বস্তুত নিশাচর বাদুড় চোখে দেখতে পায় না। বাদুড় একটি তরঙ্গ উৎপন্ন করে এবং ওই তরঙ্গ কোথাও প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসার চরিত্র নির্ণয় করে চলাফেরা ও খাবারের সন্ধান করে। সমুদ্রে খারাপ আবহাওয়া বা ঘন কুয়াশার সময় দুটি জাহাজের মধ্যে দূরত্ব জানবার জন্য ১৯০৪-এ ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স থেকে জার্মান বৈজ্ঞানিক ক্রিস্টিয়ান হালসময়ের একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র আবিষ্কার করেন। যন্ত্রটিও একটি বৈদ্যুতিক সঙ্কেত পাঠিয়ে ও প্রতিফলিত তরঙ্গ গ্রহণ করে ৫ কিলোমিটার এর মধ্যে কোনও বস্তু থাকলে বলে দিতে পারত। কিন্তু দূরত্ব মাপতে না পারায় যন্ত্রটির ব্যবহার বন্ধ হয়। এখান থেকেই অক্টোবর ১৯১৯ (বলাই বাহুল্য, ১৯১৩ সালে বেতার যন্ত্র আবিষ্কারের পর) বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে প্রকৃত রেডার যন্ত্র আবিষ্কার হয়। যদিও রেডিও ডিটেকশন অ্যান্ড রেনজিং এককথায় রেডারের সাহায্যে ১৯৩৫-এর মে মাসে ওয়াটসন-ওয়াট, উইলকিন্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বিমানের গতিবিধি নির্ণয় করে দেখান। তখনও ধরে নেওয়া হয়েছিল এই রেডার কেবলমাত্র ধাতব পদার্থকেই সন্ধান করতে পারবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রেডারে দেখা যায় বিমান কখনও কখনও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গবেষণা করে জানা যায় এই অদৃশ হওয়ার কারণ আকাশে বৃষ্টি ও বজ্রগর্ভ কিমুলনিম্বাস মেঘের উপস্থিতি। এবং ১৯৫৩ সালে বৈজ্ঞানিক ডোনাল্ড স্ট্যাগগস প্রথম দেখান ঝড়ের ঘূর্ণনের (মাছ ধরার বঁড়শির মতো হুক) ছবি। বস্তুত ১৯৬১-এর পর রেডারের সাহায্যে আবহাওয়ার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ শুরু হয়।
আরও পড়ুন-অভিষেক সঠিক, জবাব দিলেন বিক্রমের মা
রেডারের প্রকারভেদ
প্রাইমারি রেডার যন্ত্রটি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ পাঠিয়ে তা কোনও বস্তুতে ধাক্কা লেগে প্রতিফলিত (বিক্ষিপ্ত) হয়ে আসা সঙ্কেত গ্রহণ করে (বাদুড়ের মতো) অনুসন্ধান করে। সেকেন্ডারি রেডার যন্ত্রটি কোনও তরঙ্গ প্রেরণ করে না কিন্তু বস্তুর থেকে নির্গত নানা রকম কম্পাঙ্ক-নির্ভর সঙ্কেত যেমন তাপ, বিকিরণ ইত্যাদি সংকেত গ্রহণ করে অনুসন্ধান করে। দুটি বস্তুর আপেক্ষিক গতি ও কম্পাঙ্ক সংক্রান্ত ডপলার সূত্র প্রয়োগ করে দূরের জাহাজ, মেঘ, ক্ষেপণাস্ত্র অথবা বিমানের অবস্থান ও বেগ নির্ণয় করা হয়। সাধারণ রেডার বস্তুর দূরত্ব এবং অবস্থান জানার জন্য প্ল্যান পজিশন ইনডিকেটর (PPI) এবং দূরত্ব আর উচ্চতা জানার জন্য রেঞ্জ হাইট ইনডিকেটর (RHI) ব্যবহার করে। আধুনিক ডপলার রেডার এই দুই ফলাফল একই সঙ্গে উপস্থাপন করে। উপরন্তু মেঘ বা বিমান কোনদিকে যাচ্ছে তাও বলে দিতে পারে। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের কম্পাঙ্কের উপর নির্ভর করে রেডারের নানা ধরনের উপযোগিতা পাওয়া যায়। L ব্যান্ড রেডার (তরঙ্গ দৈর্ঘ ২৩ সেন্টিমিটার) বিমান সন্ধানের জন্য, S-ব্যান্ড রেডার (তরঙ্গ দৈর্ঘ দশ সেন্টিমিটার) বৃষ্টিপাতের মেঘ, X ব্যান্ড রেডার (তরঙ্গ দৈর্ঘ তিন সেন্টিমিটার) বজ্রপাতের মেঘ ও বজ্রপাত, টর্নেডো, C-ব্যান্ড রেডার বৃষ্টি ও বজ্রপাত-সহ মেঘভাঙা বৃষ্টি শনাক্ত করতে পারে Ku ব্যান্ড রেডার (তরঙ্গ দৈর্ঘ দুই সেন্টিমিটার) বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি ভালভাবে শনাক্ত করতে পারে।
আরও পড়ুন-আরজি করে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে রাজনীতি বরদাস্ত নয় : সুপ্রিম কোর্ট
রেডারের ব্যবহার
বর্তমানে ইন্ডিয়া মিটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ৩৯টি রেডার আছে। একটি রেডার আছে কলকাতার নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং (মিলেনিয়াম পার্কের বিপরীতে)-এর ছাদে। দূর থেকে অথবা হাওড়ার দিক থেকে দেখলে সহজেই চেনা যায়। সুবিশাল প্রায় কুড়ি ফুট বাসের একটি সাদা ফুটবলের মতো রাডোম। এই রাডোম-এর মধ্যে একটি ১৪ ফুট ব্যাসের বিশাল কড়াইয়ের মতো অ্যান্টেনা সবসময় ঘুরতে থাকে। এটি একটি দামি (প্রায় দশ কোটি টাকা) যন্ত্র। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দেখা উচিত। মাটি থেকে প্রায় ১৩০ ফুট উঁচুতে হওয়ায়, প্রায় ৫০০ কিমি দূরের মেঘের ছবি নিতে পারে। সাইক্লোনের ল্যান্ডফল কোথায় হবে, নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারে। এই রেডারগুলি বেশিরভাগ সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলে ২৫০ কিমি বাদে বাদে রাখা হয়েছে, যাতে কোনও সাইক্লোন কখনওই নজরের বাইরে না যায়। তিন ঘণ্টার মধ্যে কোথায় কখন বজ্রপাত হবে সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়। এই কারণে দমদম এয়ারপোর্টে এই তথ্য খুব দরকার। এই জন্য এখন প্রতিটি বড় যাত্রিবাহী বিমানের নাকের কাছে (রং কালো করে দেওয়া অংশের ভিতর) Ku-ব্যান্ড রেডার লাগানো থাকে। এই রেডারে শুধু সামনের দিকের অংশই দেখা যাবে। মনে রাখতে হবে, কম্পাঙ্ক যত বেশি হবে বা তরঙ্গ দৈর্ঘ যত ছোট হবে, অ্যান্টেনার ব্যাস তত ছোট হবে। বর্তমানে মেঘভাঙা বৃষ্টি ঘন ঘন হচ্ছে, তাই হিমাচল প্রদেশে একটি C-ব্যান্ড রেডার বসানো হচ্ছে। আমেরিকাতে উত্তর দিক থেকে অহরহ ভয়ানক বিধ্বংসী টর্নেডো আছড়ে পড়ে। তাই সেখানে ১০০ কিমি বাদে বাদে জালের মতো আবহাওয়া রেডার বসানো আছে। প্রতিটি জাহাজে নজরদারি রেডার সোহো আবহাওয়া রেডার সবসময় ব্যবহার করা হয়। সমুদ্রে ঝড়বৃষ্টি, কুয়াশা ইত্যাদি ক্ষেত্রে খুব কাজে লাগে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
বিভিন্ন গবেষণা
বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা আকস্মিক বন্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। শত শত মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। রেডারের সাহায্যে মেঘের উপস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খ গণনা করে ওই মেঘ থেকে কতটা বৃষ্টি হতে পারে তার আন্দাজ করা যায়। নানা রকম গাণিতিক মডেলের সাহায্যে আকস্মিক বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। বৈমানিকেরা সবথেকে বেশি ভয় পায় ক্লিয়ার এয়ার টার্বুলেন্সকে। যা চোখে দেখা যায় না, এখনও কোনও যন্ত্রের সাহায্যে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তবে এর জন্য আবহাওয়ার নানা রকম অবস্থা যে দায়ী তা সন্দেহের অপেক্ষা রাখে না। মনে করা হচ্ছে, নেপালের কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টে ঘন ঘন বিমান দুর্ঘটনার কারণ এই ক্লিয়ার এয়ার টার্বুলেন্স।