চন্দ্রযান-৩ চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করার পর প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত। ভারতের বিজ্ঞানীরা রোভার মডিউলের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কী কী পাওয়া গিয়েছে তা প্রকাশ করেছেন। আলফা পার্টিকল এক্সরে স্পেকট্রোমিটার কী কী তথ্য সংগ্রহ করেছে সেসব খবরও এই প্রকাশিত তথ্যাবলির অন্তর্ভুক্ত। গত বুধবার ‘নেচার’ পত্রিকায় এসব খবরাখবর বেরিয়েছে।
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক, আলফা পার্টিকল এক্সরে স্পেকট্রোমিটার, সংক্ষেপে এপিএক্সএস কী কী খুঁজে পেল।
আরও পড়ুন-২৮ অগাস্ট প্রকাশ পাবে সাথী, বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকলেন নেত্রী
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন এপিএক্সএস মূলত তিন ধরনের জিনিস খুঁজে পেয়েছে। (১) চন্দ্রযান-৩ যেখানে অবতরণ করেছে তার আশপাশের অঞ্চল মোটামুটি একইরকম। (২) চন্দ্রপৃষ্ঠ স্তরের ওপর স্তর যুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে। এই পর্যবেক্ষণ ম্যাগমা সাগর প্রকল্পকে সমর্থন করে। (৩) চন্দ্রপৃষ্ঠের নিম্নস্তরে খনিজ পদার্থ বর্তমান। সুতরাং উপরিভাগেও তা থাকবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যে পরিমাণ খনিজ পদার্থের উপস্থিতি উপরিভাগে আশা করা গিয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে খনিজ পদার্থ এই উপরের স্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
চাঁদে বিশাল ম্যাগমা সাগরের অবস্থিতি বিষয়ক প্রকল্প চন্দ্রযান-৩-এর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের সুবাদে সমর্থিত হয়েছে।
আনুমানিক ৪৫০০০০০০০০ বছর আগে পৃথিবীর সঙ্গে একটি বিরাট গ্রহাণুর সংঘর্ষ হয়। সম্ভবত তারই ফলে সৃষ্টি হয় চন্দ্রের। বিজ্ঞানীদের অনুমান, চন্দ্রের উৎপত্তির প্রাথমিক পর্যায়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে পুরোপুরি একটা ম্যাগমা সাগর ছিল। লক্ষ লক্ষ বছর লেগেছিল সেই সাগর ঠাণ্ডা হতে। সে সময় অলিভাইন ও পাইরোক্সিনের মতো সিলিকন ও ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খনিজ চন্দ্রপৃষ্ঠের গভীরে নিমজ্জিত হয়। কারণ সেগুলো ওজনে ভারী। উল্টোদিকে, ক্যালসিয়াম ও সোডিয়াম সমৃদ্ধ যৌগগুলো ভাসতে ভাসতে উপরিস্তরে থেকে যায়। কারণ সেগুলোর ওজন অপেক্ষাকৃত হালকা। এখন চন্দ্রযান-৩-এর এপিএক্সএস যা যা খুঁজে পেয়েছে তার সূত্রে সমর্থিত হয়েছে একটাই অনুমান। চন্দ্রপৃষ্ঠের উপরিস্তরের ৮০-৯০ শতাংশ লোহা, ম্যাগনেশিয়াম এবং সোডিয়াম সমৃদ্ধ পাথর দিয়ে তৈরি আর নিম্নস্তর ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ পাথরে তৈরি।
এপিএক্সএস যাযা দেখেছে, খুঁজে পেয়েছে তার মধ্যে নতুন আবিষ্কারও আছে একটি। তার থেকে বোঝা যাচ্ছে চন্দ্রপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্তরগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মেশামেশি চলেছে। চাঁদের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম অববাহিকা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর এইটকেন অববাহিকা সম্ভবত গ্রহাণুর প্রভাবে গঠিত হয়। এই অববাহিকার ব্যাস প্রায় ২,৫০০ কিমি, কার্যত দিল্লি ও কোচির মধ্যবর্তী দূরত্ব। এই অববাহিকার গভীরতা ৬.২ – ৮.২ কিমি। অনুমান করা হয় ৪২০০০০০০০০ – ৪২০০০০০০০০ বছর আগে যখন গ্রহাণু এই চান্দ্রেয় দক্ষিণ মেরুর নিকটবর্তী অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল, তখন এটি গঠিত হয়। চন্দ্রযান এই অববাহিকার ৩৫০ কিমি-র মধ্যে অবতরণ করেছে। মডেলিং, ইমেজিং এবং নানাবিধ প্রকল্পের সূত্রে এই বিষয়গুলো কমবেশি জানাই ছিল। তবে এই নতুনভাবে উঠে আসা তথ্যগুলোর অভিনবত্ব অন্য জায়গায়।
আরও পড়ুন-সঞ্জয় রাইয়ের ফাঁসির দাবিতে পথে নামল বাংলা পক্ষ
এর আগে অন্যান্য দেশ থেকে যেসব চন্দ্রযান পাঠানো হয়েছিল সেগুলো চাঁদের নিরক্ষীয় ও মধ্য অক্ষাংশীয় এলাকার চন্দ্রপৃষ্ঠের রকমসকম নিয়ে গবেষণা করেছিল, তথ্য জুগিয়েছিল। এবারই প্রথম ভারতের পাঠানো চন্দ্রযানের সৌজন্যে মেরু অঞ্চলের পৃষ্ঠতলের উপাদান উপকরণ নিয়ে গবেষণার সুযোগ পাওয়া গেল।
ভারতের চন্দ্রযান-৩-এর রোভার অবতরণ স্থলের ৫০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে, চন্দ্রপৃষ্ঠের নানারকম অবস্থা নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করেছে। এর থেকে দেখা গিয়েছে অবতরণ স্থলের আশেপাশের পৃষ্ঠতল মোটামুটি মসৃণ। এই তথ্য আগে জানা ছিল না। লক্ষণীয়, এই মসৃণতা মোটেই ভূপৃষ্ঠের মতো নয়, যেখানে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে ভূত্বকে ঢেউ তৈরি হয়।
রোভারের চলনপথের ২৩টি জায়গার মাপজোক নেওয়া হয়েছে, চন্দ্রপৃষ্ঠের উচ্চাবচ অঞ্চলের এমন মাপজোক ইতিপূর্বে হয়নি। এর আগে অ্যাপলো ১৬ হোক বা লুনা ২০, কিংবা চাঙ্গে ৪ (প্রথমটি আমেরিকার, দ্বিতীয়টি রাশিয়ার, তৃতীয়টি চিনের চন্দ্রযান), সেগুলো চন্দ্রপৃষ্ঠের উঁচু জায়গায় মাপজোক করেছিল বটে। তবে এমন নিবিড়ভাবে নয়, এপিএক্সএস মাপজোক করার জন্য ৩১ ঘণ্টা সময় পেয়েছে, দশদিন ধরে এই কাজ চলেছে, এর আগে এমনটা করা যায়নি। ভবিষ্যতের গবেষণার কাজেও এসব তথ্যাদি ভীষণ কাজে লাগবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা, চন্দ্রপৃষ্ঠের মসৃণতা আগামীতে রিমোট চালিত কাজকর্মের জন্য ক্রমাঙ্কন বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পক্ষে অনুকূল। ফলে আগামীদিনে চন্দ্রাভিযানে এই জ্ঞান সহায়ক হতে পারে। চাঁদের উল্কাগুলো চাঁদ থেকে উৎপন্ন হয়ে গ্রহাণু কিংবা ধূমকেতুর ওপর প্রভাব ফেলে। পৃথিবীর অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের প্রভাবে পৃথিবীতে সেগুলো আছডে় পডে়। এই উৎস এবং গর্তের, চাঁদ ও পৃথিবীর সম্পর্ক বোঝার জন্য এ-বিষয়ক গবেষণার জন্য এ-সমস্ত তথ্য দরকারি।