আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ঘটনা। এক সপ্তাহ হল তদন্তভার গিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে। কিন্তু তারা বড়সড় কোনও ‘ব্রেক থ্রু’ করতে পারেনি। তদন্ত শুরুতে যে তিমিরে ছিল, এখনও সেই তিমিরে।
সাধারণ মানুষকে ইতিবাচক কিছু বার্তা দিতে না পারায় ক্ষোভ বাড়ছে। বাড়বেই।
এতদিন সুকৌশলে নাগরিক সমাজের আন্দোলন এবং রাজনৈতিক দলগুলির টার্গেট ক্রমেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে ঘুরিয়ে রাখা হয়েছিল। এবার প্রকৃত অপরাধের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং হত্যার পিছনে কারা জড়িত? জানতে চাইছে মানুষ। চিতার আগুনে আন্দোলনের জল ফুটানোর কারবার আর কতদিন চলবে?
আরও পড়ুন-লোকসভা ভোটের প্রচারে মোদির ১৭৩ ভাষণের মধ্যে ১১০ ক্ষেত্রে মুসলিম বিদ্বেষ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য
আরজি করে অনিয়ম নিয়ে সন্দীপ ঘোষকে লাগাতার জেরার পাশাপাশি সর্বাগ্রে জানা দরকার সেদিন রাতে ঠিক কী ঘটেছিল? সবথেকে বড় প্রশ্ন, মোটিভ কী ছিল? শুধুই ধর্ষণ? এবং তারপর হত্যা? নাকি নেপথ্যে রয়েছে অন্য কিছু? এই জ্বলন্ত প্রশ্নগুলি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সত্য-মিথ্যা হাজারো জল্পনা এবং ফেক নিউজের রমরমা চলছে। সেগুলোকে হাতিয়ার করে বাংলার নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে বাংলাদেশি স্টাইলে ফেলে দেওয়ার চিত্রনাট্য রচিত হচ্ছে।
শতবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও ডাক্তারদের আন্দোলন প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। নাগরিক বিক্ষোভেও রাশ টানা নয়, নতুন নতুন উসকানির আয়োজন চলছে প্রতিদিন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোনও বিচ্ছিন্ন অপরাধী-শ্রেণি আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চক্রান্তে লিপ্ত হচ্ছে এমন, ইনপুটও পাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
সব মিলিয়ে একটাই প্রশ্ন আকাশে বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত সিবিআইয়ের দিক থেকে কোনও কিনারা হল না কেন?
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’-এর পাশাপাশি উঠে আসছে আর একটা স্বর, ‘উই ওয়ান্ট ট্রিটমেন্ট’। আন্দোলন চলছে চলুক, আমাদের কেন মরতে হবে? এই জিজ্ঞাসায় তোলপাড় এখন বাংলা। ডাক্তারদের আন্দোলনের ন্যায্যতা নিয়ে দ্বিমত না হয়েও রোগী ও তাঁদের পরিজনের প্রশ্ন, ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন চলুক। কিন্তু তার জন্য কেন বিনা চিকিৎসায় মানুষ মরবে?
আসলে, অজস্র সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রতিবাদ-আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছেন চিকিৎসকরা। আর জি করের ঘটনা সামনে আসার পর থেকে দফায় দফায় ধর্মঘট, কর্মবিরতি চালাচ্ছেন তাঁরা। এর প্রভাব পড়েছে সার্বিক চিকিৎসাক্ষেত্রে। হাসপাতালে এসে বহু রোগীকে ফিরে যেতে হচ্ছে বিনা চিকিৎসায়। অসহায়ভাবে মৃত্যু ঘটছে অনেকের। সপ্তাহখানেক ধরে চলছে এই পরিস্থিতি। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগী ও তাঁদের পরিজনের দুর্ভোগ। ক্ষোভ বাড়ছে ভুক্তভোগীদের মধ্যে।
আরও পড়ুন-দাম নিয়ন্ত্রণের শর্তে কাটল জট, নবান্নের বৈঠকে সিদ্ধান্ত, ভিন রাজ্যে আলু রফতানির অনুমোদন
শহরের সব সরকারি হাসপাতালে রোগীর সংখ্য এখন হাতে গোনা। অনেক রোগীকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক রোগীকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বাড়ির লোকজন। কী আর করবেন? জ্বরে পুড়ছে সন্তানের গা। কিন্তু বেলা ১২টাতেও দেখা মিলছে না ডাক্তারের। ইসিজি করাতে এলে নিরাপত্তারক্ষীরা জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘পরিস্থিতি ভাল না। কয়েকদিন পরে আসুন।’
অ্যাম্বুলেন্স ছুটিয়ে রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে এসে রোগীর আত্মীয়স্বজন দেখছেন, কার্ডিওলজির ইমার্জেন্সি একেবারে শুনশান। সেখানকার নিরাপত্তারক্ষী জানাচ্ছেন, মূল ইমার্জেন্সি থেকে রেফার করলে তবেই এখানে রোগী আসছে। হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে, ভর্তি নেওয়া যাবে না।
ছোট্ট ছেলে একটি স্ট্রেচার টেনে নিয়ে যাচ্ছে। স্ট্রেচারে শুয়ে তার দিদা। কষ্ট হচ্ছে একা টানতে। কিন্তু দিদাকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য নাছোড়বান্দা সে। সকাল থেকে দিদা পেটের ব্যথায় কাতর। তাঁকে নিয়ে মা ও সে মিনাখাঁ থেকে ছুটে এসেছে পিজিতে। কিন্তু ভর্তি নেয়নি হাসপাতাল। প্রেসক্রিপসনের উপর হাসপাতালের স্ট্যাম্প, বেড খালি নেই। মৌখিকভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, ‘পরিস্থিতি ভাল নয়। অন্য কোথাও নিয়ে যান।’ ইমার্জেন্সির সামনে দাঁড়িয়ে এ-নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন তাঁরা। ‘বেড খালি ছিল। প্রথমে বলল, হয়ে যাবে। এখন বলছে হবে না। … ডাক্তারবাবুদের আন্দোলন চলুক। কিন্তু একজনের জন্য বিচার চাইতে গিয়ে আমাদের কেন এভাবে মরতে হবে!’ অভিযোগ, ‘বেড যে খালি নেই, তা নয়। হাসপাতাল তো ফাঁকা। লোকজনই নেই। তবুও এমন করছে! কোথায় যাব বলুন তো!’ বলতে বলতে চোখের কোণ চিকচিক করে উঠছে।
আরও পড়ুন-পোস্ট মুছে সুখেন্দুর আর্জি কড়া ব্যবস্থা নেবেন না
এর মধ্যেই উঠে আসছে সেই সব খবর। ফাঁস হয়ে যাচ্ছে অপপ্রচারের চেষ্টা। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খুন এবং ধর্ষণের শিকার তরুণী চিকিৎসকের হাড়, মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের দু’জন এবং এনআরএস-এর একজন— সবশুদ্ধ ফরেনসিক মেডিসিনের তিনজন চিকিৎসক প্রায় একঘণ্টা ধরে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছিলেন। ওই ময়নাতদন্তের রিপোর্টে স্পষ্ট ভাষায় তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং শ্বাসরোধ করে গলা টিপে খুন করার কথা উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখ রয়েছে শরীরে বাইরে (এক্সটারনাল) ১৬ ধরনের আঘাতের। এছাড়াও শরীরের ভিতরে আঘাতের সংখ্যা নয়।
অথচ, ঘটনার পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের তথ্য ঘুরছে ময়নাতদন্ত নিয়ে। এমনকী, তাঁর স্ত্রীঅঙ্গ থেকে ১৫০ গ্রাম সিমেন পাওয়া গিয়েছে বলেও দাবি করা হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। পেলভিক বোন ভেঙে গিয়েছিল ওই তরুণীর, এমন বার্তাও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন মহল থেকে। অথচ, ময়নাতদন্ত রিপোর্টের ‘মাসলস, বোনস অ্যান্ড জয়েন্টস’-এর ‘ইনজুরি’ অংশে স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে ‘নট ফাউন্ড’। কোমর থেকে নিম্নাঙ্গকে ধরে রাখা পেলভিক বোন সহজে ভাঙার প্রশ্ন আসে না। পথ দুর্ঘটনা বা উঁচু থেকে পড়ে না গেলে এত শক্ত হাড় ভাঙার আশঙ্কা কম। প্রশ্ন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে বিভিন্ন ‘ফেক নিউজ’ ছড়ানোর পিছনে কারও অন্য উদ্দেশ্য ছিল না তো?
তাহলে কি মুনাফাকামী বেসরকারি হাসপাতালগুলো চায়, এমন নৈরাজ্য, এরকম অরাজকতা চলুক, তাতে তাদের লাভ? ঠিক যেমন নির্বাচনে পর্যুদস্ত জনবিচ্ছিন্ন বিরোধী দলগুলো চায়, এই নৈরাজ্যের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা দখল করতে। তাই তারা আন্দোলনের আবেগে বাতাস করেই চলেছে!