সাবির মল্লিকের বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাসন্তীতে। বয়স ২৪। স্ত্রী ও দু’বছরের কন্যাসন্তান রয়েছে তাঁর। হরিয়ানায় পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন সাবির। সাবির ছিলেন ময়লাকুড়ুনি। কাগজ, প্লাস্টিকের জিনিসপত্র কুড়িয়ে, লোকের বাড়ি থেকে পুরনো জিনিস জোগাড় করে দোকানে কিলোদরে বিক্রি করতেন তিনি। হতদরিদ্র, প্রান্তিক মানুষ সাবির আমাদের রাজ্যেরই এক বাঙালি সংখ্যালঘু সহনাগরিক। গত ২৭ অগাস্ট হরিয়ানার চরখি-দাদরি গ্রামে বিজেপির উন্মত্ত গো-রক্ষক বাহিনী প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে খুন করেছে সাবিরকে। অভিযোগ, তিনি নাকি গোমাংস রান্না করে খেয়েছিলেন।
২০১৪ সালে হরিয়ানায় বিজেপি সরকার আসার পর থেকেই সরকারি টাকায় গ্রামে গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে সশস্ত্র ‘গো-রক্ষক বাহিনী’। যাদের কাজ এলাকার পর এলাকা জুড়ে সংখ্যালঘুদের সন্ত্রস্ত রাখা ও তাদের খাদ্যাভ্যাসের উপর নজরদারি চালানো। এরা সরকারি গাড়িতে চড়েই দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় গ্রামে গ্রামে। গত এক দশকে রাজস্থান, গুজরাত, হরিয়ানায় একের পর এক পিটিয়ে মারার মতো ঘটনা ঘটেছে এদের হাতে। এরা সরকারি টাকায় পোষিত এক দুষ্টচক্র, যাদের কাজ হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে সংহত করার নামে ভয়ের বাতাবরণ কায়েম করা।
সাবিরকে ওরা আগে থেকেই টার্গেট করেছিল। পাঁচজন গো-রক্ষক সাবিরকে প্লাস্টিকের বোতল বিক্রির ছুতোয় ডেকে পাঠায়। তাকে নির্মমভাবে পেটাতে থাকে তারা। একইসঙ্গে এই হত্যাদৃশ্যের লাইভ ভিডিও করা হতে থাকে। পুলিশ যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে তাদের মধ্যে দু’জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। ঘটনার পর হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী নায়াব সিং সাইনি জানিয়েছেন, ওই গো-রক্ষকদের ‘গোমাতা’র প্রতি ভক্তি ও আবেগ ছিল গভীর। সম্ভবত তাই তারা এরকম ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। স্পষ্টতই, তাঁর সহানুভূতি ও সমর্থন এই খুনিদেরই প্রতি। বোঝাই যাচ্ছে আসন্ন বিধানসভা ভোটে অনিবার্য হার এড়াতে উগ্র হিন্দুত্বের মেরুকরণের রাজনীতি এটি।
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর আজ প্রশাসনিক মেগাবৈঠক হবে নবান্নে
কলকাতার আরজি কর হাসপাতালে ৯ অগাস্ট ভোরে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুন করা হয় এক তরুণী ডাক্তারকে। এই ঘটনায় এ অবধি উত্তাল কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জনপদ। ধর্ষক-খুনি সঞ্জয় রাইকে কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। হাইকোর্টের রায়ে গোটা ঘটনার তদন্তে এখন সিবিআই। সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে পুরো তদন্তপ্রক্রিয়া এগোচ্ছে। ১৪ অগাস্ট রাতে যা ছিল ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ নামক স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ, তিনসপ্তাহ গড়াতে না গড়াতেই আজ বোঝা যাচ্ছে অত্যন্ত চতুর ও কৌশলী রাজনৈতিক আন্দোলনের নীল নকশা তৈরি হয়েছে বাংলায়।
এই আন্দোলনের নেতৃত্বে মার্কসবাদী বিজেপি আর মনুবাদী রাম মিলেমিশে গিয়েছে। তেরো বছর ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা বামেদের অতৃপ্ত আত্মা এইবার মরীয়া হয়ে মাঠে নেমেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সদ্য লোকসভা নির্বাচনে ২৯টি আসন ও প্রায় ৪৯ শতাংশ ভোটে জিতে আসা তৃণমূল সরকারকে উৎখাত করতে। যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হাত মিলিয়েছে এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লড়াইয়ে। সঙ্গে রয়েছে গোদি মিডিয়া ও বিজেপি-সিপিএমের শক্তিশালী আইটি সেল। প্রত্যেকদিন দুপুর থেকে মাঝরাত অবধি কলকাতার রাস্তা অচল করে দেওয়া একের পর এক মিছিল ও গণ-অবস্থান। বামেরা বিধানসভা ও লোকসভায় শূন্য হয়ে গিয়েছে। তাদের ভোট নেমে গিয়েছে ৫ শতাংশেরও নীচে। কিন্তু তাদের এই সুপরিকল্পিত সরকার-বিরোধী নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টায় নতুন করে অক্সিজেন দিতে নেমে পড়েছে রাজনৈতিক শকুনরা।
জুনিয়র ডাক্তারের ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাইছেন শাসক-বিরোধী সকলেই। এই জাস্টিস অত্যন্ত বেশিমাত্রায় কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু এই বাংলারই আরেক সহনাগরিক সাবির মল্লিকের নৃশংস হত্যার বিরুদ্ধে একটিও মোমবাতি মিছিল বেরোল না কেন এখনও অবধি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাবিরের স্ত্রীকে সরকারি চাকরি দিয়েছেন। অথচ আজ অবধি বাম-বিজেপির একজনও নেতা-নেত্রী সাবিরের বাড়িতে পৌঁছে উঠতে পারলেন না। কেন বলুন তো?
এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে রয়েছে এই মুহূর্তের সরকার-বিরোধী আন্দোলনের শ্রেণিচরিত্র ও তার অভিমুখ। কারা দিনের পর দিন শহরের প্রাণকেন্দ্রগুলো অচল করে, গোটা শহরকে যানজটে অবরুদ্ধ করতে চাইছে? পুজোর আর মাত্রই একমাস বাকি। কাদের জন্য মাথায় হাত পড়েছে ফুটপাথের দোকানদারদের, যাঁদের গোটা বছরের রোজগারের অর্ধেকটাই হয় এই সময়ে? কাদের জন্য শহরের এ-মাথা ও-মাথা প্যাসেঞ্জার নিতে পারছেন না পরিবহণকর্মী ট্যাক্সি, ওলা-উবের-ইন ড্রাইভ-যাত্রীসাথীর ড্রাইভাররা? কোন ডাক্তারদের অসহযোগিতার জন্য এ অবধি শুধু কলকাতাতেই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে দশজনের? তাঁরা আর কেউ নন, এই শহরের মাস-গেলে-মোটা-টাকা-বেতন পকেটে ঢুকে যাওয়া কালচারাল এলিটকুল, যাঁরা মার্কস আর মনুসংহিতার ভিতরকার দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ ঘুচিয়ে দিয়েছেন বহুকাল আগেই। যাঁরা মনেপ্রাণে গরিব, নিচুতলার মানুষকে ঘৃণা করেন।
যারা নিজেদের সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকে কায়েম রাখতে চায় প্রত্যেকটা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অফিসে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নিচুতলার নন-প্রিভিলেজড মানুষজনের যে উত্থান ঘটেছে গত দেড় দশকে, তা এদের আসন টলিয়ে দিচ্ছে। তাই সাবির এদের কাছে ভিনগ্রহের জীব। সাবিরের জন্য কোনও শোক প্রকাশ করবে না এরা। এই এলিট বামপন্থী প্রাণীরা রাজ্যের গরিব সংখ্যালঘু মানুষকে আপনজন বলে মনে করে না। ‘রাতদখল’ নয়, এদের আসল উদ্দেশ্য একটি নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে নিজেদের হৃত আসন দখল করা। এবং সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এমনকী বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তির হাত ধরতেও আপত্তি নেই তাদের। রাম-বাম জোটের এই এলিট অংশ আজ বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই এদের বিরুদ্ধে পাল্টা যুদ্ধে নামার সময় এগিয়ে এসেছে আজ।