এই মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল। প্রায় আড়াআড়ি বিভক্তই বলা চলে৷ এক শ্রেণি দাবি তুলেছে, ‘উৎসবে ফিরছি না।’ আরেক পক্ষের দাবি, উৎসব তো সবার৷ ন্যায় বিচারের দাবির সঙ্গে উৎসবে শামিল হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি একটি বৈঠকে রাজ্যবাসীকে উৎসবে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তার পর থেকেই সমাজমাধ্যম জুড়ে এই অভূতপূর্ব বির্তকের শুরুয়াত। ক্যালেন্ডারের হিসেবে আর এক মাসও বাকি নেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ে কলকাতার হাতিবাগান, ধর্মতলা, গড়িয়াহাটের ফুটপাতে যেমন মানুষের ঢল নামে, তেমনিই শহরের বিভিন্ন শপিং মলগুলোতেও ভিড় উপচে পড়ে। একই চিত্র থাকে শহরতলি, মফসসলগুলোতেও। অটোচালক, টোটো চালকদের বাড়তি লাভ, রাস্তার ধারের চাইনিজের দোকান বা ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় শপিং সেরে ক্লান্ত বাঙালির পেটপুজো। এটাই স্বাভাবিক চিত্র। এর সঙ্গে আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং সম্পর্কটা অর্থনীতির। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমরা কিন্তু দুর্গাপুজোর সাতদিনের অর্থনীতির কথা এখনও উত্থাপনই করিনি এই নিবন্ধে। পুজো শুরু হওয়ার আগের এক মাসে গোটা বাংলা জুড়ে মানুষ সারা বছরের কেনাকাটা আরম্ভ করে। শান্তিপুর, ধনেখালি, বোলপুর-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে জামা-কাপড় কিনে এনে, এই মহিলারা নিজস্ব অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করছেন। পুজোর আগের মরশুমে তাঁরা ভাল ব্যবসাও করছেন। কিন্তু হঠাৎই, ‘উৎসবে শামিল হচ্ছি না!’, ‘আমাদের অশৌচ’, ইত্যাদি বলে কেউ বা কারা এই গোটা অর্থনীতিটাকে ধ্বংস করতে চাইছে। তাদের উদ্দেশ্য আজ অনেকটাই স্পষ্ট। এমনকী তাদের কয়েকজনের দ্বিচারিতাও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। সামাজিক মাধ্যমেই সেসব দ্বিচারিতার খণ্ডচিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন- জমে উঠেছে ছোটদের বইমেলা
এই যে বিপুল এক অর্থনীতির মহাযজ্ঞ, তাকে অস্বীকার করার অপচেষ্টাটি কেন? এটি কি কেবলই হুজুগে মেতে প্রচারে থাকার কৌশল? নাকি অজ্ঞতা? ধরে নিচ্ছি দ্বিতীয়টিই। কারণ, সম্ভবত অজ্ঞতা থেকেই এই গুটিকয় ব্যক্তি, বাংলার দুর্গোৎসবটিকে বয়কট করার দুঃস্বপ্ন দেখছেন। আবারও বলছি, প্রতিবাদ প্রতিবাদের মতো চলতেই পারে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে দুর্গোৎসবকে জড়িয়ে যে অপচেষ্টাটি কিছু শহুরে ‘এলিট’ শ্রেণি করছেন তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। এবার আশা যাক, মূল বিষয়ে। পশ্চিমবঙ্গে দুর্গোৎসব যে এখন কেবলই একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, তা এখন সর্বজনবিদিত। কয়েক বছর আগেই, ইউনেসকোর ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’র তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলার এই উৎসব। গত ২০১৯ সালে, ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি সমীক্ষায় উঠে আসে, বাংলার দুর্গাপুজোর সাতদিনে ৩২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। যা রাজ্যের মোট জিডিপির ২.৬%। এই বিপুল পরিমাণ টাকার অঙ্ক বিশ্বের বহু ছোট দেশের মোট অর্থনীতির সমতুল। রাজ্যের পর্যটন দফতর এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের যৌথ এই গবেষণাটির নাম দেওয়া হয়, ‘Mapping The Creative Economy around Durga Pujo in 2019’। গবেষণায় দেখা যায়, দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে অর্থনীতি তাতে সবচেয়ে বেশি অবদান খুচরো বা রিটেইল সেক্টরের৷ এই খুচরো ব্যবসায়ীদের মধ্যে যেমন গড়িয়াহাট বা হাতিবাগানের জামাকাপড়ের ব্যবসায়ীরা আছেন, তেমনই আছেন বিভিন্ন প্যান্ডেলের বাইরের ফুচকা, মোমো, চাউমিন, ফুচকাওয়ালারা। আছেন বেলুন কিংবা নানারকম খেলনা বিক্রি করা দোকানিরা। ২০১৯-এর ব্রিটিশ কাউন্সিলের রিপোর্ট এই খুচরো বা রিটেইল ক্ষেত্রে ব্যবসার অঙ্ক ছিল ২৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা! নিশ্চিতভাবে বলা যায় ৫ বছর বাদে এই টাকার অঙ্ক অনেক বেড়েছে। কারণ, ২০১৯-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, সেবছর দুর্গাপুজোর মোট অর্থনীতি ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকার। আর গত ২০২৩ সালে সেই অঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে হয় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার! খুচরো বা রিটেইল ছাড়াও এই বিপুল অর্থনীতিতে লাভবান হন, প্রতিমাশিল্প বা পটুয়াপাড়ার শিল্পীরা, আলোকশিল্পীরা, ঢাকি, ডেকোরাটার্স-এর কাজে যুক্ত অসংগঠিত মজদুররা, থিম মেকিংয়ের শিল্পীরা, রাজ্যের বিরাট অংশের ফুলচাষীরা, এমনকী প্রতিমা আনয়ন, বিসর্জনের জন্য কুলি, লরি বা ট্রাক ড্রাইভাররাও।
২০১৯-এ ব্রিটিশ কাউন্সিলের গবেষণায় দুই দেশের দুটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি এবং আইআইটি খড়গপুরের গবেষকরা গবেষণা চালান। তাঁদের গবেষণায় স্পষ্ট হয়, দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এ-রাজ্যের কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয়। কয়েক লক্ষ মানুষের সারা বছরের আর্থিক অবস্থা সরাসরিভাবে এই উৎসবের ওপর নির্ভরশীল। এমনকী, সাহিত্য প্রকাশনা, পুজোসংখ্যা এমনকী সিনেমা বা বিনোদন শিল্পেও পুজোর এই সময়ে বিপুল অর্থ আসে। লক্ষণীয় বিষয় হল, গত কয়েক বছরেই পুজোর সময়ে একাধিক সুপারস্টারের বাংলা ছবি মুক্তি পাচ্ছে। এবং প্রত্যেকটি ছবিই বছরের অন্য সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলির তুলনায় বক্স অফিসে ভাল ব্যবসা দিচ্ছে! গবেষণা অনু্যায়ী, আমবাঙালি সারাবছর যে পরিমাণ খরচ করে, তার চাইতে ৩০% বেশি খরচ করেন এই পুজোর সাতদিনে! এহেন পরিস্থিতিতে, যারা আন্দোলনের সঙ্গে একটি বিপুল আর্থিক সম্ভাবনাময় উৎসবকে গুলিয়ে দিয়ে তাকে নানা অছিলায় বয়কটের ডাক দেয়, তারা অবশ্যই আগামীদিনে ‘গণশত্রু’ বলেই চিহ্নিত হবেন। পর্যটন শিল্পে এবং পরিবহণ শিল্পে বিপুল অর্থের জোগান হয় এই পুজোর সময়েই। কোভিড- পরবর্তী সময়ে, পর্যটন শিল্পে যে বিপুল ধাক্কা লেগেছিল তার অনেকটাই গত কয়েকটি পুজোর সময়ে ভ্রমণপিপাসু বাঙালি মেরামত করে দিয়েছে। উত্তরবঙ্গের ‘হোম স্টে’ থেকে দামি হোটেলের সমস্ত ঘর পুজোর তিন মাস আগেই বুকড! এর সঙ্গে যুক্ত করুন পুজোর জলসা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দুর্গোৎসবের অঙ্গাঙ্গী অংশ হিসেবে এই পুজোর জলসা বাংলা-সহ ভারত বা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হয়ে চলেছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বা বিদেশেও এই রাজ্যের নামীদামি শিল্পীরা অনুষ্ঠান করতে যান। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের যন্ত্রানুসঙ্গীত শিল্পীদের রুটিরুজিও যুক্ত। এ ছাড়া এই বাংলায় অসংখ্য অজানা অচেনা শিল্পী আছেন, থিয়েটার-যাত্রাশিল্পীরা আছেন, যাঁরা পুজোর এই সাতটা দিনের দিকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। মফসসল গ্রামে ‘মাচার’ অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বা অভিনয় করেই এই সময় বাড়তি রোজগার করেন তাঁরা। অতএব, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বলেন, ‘উৎসবে ফিরুন’ তখন, তা শোক ভুলে আনন্দে আত্মহারা হওয়ার আহ্বান নয়। বরং, বাংলার বৃহত্তম উৎসবে শামিল হয়ে বাংলার লক্ষ লক্ষ খেটে খাওয়া, নাচার মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর আহ্বান। তাঁর সঙ্গে, একটি নারকীয় ঘটনাকে ভুলে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন বা অভিপ্রায় থাকে না। বিচারের দাবি এবং মায়ের আরাধনার মধ্যে কোনও বিভেদ নেই। বরং, যারা এই বিভেদ করে, তারা কি এবারেও মণ্ডপের বাইরে ‘লালশালু’র স্টল দেবেন? নাকি ‘উৎসবে শামিল হচ্ছি না’ বলে লালশালুর স্টল বন্ধ রাখবেন, সেদিকেও কিন্তু নজর রাখবে বাংলার মানুষ!