিতে বললেন। তাঁরাও না করলেন না, বেশ আনন্দের সঙ্গেই ছবি তুলে দিতে আগ্রহী হলেন। তবে সবাই পুরোপুরি চমকে উঠলেন, যখনই ছবি তোলার জন্য ক্যামেরায় ক্লিক করেছেন তখনই স্ক্র্যাচ স্ক্র্যাচ করে ক্যামেরা থেকে বেরিয়ে এল আস্ত একটি কবিতা— পুরো ঘটনাটির কাব্যরচনা! বেশ জমানো সারপ্রাইজ কিন্তু—
একটু পরেই ওই ব্যক্তি সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার পর সবটা পরিষ্কার হল। তিনি রায়ান ম্যাথার এবং তাঁর বন্ধু কেলিন ক্যারোলিন ঝ্যাং, দুজনেই নিউ ইয়র্ক স্থিত ডিজাইনার; ওপেন এআই-এর জিপিটি-৪ এলএলএম-এর সহাবস্থানে ওঁরা একটি পেট প্রোজেক্ট হিসেবে তৈরি করেছেন ‘পোয়েট্রি ক্যামেরা’— ওর মধ্যে রয়েছে একটি সিঙ্গেল বোর্ড কম্পিউটার ‘রাস্পবেরি পাই’ এবং ডিজিটালি স্টোরড পেপার, কবিতা প্রিন্ট করার জন্য। যে কোনও পরিস্থিতিতে যে কোনও কিছুর বর্ণ, ধরন, বিষয়বস্তু ও এমনকী আবেগের কথা মাথায় রেখে তৎক্ষণাৎ ব্যবহারকারীর চাহিদা অনুযায়ী লিখে ফেলে মুক্ত পঙক্তি, সনেট কিংবা জাপানিজ হাইকু।
আরও পড়ুন- ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বেরতেই মিথ্যাচার ফাঁস
আগামীর স্বপ্ন
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আগামী সভ্যতার রূপকার এবং পরিচালকও বটে, একথা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে শুধু যে যন্ত্রসভ্যতার ব্যাপক প্রচার প্রসার হচ্ছে তা নয়; সামগ্রিক মানসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক এবং মানবিক ক্ষেত্রেরও সমহারে বিকাশ ঘটছে। বিশেষ করে জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা উৎপাদনক্ষম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহাবস্থানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে অনস্বীকার্য পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে রইল আমাদের বর্তমান প্রজন্ম— আগামী দিনে এডুকেশন টেকনোলজি সেক্টরের উন্নয়ন যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনাতীত। এই অভাবনীয় প্রযুক্তির ফলেই জটিল ও যৌগিক সব ডেটাগুলো রূপান্তরিত হচ্ছে সহজ কর্মক্ষম বুদ্ধিমত্তায়। এই প্রকৌশল টেকনোলজি এবং আর্টের মধ্যে একটি সুন্দর মেলবন্ধন ঘটিয়ে সভ্যতাটিকে আরও সুসংহত করে তুলছে— এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাচ্ছে।