তারুণ্যের সুর। নারী শক্তির জয়জয়কার। এক কথায় এবারের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের সভাকে ব্যাখ্যা করতে হলে এই দুটি কথাই সবচেয়ে আগে মনে পড়ছে। একদিকে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কী বার্তা দেন, সেদিকে বাড়তি নজর ছিল রাজনৈতিক মহলের। উল্টোদিকে গোটা বাংলা জুড়ে যে রাজনৈতিক অস্থির অবস্থা সৃষ্টি করার প্রাণপণ চেষ্টা সিপিএম এবং বিজেপির সম্মিলিত শক্তি করে চলেছে, তাঁর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ ‘প্রকৃত’ ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে ছাত্র সমাজ আদতে এইসব নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিপক্ষে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের বিশ্বাস-ভরসা অটুট।
আরও পড়ুন-এবার স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য ও যৌন সচেতনতার পাঠ
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মঞ্চ বরাবরই নতুন ছাত্র নেতা-নেত্রীদের প্রতিভা বিচ্ছুরণের মঞ্চ। বহু নেতা-নেত্রীর জন্ম দিয়েছে এই মঞ্চ। এবারের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের এই মঞ্চ জন্ম দিয়েছে একঝাঁক নতুন প্রতিভার। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই চেয়েছেন তাঁর পরের তিনটি প্রজন্মকে তৈরি করে যেতে। বিশেষত সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দিতে চেয়েছেন বারবার। এবারের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মঞ্চে একদিকে যখন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বার্তা দিয়েছেন, আগামী দিনে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হলে, সেখানে যেন ৫৫% ছাত্রীর জন্য সংরক্ষিত থাকে। সেখানেই চারজন নতুন ছাত্রী নেত্রীকে মঞ্চে বক্তব্যের জায়গা করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ রাজ্যের তাবড় তাবড় মন্ত্রী বিধায়ক, সর্বোপরি সামনে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর সামনে চারজন নতুন ছাত্রী নেত্রীকে এত বড় মঞ্চে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ করে দিলেন, শুধু মুখে না কাজেও তিনি সবসময় চান নারী শক্তির জয়জয়কার।
মীনাক্ষী ভট্টাচার্যের কথাই যেমন বলা যাক। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামে বড় হওয়া মীনাক্ষী দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং বর্তমানে গবেষণা করছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর এক সপ্তাহ বাদেই মীনাক্ষীর পি-এইচ-ডি-র আওয়ার্ড সেরিমনি। তার আগেই মীনাক্ষী তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মঞ্চে আগুন ঝরালেন তাঁর বক্তৃতায়।
তেমনই বীরভূমের ঋতুপর্ণা সিনহা। তফসিলি জাতির প্রতিনিধি ঋতুপর্ণার জন্ম, বেড়ে ওঠা রামপুরহাটে। স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর পড়তে কলকাতায় আসা। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক, স্নাতকোত্তর করে বর্তমানে গবেষণার চেষ্টায় রয়েছেন ঋতুপর্ণা। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের একনিষ্ঠ কর্মী ঋতুপর্ণা গত কয়েক বছর ধরেই সংগঠনের কাজে নিয়োজিত। বক্তব্যের সাথে সাথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত ছাত্র-যুবদের নিজস্ব ব্যন্ড ‘জয়ী’র সদস্যা হিসেবে এদিনের মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশনও করেছেন ঋতুপর্ণা।
আরও পড়ুন-ঘন নিশি কৌশিকী
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী শ্রেষ্ঠা দাসও জীবনে প্রথম বড় মঞ্চে বক্তব্য রাখলেন। শ্রেষ্ঠার বক্তব্যেও উঠে এসেছে বাংলার উন্নয়নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা এবং বিরোধীদের অপপ্রচারের প্রসঙ্গ।
এবং উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের পৌলোমী দাম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করে বর্তমানে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই গবেষণা করছেন পৌলোমী। এদিন মঞ্চে পৌলোমীর বক্তব্যে মুগ্ধ হয়েছেন বহু প্রবীণ নেতাও। এছাড়াও উত্তরবঙ্গেরই কোচবিচারের ছাত্র নেতা অনির্বাণ সরকারও তাঁর বাগ্মীতায় মুগ্ধ করেছেন। বাকিদের মতো, অনির্বাণের কাছেও এটি ছিল জীবনে প্রথম এত বড় মঞ্চ। উত্তর কোচবিহার বিধানসভার ছাত্র নেতাকে এত বড় বক্তব্য রাখার জায়গা দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন, বাংলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নতুন প্রতিভা তুলে এনে তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে জায়গা দেওয়াই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। তাই হয়তো বাংলার ৫টি ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের নব্য প্রতিভাদের বৃহত্তর মঞ্চে এগিয়ে দিলেন দলনেত্রী।
বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন বাংলার বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচার চালাচ্ছে একশ্রেণির গণমাধ্যম। বিশেষত বাংলায় মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমাগত মিথ্যে বুলি আউড়ে চলেছে এক শ্রেণির দালাল মিডিয়া। তখন পৌলোমী, মীনাক্ষী, ঋতুপর্ণা, শ্রেষ্ঠারা বাংলার সেই সমস্ত কোটি কোটি নারীর প্রতিনিধি হয়ে অবতীর্ণ হলেন আঠাশের মঞ্চে। যাঁরা আজও বিশ্বাস করেন, এই বাংলা বরাবর নারীশক্তির জয়গান করেছে। যে বাংলায় বৈষম্য নেই। যেখানে নারী পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনের সংগ্রাম চালিয়ে যায়। যেখানে প্রতিদিন নামখানা, কাকদ্বীপ, লক্ষ্মীকান্তপুর, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর লোকালে করে লক্ষ লক্ষ মহিলা প্রতিদিন শহর দখল করেন। জীবন জীবিকার স্বার্থে সারাদিন লড়াই করে ফিরে যান নিশ্চিন্তে। সেই বাংলায় উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক এলাকার একটা মেয়ে স্বপ্ন দেখে কলকাতা মহানগরীতে দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে নিজের মাতৃভাষায় নিজের কথা দৃঢ় উচ্চারণ করতে। যে কলকাতা শহরকে নিয়ে অজস্র ফেক কুৎসার স্রোত বইয়ে দেয় একশ্রেণির ‘গোদি মিডিয়া’, সেই শহরেই লালমাটির দেশ বীরভূম থেকে আসা একটা মেয়ে লক্ষ জনতার সামনে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে! দেখায়। ঋতুপর্ণা-শ্রেষ্ঠাদের মঞ্চের ওপরে দেখে চোয়াল শক্ত করে শপথ নেয় সদ্য কলেজে ওঠা প্রথমবার কলেজের দাদা- দিদিদের সাথে মমতা দিদির সভা শুনতে কলকাতায় আসা লালগড় বা সোনামুখীর অষ্টাদশী মেয়েটাও। একদিন ওই মেয়েটাও আকাশ ছোঁবে। নিশ্চিত নিরাপত্তায় ওকে আগলে রাখবে এই শহর, এই রাজ্যের অভিভাবিকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-আদিবাসী নির্যাতিতাকে হাসপাতালে দেখতে গেলেন মন্ত্রী বীরবাহা হাঁসদা
আসলে আঠাশ মানেই আবেগের বিস্ফোরণ। বাঁধভাঙা উল্লাস। কিন্তু সব দিক থেকেই এবারের আঠাশ অন্য রকম ছিল। একটি অনভিপ্রেত ঘটনা এবং তাকে কেন্দ্র করে যে চূড়ান্ত নোংরা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে মশগুল হয়েছে সিপিএম-বিজেপির সম্মিলিত প্রয়াস, তার বিরুদ্ধে এবারের আঠাশ যেন ছিল একটা মোক্ষম জবাবের মঞ্চ। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের দিনেই বাংলা বনধ্ ডেকে সেই আগুনে আরও ঘৃতাহুতি করার চেষ্টা করেছিল বাংলাদ্রোহীরা। যথেষ্ট উসকানি ছিল, যাতে বাংলাকে অশান্ত করা যায়। কিন্তু দিনের শেষে বাংলা দেখল কোনও উসকানি না, প্ররোচনায় পা না দিয়ে, বাংলার নতুন প্রজন্মের ছাত্রী-নেত্রীরা জবাব দিলেন মঞ্চ থেকেই। সেখানে শিক্ষার প্রগতি-সঙ্ঘবদ্ধ জীবন-দেশপ্রেমের মন্ত্র ছিল। সেখানে যাবতীয় কুৎসার বিরুদ্ধে সত্যের পথে থাকার আত্মবিশ্বাস ছিল। সেখানে ‘ছাত্র সমাজে’র নামে লুম্পেনগিরি-অরাজকতা ছিল না। বরং ছিল জ্ঞানের আলো জ্বালানোর প্রয়াস। যেখানে, রায়গঞ্জ, বীরভূম, পূর্ব বর্ধমান, কলকাতা-সহ বাংলার লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রীর বাংলাদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সমবেত স্বর মিলে মিশে যায় জনতার মুখরিত সখ্যে।