৫ সেপ্টেম্বর— সারা দেশ জুড়ে এই দিনটি ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এদিনটি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন। ১৯৬২ সালে তিনি ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর অনুরক্ত ছাত্ররা তাঁর জন্মদিন পালনে উদ্যোগী হলে, তিনি তাঁর জন্মদিনটিকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালনের পরামর্শ দেন। ১৯৬২ সাল থেকে ৫ সেপ্টেম্বর সারা ভারতে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ‘শিক্ষক দিবস’ কেন? ড. রাধাকৃষ্ণন একজন প্রথিতযশা শিক্ষক ছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পিতা-মাতার পরেই আমাদের জীবন গঠনে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জীবন-গঠনে ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে, আমাদের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জাগরণে আমাদের শিক্ষকদের ভূমিকার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই।
আরও পড়ুন-সিকিমের গভীর খাদে গড়িয়ে পড়ল গাড়ি, প্রাণ হারালেন ৪ সেনা জওয়ান
দিনের পর দিন এই মানুষগুলিই আমাদের মধ্যে আদর্শ ও মূল্যবোধের বীজ বপণ করে আমাদের অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করে আমাদের পূর্ণতার পথে এগিয়ে দেন। তাঁরা আলোর-পথের দিশারী। তাঁরা অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে আমাদের জ্যোতিসমুদ্রে উদ্ভাসিত করে তােলেন। শাস্ত্রে বলে যে, পিতৃঋণ, মাতৃঋণ, গুরুঋণ কখনও শেষ হয় না। তাই শ্রদ্ধেয় আচার্যদের কথা বারবার বলতে হয়। ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন প্রকৃত অর্থেই একজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁর সারা জীবনটিই আমাদের কাছে শিক্ষণীয়। তিনি বিপুল ধনৈশ্বর্য বা বিশেষ বংশমর্যাদার অধিকারী ছিলেন না। ১৮৮৮ সালে মাদ্রাজের একচি ছোট্ট শহরে এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত তেলুগু ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। ছাত্রজীবন কেটেছে খ্রিস্টান মিশনারি পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তাঁর দর্শন নিয়ে পড়াও এক আকস্মিক ব্যাপার। বিএ ক্লাসে ভর্তির সময় সদ্য বিএ পাশ করা এক জ্ঞাতি-ভ্রাতা তাঁর দর্শনের পাঠ্যবইগুলি রাধাকৃষ্ণনকে দেন। এ জন্যই তিনি বিএ-তে দর্শন নেন। এ ধরনের একটি মানুষ কেবলমাত্র নিজের উদ্যম, অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা ও অসাধারণ ধীশক্তির বলে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিকে পরিণত হন। অসাধারণ মেধার অধিকারী ড. রাধাকৃষ্ণনের পাণ্ডিত্য ছিল অবিসংবাদী। অতি অল্প বয়সেই বিশ্বের কয়েকটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর গ্রন্থাদি প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯২১ সালে মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে নিয়ে আসেন। এরপর তাঁকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। এ সময় তিনি ভারতীয় দর্শনের উপর গ্রন্থাদি লিখছেন, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন ও ভাষণ দিচ্ছেন। তিনি এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন অধ্যাপকে পরিণত হয়েছেন। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর প্রীতির সম্পর্ক ছিল। ‘মাই সার্চ ফর ট্রুথ’ গ্রন্থে তিনি বলছেন যে, তিনি সর্বদাই চেষ্টা করতেন তাঁর ছাত্রদের মধ্যে নীতিধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা বিস্তার করতে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, সত্য, সেবাধর্ম, অন্তর্দৃষ্টি এবং মানুষকে ভালবাসার প্রয়োজনীয়তার কথা যদি তরুণ মনে বা তাদের অন্তঃকরণে গেঁথে দেওয়া যায়, তাহলে কোনও লোভ বা প্রলোভন তাদের অধর্মের দিকে প্রলুব্ধ করতে পারবে না। তাঁর মতে অন্তরাত্মায় শক্তি ও তেজ সঞ্চয়ের জন্য প্রত্যেকের প্রতিদিন কিছুক্ষণ শান্ত ও সমাহিত যাপন করা একান্ত প্রয়োজন। প্রত্যেক ছাত্রের এটার প্রয়োজন আছে। এতে তারা নিজেদের অন্তরাত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে, নিজের বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারাকে সুসংহত করতে পারবে এবং নিজ ব্যক্তিত্বের পুনর্বিন্যাস খাটিয়ে আত্মোপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। তাঁর মতে এই শান্ত সমাহিত স্তব্ধতাই সব। এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে সব সৃষ্টির বীজ। তাঁর মতে প্রত্যেকের অন্তরেই আছে দেবমন্দির। এ মন্দির একান্তভাবেই আমাদের নিজেদের— এখানে অন্যের প্রবেশাধিকার নেই। দেবতা আমাদের হৃদয়ের মধ্যেই আছেন— এজন্য কস্তুরী-মৃগের মতো চারদিক ছোটাছুটি করার প্রয়োজন নেই।
শুধু কি অধ্যাপনা? আচার্য বেণীমাধব দাসের জ্যেষ্ঠা কন্যা, বিপ্লবী বীণা দাসের অগ্রজা কল্যাণী দাস (ভট্টাচার্য) তখন এমএ ক্লাসের ছাত্রী। তিনি তাঁর স্মৃতিকথা ‘জীবন অধ্যয়ন’-এ বলছেন যে, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ড. রাধাকৃষ্ণনের পৌরোহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আশুতোষ হলে’ বাংলার ছাত্রীদের প্রথম বিপ্লবী সংগঠন ‘ছাত্রী সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয় ।
আরও পড়ুন-আলোর সন্ধানে গিয়ে হেনস্থা ‘আলো’কেই
দেশ স্বাধীন হল। লৌহমানব স্ট্যালিন শাসিত রাশিয়ায় তিনি ভারতের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলেন। কোনও কূটনীতিক নন— এক বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক রাশিয়ায় গেলেন ‘ধর্মদূত’ হিসেবে। ভারতের আদর্শ প্রচারের জন্য যুগযুগ ধরে মুনি, ঋষি ও দার্শনিকরাই তো বহির্বিশ্বে গেছেন। হয়তো এ কারণেই ড. রাধাকৃষ্ণনের নিযুক্তি।
১৯৫২-৫৭ পর্যন্ত তিনি ভারতের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁকে রাজ্যসভার স্পিকারের দায়িত্বও পালন করতে হত। সভায় গোলমাল হলে তিনি গীতা ও সংস্কৃত কাব্যের শ্লোক ও বাইবেল থেকে আবৃত্তি করতেন। সভা শান্ত হয়ে যেত। প্রধানমন্ত্রী জওহরলালের মতে, ড. রাধাকৃষ্ণনের নেতৃত্বে রাজ্যসভার অধিবেশনগুলি যেন পারিবারিক বৈঠকে পরিণত হয়েছিল। ১৯৬২-তে ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলেন। বেতন মাসিক দশ হাজার টাকা। অধ্যাপক হিসেবে তিনি মাসে দু-হাজার টাকা নিতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি সেটাই নিতেন। সিমলা ছিল রাষ্ট্রপতির গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান। বিশাল এলাকা জুড়ে ব্যয়বহুল আয়োজন। ড. রাধাকৃষ্ণন সেই বাসস্থান উঠিয়ে দিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা করলেন এক গবেষণা কেন্দ্র— ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ’।
আরও পড়ুন-বার্ড ফ্লু : ওড়িশা থেকে মুরগি-ডিম আনায় নিষেধাজ্ঞা জারি
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে ‘দার্শনিক রাজা’ (Philosopher King)-র কথা বলেছেন। ন্যায়, সততা, সদাচার, মূল্যবোধ এবং সর্বদোষমুক্ত ব্যক্তিই সেই ‘দার্শনিক রাজা’। ড. রাধাকৃষ্ণন এই ‘দার্শনিক রাজা’র জাগ্রত প্রতিমূর্তি— আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ মানুষ ও ‘আদর্শ রাজা’।
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে আমি আমার সব শিক্ষকের চরণে প্রণতি জানিয়ে আমাদের শাস্ত্রমন্ত্র উচ্চারণ করে বলি—
‘গুরুর ব্রহ্মা গুরুর বিষ্ণু গুরুর দেবো মহেশ্বরহ / গুরু সাক্ষাত পরব্রহ্ম তসমই শ্রীগুরবে নমহ।