সাবির মল্লিককে (Sabir Mallick) হরিয়ানার গোরক্ষক বাহিনী পিটিয়ে মেরেছে গরুমাংস খাওয়ার সন্দেহে।
মহারাষ্ট্রের এক বৃদ্ধ পিতা তাঁর মেয়ের জন্য মাংস রান্না করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। গরুর মাংস সন্দেহে বৃদ্ধর ছেলের বয়সিরা লাথি-চড় মেরে জখম করে একটা চোখ নষ্ট হবার জোগাড় হয়েছে।
আরিয়ান শর্মা জাতিতে হিন্দু ব্রাহ্মণ হলেও গোরক্ষকরা তাকে পিটিয়ে মেরেছে। কারণ তাদের কাছে আরিয়ান নামটা মুসলিম ছাড়া হতেই পারে না।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। হঠাৎ করে সন্দেহের বশে করা ভুলও নয়। গোবলয় অর্থাৎ তথাকথিত হিন্দি বেল্টে হিন্দু উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রয়েছে যারা নিজেদের গোরক্ষক বলে।
গরুর জীবনযাত্রার কতটা উন্নতি হয়েছে জানি না কিন্তু কোনও মুসলিম যদি গরুর মাংস খেয়েছে, ফ্রিজে মাংস রেখেছে কিংবা গরু কেনাবেচা করেছে সেই সন্দেহ যদি একবার হয় এরা সেই ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে দুবার ভাবে না। বলতে কোনও দ্বিধা নেই, কেন্দ্রের সরকারে বিজেপি আসার পর থেকে এই হত্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতেও গরু ছিল। মাকে দেখেছি গরুকে খুব যত্ন করতে। আবার দু-একটা গ্রাম পরে কোরবানির ইদে গরু কেটে গোটা গ্রামে মাংস বিলি করতেও দেখেছি। এখনও সেই ধারা বাংলায় রয়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। যারা যেটা খায় সেটা তাদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়। আমিও একসময় সস্তায় পুষ্টিকর বলে গোমাংস খেয়েছি। এমনিই খেয়েছি। আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ভাবছি একথা জানলে এমপি, ইউপি, হরিয়ানার লোকজন কোনদিন না আমায় পিটিয়ে মারে!
সংবিধান স্বীকৃত ভারতীয় আইনে কিছু মৌলিক অধিকার আছে যার মধ্যে রয়েছে এই খাদ্যাভ্যাস। কে কী খাবে সেটা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত রুচি। সেখানে কারও খবরদারি চলে না। কথায় আছে, আপ রুচি খানা… ছাগল, হাঁস, মুরগি, মাছ, আরশোলা, টিকটিকি, সাপ, ব্যাং, কুকুর, ইঁদুর ইত্যাদি গোটা বিশ্বে মানুষ খায়। তাই বলে কি কুকুর-ছাগল হাঁস-মুরগি মানুষ পোষা ছেড়ে দিয়েছে? এমনকী আমি শুনেছি আমাদের বেদেও একসময় গোমাংস খাওয়ার উল্লেখ রয়েছে। তাহলে শুধু গোমাংস খেলেই এত সহিংসতা কেন? অথচ গোমাংস রফতানিতে ভারত কিন্তু দুনিয়ার মধ্যে দ্বিতীয়।
আরও পড়ুন: বন্দেশৈল সুতাসুতং গণপতিং
সাবিরকে পিটিয়ে মারার ভিডিওটি দেখে শিউরে উঠেছিলাম। কতটা চেতনাহীন হলে তবেই একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষকে এইভাবে মারা যায়? হ্যাঁ, মারা যায়। একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের প্রতি পুষে রাখা ঘৃণা আজ এতটাই ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে যে, মুসলিমদের মতো নামের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছে বলে স্বধর্মের ব্যক্তিকেও হত্যা করতে দুবার ভাবেনি এই গোরক্ষা বাহিনী।
এই গণপিটুনির যুক্তি হিসাবে শুনি, গরু ওদের কাছে মায়ের মতো। সেই মাকে কেটে মাংস খাওয়া অর্থে ওদের ভাবাবেগকে ধাক্কা দেওয়া। এরকম অদ্ভুত যুক্তি কী করে হয় আমি ভেবে পাই না। যে কারণে আরিয়ানের মায়ের কাছে গোরক্ষকরা ক্ষমা চাইতে গেলে তার মা বলেন, ওকে তোমরা শুধু মুসলিম নাম শুনে মেরে ফেললে? …একজন সন্তানহারা মায়ের এই প্রশ্নে মানবিক ভাবাবেগে আঘাত এল না তবুও।
দুর্ভাগ্য, বাংলা ছাড়া সারা দেশ জুড়েই চলছে ধর্মীয় আবেগ দিয়ে তীব্র মেরুকরণের কৌশল। যার মধ্যে এই গো রক্ষা করার নামে সর্বাগ্রে মুসলিম ও দলিতদের পিটিয়ে মারার মাধ্যমে এই শ্রেণিটির প্রতি ঘৃণার চাষ করা চলছে।
মূল বিষয়টা গরু নয়। ওটা একটা বাহানা। আসলে মুসলিম ও দলিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি উচ্চবর্ণের মানুষের বিদ্বেষকে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে অত্যাচার করাটাই আসল উদ্দেশ্য। বিজেপি তথা আরএসএস নামক হিন্দুত্ববাদীদের এটাই অ্যাজেন্ডা। এভাবেই নাকি হিন্দুরাষ্ট্র হবে!
ধর্মের এই ধামাধরা ধারণার জন্য ইউসুফ খান তথা দিলীপকুমার, মুমতাজ জাহান তথা মধুবালা, মেহজাবিন বানো তথা মীনাকুমারীর মতো দিকপাল বলিউড স্টাররা পর্যন্ত তাঁদের মুসলিম নাম ব্যবহার করতে পারেননি! ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকার দৌড়ে হিন্দু নামেই পরিচিত আজও তাঁরা। আজও কিন্তু বহু শহরে মুসলিম পড়ুয়াদের হিন্দুবাড়িতে বা পাড়ায় ঘরভাড়া দেওয়া হয় না। এমনকী নিষিদ্ধপল্লিতে মুসলিম মেয়েরা তাঁদের মুসলিম নাম লুকিয়ে হিন্দু নাম বলেনং। এই গোঁড়ামি নতুন নয়। হ্যাঁ, বর্তমানে বিজেপির শাসন বলেই তারা এই কট্টরতাকে দেশের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছে। জানি না এর শেষ কোথায়?
সাবিরের মর্মান্তিক ঘটনার পর আমাদের মুখ্যমন্ত্রী ওঁর স্ত্রী ও মেয়েকে নবান্নে ডেকেছিলেন। নানান অফিসিয়াল কথাবার্তার মাঝে ছোট্ট মেয়েটি ঘুরে ঘুরে ঘরে থাকা অ্যাকোয়ারিয়ামের ভিতর থাকা রঙিন মাছগুলোর সামনে চলে যাচ্ছিল। ওগুলো যে মাছ সেটা ও জানে কিন্তু এমন রঙিন আগে কখনও দেখেনি। মুখ্যমন্ত্রী সেটা লক্ষ্য করে ওকে আদর করে ডেকে মাছগুলোর নাম বলে বলে দিচ্ছিলেন।
ছবিগুলো তোলার সময় শুধু মনে হচ্ছিল, অভাগা মেয়ে জানতেই পারল না তারই জন্মভূমিতে একদল মানুষের মতো দেখতে হিংস্র জানোয়ার তার মাথার উপর থেকে বাবার স্নেহ কেড়ে নিয়েছে শুধু মুসলিম বলে। দেশ জুড়ে মানবিক অবক্ষয়ের মাঝে এই মানবিক ছবিগুলোই অক্ষয় হয়ে থাকুক।
ভাবতে ভাল লাগে, এই ধর্মান্ধতা একমাত্র আমাদের বাংলাতেই নেই। বাঙালি কোনও দিনই জাতি-ধর্ম ভেদাভেদ নিয়ে মাথাব্যথা করেনি। একে অপরের সঙ্গে পাশাপাশি বাস করা ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান এখানে কোনও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
দেশভাগের যন্ত্রণা সবথেকে বেশি পেয়েছে আমাদের বাংলা। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলাতেই ঘৃণা একে অপরের প্রতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এ-জাতি চেতনার উন্মেষ ঘটায় বারেবার শিক্ষায় দীক্ষায় সংস্কৃতিতে। তাই আজ ভারতের মহামানবের সাগরতীর বলতে আমার বাংলাই ধরে রেখেছে কবির বাণী…
‘‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
হেথায় দ্রাবিড়, চীন—
শক-হুন-দল পাঠান মোগল
এক দেহে হল লীন।”