প্রতিবেদন : আপনি হয় কোভিডের টিকা নিয়েছেন আর না-হয় নেননি। যদি নিয়ে থাকেন এবং দুটো ডোজই নেওয়া হয়ে গিয়ে থাকে তবে নিশ্চয়ই নিশ্চিন্ত বোধ করছেন এই ভেবে যে, আর ভয় নেই। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আর কোনও সম্ভাবনা নেই। সেই নিশ্চিন্ততা কতটা ঠিক তা বলা কঠিন, কারণ, টিকার দুটো ডোজ নিয়েও কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার খবরও যে আসছে না তা নয়। তবু টিকা নিয়ে আপনি কিছুটা নিশ্চিন্ত তো বটেই, কারণ, কোভিড প্রতিরোধ করতে পারে টিকা, এমন প্রচার আপনি বিভিন্ন সরকারি বিজ্ঞাপনে এবং গণমাধ্যমে শুনে আসছেন। কিন্তু কেউ যদি সেই সরকারি বক্তব্যকেই সন্দেহ করে? ইতিহাস বলে, টিকার বিরুদ্ধে জনমতের প্রধান কারণ সরকারকে বিশ্বাস করতে না পারা।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারকে বিশ্বাস করার যে খুব কিছু কারণ আছে তা নয়। সরকারি প্রচারের ঢক্কানিনাদ নিশ্চয়ই আপনার কানে এসে পৌঁছেছে যে, দেশের একশো কোটি মানুষ কোভিডের টিকা নিয়ে নিয়েছেন। এটি একটি নির্ভেজাল মিথ্যে কারণ একশো কোটি টিকার ডোজ দেওয়া আর একশো কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা এক ব্যাপার নয়। মনে রাখতে হবে, যদি দেশের তিরিশ কোটি মানুষ দুটো টিকা নিয়ে থাকেন তা হলে একটা টিকা নিয়েছেন মাত্র চল্লিশ কোটি মানুষ। আর তা হলে একশো তিরিশ কোটি মানুষের দেশে একটিও টিকা নেননি ষাট কোটি মানুষ। আর একটা মিথ্যে প্রচার হল টিকা দেওয়া হচ্ছে বিনি পয়সায় আর তার জন্য জায়গায় জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যানার লটকানো হয়েছে। কিন্তু একটু খবর নিলেই দেখবেন টিকা গ্রহণকারীদের একটা বড় অংশকেই নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করে টিকা নিতে হয়েছে। এর পরিমাণ এখন টিকাপিছু ৭৮০ টাকা। আর তথাকথিত বিনিপয়সার টিকার জন্যও আমজনতার কাছ থেকেই চটজলদি টাকা আদায় করা হয়েছে বিশেষ করে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়িয়ে।
এখন এই যদি হয় স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা তা হলে বুঝতেই পারছেন কী হাল হতে পারে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের সময়ে। সেখানে তো দস্তুরমতো সন্দেহ! প্লেগের টিকার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় পাঞ্জাবে শোনা গিয়েছিল এমন কথা যে, “সূচের সাইজ লম্বায় এক গজ, শরীরে ফোটালেই হয় মৃত্যু নয় বন্ধ্যাত্ব!” বসন্তের টিকার ক্ষেত্রে রটনা ছিল, “টিকার উদ্দেশ্য জাত-ভাঙানো, ধর্মনাশ করা”!
আরও পড়ুন : কৃষি আইন বাতিল রাজ্যে বিজয়োৎসব
কোভিডের টিকার ক্ষেত্রে এরকম প্রচার হয়তো এত প্রকট নয় তবে ইতি-উতি কান পাতলে যে প্রচ্ছন্নভাবে এমন কথা শোনা যায় না, তা-ও বলা যায় না। যাঁরা টিকা নেননি তাঁদের ‘যুক্তি’ এই যে, সাধারণত যতদিন ধরে পরীক্ষা করা হয়, বিশেষ করে ‘ক্লিনিকাল ট্রায়াল’ চলে, এই টিকার ক্ষেত্রে আদৌ তা করা হয়নি; চটজলদি টিকা উদ্ভাবন করা হয়েছে। স্বভাবতই অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে, এত তাড়াতাড়ি কীভাবে কোভিভ রোগের প্রতিষেধক টিকা উদ্ভাবিত হল? এই সন্দেহ করাটা যে অমূলক তা-ও বলা যায় না। কারণ, এর আগে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক উদ্ভাবন করতে কয়েক দশক সময় লেগেছে। সেটা মেনিনজাইটিস, হুপিং কাশি, পোলিও, হাম, হেপাটাইটিস বি সবের ক্ষেত্রেই সত্যি। এটা ঠিক যে, কোভিডের প্রতিষেধক এক বছরের কম সময়ে বের হয়ে গেছে কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এই সংক্রান্ত গবেষণা কোভিড অতিমারির প্রাদুর্ভাব হওয়ার পরেই শুরু হল। বস্তুত করোনা ভাইরাস নিয়ে চর্চা নতুন কিছু নয়। কোভিড-১৯ বা অভিনব করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিশ্ব জুড়ে শুরু হওয়ার দু’দশক আগে এই ধরনের ভাইরাস (ঠিক এই ভাইরাস নয়) নিয়ে গবেষণা চলছে যার সুফল আমরা পেয়েছি। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা যুক্ত ছিলেন যাঁরা তাঁদের গবেষণার ফল পরস্পরের মধ্যে আদানপ্রদান করেছেন। আর তার সঙ্গে যুক্ত ছিল বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের সক্রিয় সহযোগিতা। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যায় উনিশ শতকের প্রথম দিকে যখন গুটিবসন্তের টিকা উদ্ভাবিত হয়েছিল তখনও সাহায্য আর সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের প্রধানেরা। এই তালিকায় ছিলেন রাশিয়ার জার, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি, ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন প্রমুখ। নেপোলিয়ন, এডওয়ার্ড জেনার (১৭৪৯-১৮২৩) উদ্ভাবিত গুটিবসন্তের এই টিকা প্রথমে ১৮১২-তে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক করে দেন। পরে সমাজেও বাধ্যতামূলক করেন। তবে এর বাস্তবায়ন যে খুব সহজ হয়েছিল তা নয়।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। আমার ভালর জন্য প্রতিষেধক নেওয়ার কথা বলা হলেও আমার শরীরের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কতটা তাই নিয়ে প্রশ্ন বারবারই উঠেছে। আবার এটাও সত্যি যে, সরকারি উদ্যোগে টিকাকরণ ব্যবস্থা শুরু হলেও তা সবসময় সর্বত্রগামী হয়নি। ১৯৩৮ সালে এদেশে গুটিবসন্তের জন্য টিকাকরণ চালু হলেও তা মোটেই পৌঁছোয়নি গ্রামীণ অঞ্চলে। প্রশ্ন উঠেছিল, এই পরিষেবা কি শুধু এদেশের সাদা মানুষদের রক্ষা করার জন্য? আর এখানেই কোভিডের টিকার তাৎপর্য। গবেষকদের উদ্ভাবনের সুফল যাতে দেশের সকল মানুষের কাছে পৌঁছোয় সেজন্য এবার এগিয়ে এসেছেন সমাজের বিভিন্ন অংশ, তাতে যেমন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা আছেন তেমনই আছেন রাজনৈতিক ও সমাজকর্মীরা।