ড. অমলেন্দু মুখোপাধ্যায়
কৃষি আইন রদ হল, অন্তত মৌখিকভাবে। ক্ষমা চাওয়ার নাটকও হল। কিন্তু তাতেই কি সব মিটে গেল? সব বিরোধের নিষ্পত্তি?
গ্রিক ট্র্যাজেডিতে ‘হুব্রিস’ বলে একটা কথা পাওয়া যায়। বাংলা অর্থ ‘দেবতাদের প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদ্ধত্যের ভাব, যার ফলে জীবনে চরম দুর্ভাগ্য নেমে আসে’। কেন জানি না, মোদি সরকার তিনটি কৃষি আইন বাতিল ঘোষণা করার পর থেকে ওই শব্দটা মাথায় জাঁকিয়ে বসেছে।
কত চেষ্টাই না হয়েছে! আন্দোলন ভাঙার জন্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির প্রয়াস থেকে শুরু করে তাঁদের প্রলোভন প্রদর্শন পর্যন্ত সবকিছুই। কখনও তাঁদের বলা হয়েছে সন্ত্রাসবাদী, কখনও আবার খলিস্তানি। কখনও তাঁদের প্রতিবাদ মিছিল কাঁদানে গ্যাস বর্ষণের মুখে পড়েছে, কখনও আবার তাঁদের গাড়ির চাকায় পিষে মারার চেষ্টা হয়েছে। প্রকাশ্য সভায় আন্দোলনকারীদের মেরে মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেও কার্পণ্য করেনি সরকার পক্ষ। এখন তাঁদের কাছে ৬০০-র বেশি মানুষের আত্মাহুতির পর ক্ষমা প্রার্থনা! বিশ্বাস করুন, নাটুকে আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।
আরও পড়ুন-পার্থদা আপনারা কোথায়? যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ফোন
কৃষি আইন প্রত্যাহৃত না হয় হল। কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর যে অজানা রয়ে গেল।
যেমন, যে আইনগুলো বাতিল হল সেগুলোর সাংবিধানিক বৈধতার প্রসঙ্গ। ভারতের সংবিধান মোতাবেক কৃষিপণ্য বিপণন রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়। যে কৃষি মান্ডি নয়া আইনের মুখ্য টার্গেট, সেগুলো পরিচালিত হয় এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি আইনের দ্বারা যে আইন পাশ হয় রাজ্য বিধানসভায়।
২০০৩-এ তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি বিপণন সংক্রান্ত একটি মডেল বিধি প্রণয়ন করে রাজ্যগুলোকে পাঠিয়েছিল যাতে ওই বিধি রাজ্যের বিধানসভাগুলোতে পাশ হয়। ২০১৭ ও ২০১৮তে ফের ওই রকম মডেল বিধি করে রাজ্যে রাজ্যে পাঠানো হয়েছিল। সেগুলো যে সাদরে গৃহীত হয়েছিল সেটা যেমন সত্যি নয়, সেগুলোকে সবাই আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছিল, তেমনটাও নয়। ফলে, ২০০৩ থেকে ২০২০-র মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি আইনে নানা বদল আনা হয়েছিল। একমাত্র বিহারই ২০০৬-এ তাদের এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি আইনটি নাকচ করে দেয়।
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপের জ্বালা জুড়িয়ে হোয়াইটওয়াশ
২০২০তে এসে ছবিটা পুরো বদলে গেল। ঐকমত্যের কোনও অবকাশ না রেখে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিপণ্য বিপণনের বিষয়টি পুরোদস্তুর নিজেদের কবজায় নিয়ে আসে। এই মর্মে প্রণীত হয় নয়া কৃষি আইন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো চুরমার করে দিয়ে যুগ্ম তালিকার ৩৩ নং এবং রাজ্য তালিকাভুক্ত ১৪, ২৬ ও ২৭ নং বিষয়ে নাক গলিয়ে দেয়। যে কৃষি আইন প্রণীত হয় তাতে রাজ্য তালিকার ২৮ নং বিষয়েও কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করে বসল। এই ২৮ নং বিষয়টি কিন্তু কোনওভাবেই যুগ্ম তালিকার ৩৩ নং বিষয়ের এক্তিয়ারে পড়ে না। এসবের জেরে যা দাঁড়াল, সেটা এক কথায় এরকম। কৃষি আইন প্রণয়ন করে মোদি-শাহর সরকার একটি অসাংবিধানিক কাণ্ড বাধালেন।
আরও পড়ুন-পা মাটিতে রাখতে হবে : দ্রাবিড়
এবং সেই সঙ্গে এই প্রসঙ্গটাও চাপা পড়ে গেল যে এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি আইন বাতিল করলেই কৃষিক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ হুড়মুড়িয়ে আসবে, এটা একটা মিথ। তা যে হয় না তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বিহার। ২০০৬-এ এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি আইন বাতিলের পর সেখানে কৃষকরা আরও বেশি মাত্রায় ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্রের শোষণের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ, এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি আইন বাতিল করেও কৃষকস্বার্থ সে রাজ্যে রক্ষা করা যায়নি। কেরলেও কোনওকালেই এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি আইন কার্যকর ছিল না। সেখানে কৃষিক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। মহারাষ্ট্র এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি আইনের এক্তিয়ার থেকে ফল আর সবজিকে বের করে আনে ২০১৬তে। সেখানেও কিন্তু কৃষিপণ্যের বাজারে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি সামান্যই।
আরও পড়ুন-পা মাটিতে রাখতে হবে : দ্রাবিড়
অর্থাৎ কৃষক মান্ডির কবল থেকে কৃষিকে মুক্ত করতে পারলেই বেসরকারি বিনিয়োগের সূত্রে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে গোলাপি ছবিটা মোদি সরকার বারবার গেলাবার চেষ্টা করেছে, সেটা একটা বড়সড় মিথ্যা। বরং বাস্তবে দেখা গিয়েছে, এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি আইন যদি দুর্বল হয়, তবে অনিয়ন্ত্রিত বাজার আরও বহুধাবিভক্ত হয়ে সমস্যা বাড়ায়। তার ওপর, গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো, মান্ডি কর যেটা পাঞ্জাবের মতো রাজ্যে গ্রামীণ পরিকাঠামোর উন্নয়নে কাজে লাগত, সেটা যদি না পাওয়া যায় তবে গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নতির অর্থ কোথা থেকে আসবে, তার কোনও সুরাহা মেলে না। তাছাড়া, বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা যদি কৃষিপণ্যের বাজারে ঢুকে পড়েন, তবে তাঁরা কীভাবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সমস্যা মেটাবেন, সে প্রশ্নের উত্তরও কিন্তু মোদি-শাহ প্রণীত কৃষি আইনে অমিল ছিল। মধ্যস্থ ব্যবসায়ী থাকছেই, এক দলের বদলে আর এক দল আসবে, অসংগঠিত ফড়েদের বদলে বড় বড় পুঁজির কর্পোরেট সংস্থা আসবে, এটাই বুঝি ওই কৃষি আইনের লক্ষ্য ছিল? এই প্রশ্নেরও কোনও উত্তর নেই।
আরও পড়ুন-হতাশা পরিহার করে এগিয়ে যেতে হবে : ব্রাত্য বসু
বরং মোদি সরকারের কৃষি আইনের সুবাদে চুক্তি চাষের খপ্পরে পড়ে কৃষকদের অবস্থা নীলকর সাহেবদের হাতে বাংলার কৃষকদের মতো হতে পারত। সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই বিশেষত যখন কৃষি বিপণন সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়টা দেওয়ানি আদালতের এলাকা থেকে বের করে এনে অপেক্ষাকৃত দুর্বল সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটের এক্তিয়ারে আনা হয়েছিল। আইনি পদ্ধতির যাবতীয় সুবিধা পেত কর্পোরেট হাউসগুলো।
পরিশেষে একটা কথা। কৃষি আইনের বিরোধিতা করে যে প্রতিবাদী জনসত্তা জাগরূক তার প্রতি সরকারের মনোভাব কেবল উদ্ধত ছিল বললে ভুল হবে, তা বালখিল্যও ছিল। পপস্টার রিহানা আন্দোলনকারীদের সমর্থনে একটা নিরীহ মন্তব্য ট্যুইট করেছিলেন। তার প্রতিক্রিয়ায় সরকার যেরকম রে রে করে তেড়ে গেলেন, তাতে একটা কথাই পরিষ্কার। সরকার অনিশ্চয়তায় ভুগছিল আর তাই ওইভাবে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ।
এতসব ক্ষমা করা যায়? যাবে?
এটাই বোধহয় অযুত টাকার প্রশ্ন, যা এখন আইন প্রত্যাহারের পরেও ঘুরপাক খাচ্ছে।