ভারতের ধর্ম ইতিহাসে বেশি জনপ্রিয় কৃষ্ণ। এক হাতে রাধারানিকে ধরে, অন্য হাতে বাঁশি-ধরা অনন্ত প্রেমিক। কৃষ্ণের জন্মতিথি হিসেবে পালিত হয় ভাদ্রমাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথি। ঠিক পনেরো দিন পরে শুক্লা অষ্টমী তিথিতে হয়েছিল রাধারানির জন্ম। উত্তরপ্রদেশের বারসানা গ্রামকে রাধার জন্মস্থান ধরা হয়। বৃষভানু ও চিত্রার কিংবা মতান্তরে কীর্তিদা-কন্যা রাধার জন্মতিথি পালন না করলে ভগবান কৃষ্ণ বলেই রেখেছেন জন্মাষ্টমী পালনের কোনও গুরুত্ব থাকবে না। তাই কৃষ্ণ প্রীত্যর্থে রাধাষ্টমী (Radhashtami) পালনে মনোযোগঃ।
শ্রীকৃষ্ণের হাতে যতদিন বাঁশি ছিল, সেই বাঁশির সুর শোনার জন্য পাশে ছিলেন রাধারানি। বংশীধর কৃষ্ণ পাশে রাধারানি, দেবমন্দিরের মূল বিগ্রহ। কিংবা বালগোপাল হাতে নাড়ু। যেদিন থেকে কৃষ্ণ মুরলী ছেড়ে হাতে নিলেন সুদর্শন চক্র, পাঞ্চজন্য সেদিন থেকে কৃষ্ণের দেবত্ব গেল, হয়ে উঠলেন এক প্রখর রাজনীতিবিদ, আর সর্বোপরি পাশ থেকে সরল রাধা। গল্পগাথায় পুরাণকথায় রাধাময় কৃষ্ণের বৃন্দাবন বেলা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এবং বৈষ্ণব পদাবলি মতে, শ্রীলক্ষ্মী রাধা হয়ে জন্মগ্রহণ করলে আয়ান ঘোষ তাঁর স্বামী হলেন। কিন্তু ভগবানের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী তাঁকে নপুংসক হতে হল। আয়ান ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পালিকা মা যশোদার তুতোভাই। অর্থাৎ কৃষ্ণের মামা। রাধা আকৃষ্ট হলেন কৃষ্ণের বাঁশিতে, আক্রান্ত হলেন তাঁর হাসিতে আর দৈব চক্রান্তে গড়ে উঠল এক অমর প্রেমকথা, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা।
ক্রমে কৃষ্ণময় হয়ে উঠল রাধার জীবন। কৃষ্ণ বাঁশি বাজালে রাধা যেকোনও কাজ ফেলে ছুটে আসেন কৃষ্ণের পাশে। কৃষ্ণ-প্রেমে রাধা হন কলঙ্কিনী, পাগলিনী। কৃষ্ণ মিলনের তরে কুঞ্জ সাজিয়ে অপেক্ষা করেন রাধা। ছলনাময় কৃষ্ণ যান চন্দ্রাবলির কুঞ্জে। মানিনী রাধার দুর্জয় মান আবার সেই মানভঞ্জনের পালায় কৃষ্ণ রাধার পায়ে ধরে বলেন দেহি পদপল্লবমুদারম। পালা বদলের সময় আসে অক্রুরের রথ হয়ে কৃষ্ণকে তাঁর কর্মভার চিনিয়ে দিতে। বাঁশির সুর বদলে যায় অস্ত্রের ঝনঝনানিতে, বৃন্দাবনচন্দ্র হয়ে ওঠেন দ্বারকাধীশ। আর রাধা তখন কোথায়?
রাধা গেলেন কোথায় এই প্রশ্নের আগে উঠে আসে এক গভীর প্রশ্ন, রাধা ছিলেন কোথায়?
শ্রীকৃষ্ণের জীবনের তিনটি প্রামাণ্য গ্রন্থ— ভাগবত, মহাভারত, হরিবংশ : এই তিন গ্রন্থেই কোথাও রাধা নেই। বিষ্ণুপুরাণে নেই। কিন্তু ভারতীয় দর্শনের এক অন্যতম স্তম্ভ হিসাবে রাধাকে তো আসতেই হবে— মেলাতে হবে অনেক জটিল তত্ত্ব। তিনি পদ্মপুরাণে লক্ষ্মী, মৎস্যপুরাণে মহাদেবী কিংবা ভাগবতে মহাগোপী হলেও স্বনামে এলেন সর্বপ্রথম আংশিক ভাবে গাথাসত্তসঈতে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে, পূর্ণভাবে এলেন বঙ্গের কবি জয়দেবের লেখনীতে— গীতগোবিন্দমে। রাধার আবির্ভাব কাব্যে। তিনি এলেন, গাঁথলেন এক অপূর্ব প্রেমমালা তিনটি ফুলকে একসূত্রে নিয়ে : ভক্তিমার্গ, অদ্বৈত বেদান্ত আর সাংখ্যদর্শন।
সুগভীর রাধা তত্ত্বে কৃষ্ণের প্রেমিকা রাধা। এক বিশেষ কোনও মানবী বা দেবী নন। যিনি কৃষ্ণপ্রেমে জগৎ কৃষ্ণময় দেখেন, যিনি কৃষ্ণের জন্য জগৎ সংসার লাজলজ্জা সব কিছু ছাড়তে পারেন তিনিই প্রকৃত কৃষ্ণ আরাধিকা— রাধিকা— রাধা। তিনি শ্রীমতী, তিনি পুরুষ হোন বা নারী, কালো হোন বা ধলো, কৃষ্ণ-লাগি যিনি সর্বদা প্রেমবিহ্বল তিনিই রাধা। তাই তিনি ধর্মের দায় ঘাড়ে নিয়ে বসে নেই, তাঁকে খুঁজে পাবে মানুষের মনে, মানুষের সাধনায়।
বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা : মধুর ভাব এক সাধনতত্ত্ব। যেখানে সাধক মাত্রেই নারী, ঈশ্বর ওরফে কৃষ্ণ হলেন পরমপুরুষ। এখানে সাধক আরাধিকা বা রাধিকা বা রাধা। সাধক যখন তার সব কিছু কায়, মন, বাক্য, লজ্জা, ভয় সব— ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে পারেন তখনই তিনি হয়ে ওঠেন শ্রীমতী বা রাধা। সর্বভূতে তিনি দেখেন ঈশ্বর, যেভাবে সমস্ত কৃষ্ণকায় কৃষ্ণ হয়ে ওঠে। সর্বকথা হয়ে ওঠে ঈশ্বরকথা, যেমন সমস্ত আহত অনাহত ধ্বনি হয়ে যায় কৃষ্ণের বাঁশির সুর। ভক্তিযোগী সাধক সব মায়া, মোহ ও সমাজবন্ধনের পাশ কাটিয়ে তাঁর প্রেমে মাতোয়ারা হন, তাতেই লীন হন।
আরও পড়ুন: আন্দোলন হোক, কিন্তু বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু মানা যায় না
এর পর অদ্বৈত বেদান্ত। যেখানে জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন সেখানে ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’। রাধা জীবাত্মা, কৃষ্ণ পরমাত্মার প্রতীক— এক এবং অভিন্ন। জীবের উদ্দেশ্য অন্তরে পরমাত্মার সন্ধান— মিলন। যতদিন না সে আত্মজ্ঞান লাভ করে, নিজের মধ্যেই ব্রহ্মকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে, ততদিন চলে তার সাধনা। তাই রাধা মেলেন কৃষ্ণের সাথে, মিলনের মাধ্যমেই সমাপন হয় রাধা-কৃষ্ণ লীলা।যেন মহারাসের পর রাধা-কৃষ্ণের মিলন। এর পর সাংখ্যদর্শন। এখানে চলে প্রকৃতি তত্ত্ব। প্রকৃতি থেকে জাত জীবকুল, প্রকৃতিতেই লয়। যেখানে সারা উত্তর ভারত আর্যাবর্ত হয়ে বেদান্ত দর্শনে আচ্ছন্ন, তার বহু পূর্বেই বাংলা তার নিজস্বতায় ফলিয়েছে দর্শনের সেরা ফসল। উত্তর ভারতের আর্যগন্ধী ব্রাহ্মণ্যবাদী রা তার মূল রচনাবলি নষ্ট করেছে, কিন্তু হারাতে পারেনি। সমগ্র বেদে ইন্দ্র, বিষ্ণু, বরুণ, রুদ্রাদির প্রভাবে, মাতৃমন্ত্র হয়েছে সংক্ষিপ্ত কিংবা বলা যায় প্রক্ষিপ্তও সেখানে প্রকৃতির উপাসক কপিলের বাংলা আচ্ছন্ন থাকে প্রকৃতির উপাসনায়, মাতৃপূজায়। সমগ্র ভারতে কৃষ্ণ যখন একাধিপতি তখন বাঙালি কবি জয়দেব কৃষ্ণের আগে আনলেন শ্রী, শ্রীমতী বা রাধা। মাতৃপূজা সম্পন্ন হল, মাতৃশক্তি পেল প্রাধান্য। এভাবেই এগোল ত্রিবেণীধারা।
শ্রীরাধিকা কৃষ্ণসাধনার প্রাণ। সাধকের অপর নাম রাধা। তাই দেখি কখনও নদের নিমাই, কখনও শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবের ঘোরে রাধা হয়ে ওঠেন।
রাধাতত্ত্বের পর আসবে কৃষ্ণপ্রীতির উদ্দেশ্যে রাধাষ্টমী (Radhashtami) ব্রত পালনের কথা। একবার দেবর্ষি নারদ জানতে চাইলেন শ্রীকৃষ্ণের কাছে, শ্রীরাধা অর্চনার পদ্ধতি। একদা সূর্যদেব এক গুহায় কঠোর তপস্যায় বসেন। পৃথিবী অন্ধকার সূর্য বিহনে। শ্রীকৃষ্ণ প্রীত হয়ে সূর্যদেবকে বর দিতে চাইলে, শ্রীকৃষ্ণ যার বশীভূত থাকবে এমন এক সর্বগুণবতী কন্যা প্রার্থনা করেন সূর্যদেব। শ্রীকৃষ্ণ কাল-পরম্পরায় মথুরায় জন্ম নিয়ে বৃন্দাবনে আনীত হলেন। সূর্যদেব বৈশ্যকুলে জন্ম নিলেন বৃষভানু রাজা হয়ে। বিবাহ হল গোপকন্যা কীর্তিদার সাথে। ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে বিশাখানক্ষত্রে কীর্তিদার গর্ভে জন্ম নিলেন শ্রীমতী রাধা। আয়ান ঘোষের সাথে রাধার বিবাহ হলেও, রাধা হলেন পরম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি— কৃষ্ণের বিনোদিনী।
শ্রীরাধার জন্মতিথিতে নানা প্রকার ফুল, গন্ধদ্রব্যাদি, ধূপ, দীপ, খাদ্যদ্রব্য, ফলমূল, বসনভূষণ দ্বারা শ্রীমতী রাধার পুজো করে, নানা রকম উৎসব, ক্রীড়া, কৌতুকে রাত্রি জাগরণ করতে হয়। পরের দিন পারণ। শ্রীরাধার নাম নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ নাম নিলে তবেই যাবতীয় মন্ত্র-জপ সার্থক হয়। সারা ভারতে বিশেষত উত্তরপ্রদেশে রাধাষ্টমী (Radhashtami) মহাধুমধামের সাথে পালিত হয়।
এবার সার কথা, কৃষ্ণভক্তির নামই রাধা। তাই কৃষ্ণভক্তেরা আগে রাধাভক্তি অর্জন করবেন তার পর মহামায়া দয়া করে দ্বার উন্মুক্ত করবেন কৃষ্ণপ্রেমের। এ-এক মহারাস দেহাতীত অঙ্গসুখ কিংবা সঙ্গসুখ। ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমীতে রাধা অষ্টমী পালন করে মনকে করতে হবে রাধাময় তবেই তো ধরা দেবেন বৃন্দাবনচন্দ্র। সারা বেলা উপবাস, নামকীর্তন, সন্ধ্যায় পুজো, ভোগ নিবেদন আর নিজেকে সমর্পণের মাধ্যমে পালিত হোক রাধাষ্টমী। ভক্তি আর আত্ম নিবেদনে সবাই হয়ে উঠি প্রকৃত আরাধিকা— শ্রীমতী রাধিকা।
ভক্তিতে যদি পড়ো বাঁধা
তুমিও রাধা আমিও রাধা।