হতে পারেন আপনি অতি-বাম, কিংবা মডারেট বামপন্থী অথবা সনাতন ধর্ম জাগরণের প্রবক্তা। আপনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে পারেন, সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাইতে পারেন কিংবা সরকার-বিরোধী পক্ষের নেতৃত্ব দিতে পারেন কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ আপনাকে চিনি একজন চিকিৎসক হিসেবে, একজন মুমূর্ষুর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার কারিগর হিসেবে। তিলোত্তমার ন্যায়বিচার চেয়ে আপনার চিৎকার আকাশ ছুঁতে পারে, আপনার প্রতিবাদের ভাষায় আগুন ঝরতে পারে, কিংবা থাকতে পারে সংগীতের সুর কিন্তু আপনার গলায় স্টেথোস্কোপ থাকবে—এভাবেই তো দেখতে চেয়েছি আমরা।
আরও পড়ুন-নজরে নিরাপত্তা, একগুচ্ছ ব্যবস্থা নিল বারুইপুরের দুই হাসপাতাল
আমাদের রাজ্যে স্বৈরতন্ত্র নেই যে শাসক কানে তুলো গুঁজে রেখে আঙুল রেখেছে বন্দুকের টিগারে। এ-রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। আজকের মুখ্যমন্ত্রীর গলায় এ-কথা শুনি না আর— “সীমা ছাড়াচ্ছেন, বিপদে পড়বেন”। আজকের মুখ্যমন্ত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধায়। তাই তিনি ছুটে যান আপনাদের কাছে। আপনাদের অবিরত কটু কথাকে উপেক্ষা করে প্রকৃত অভিভাবকের মতো কথা শুনতে চান আপনাদের। আপনাদের তীব্র শ্লেষকে অভিমানের বহিঃপ্রকাশ বলে গণ্য করেন। দিদির মতো কাছে গিয়ে বলেন, “আমি কিছু মনে করিনি”। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিবাদীর প্রতি শাসকের এই সহমর্মিতার খুব একটা উদাহরণ আছে বলে আমার মনে হয় না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু লড়াই- আন্দোলনের মধ্য থেকে উঠে আসা এক জননেত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজন নেত্রী যিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আগাগোড়া সাধারণ মানুষের আশীর্বাদ পেয়েছেন। এই বাংলার সচেতন মানুষ কী বারবার তাঁকে না বুঝে গ্রহণ করছে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে লড়াই আন্দোলনের সহাবস্থান ছিল বলেই তিনি আপনাদের লড়াইকে মর্যাদা দিতে চেয়েছেন। তাই আপনাদের দ্বারা বারবার প্রত্যাখ্যাত হবার পরও আলোচনার দরজা খোলা রাখলেন।
আরও পড়ুন-মাঝসমুদ্রে নিখোঁজ ৪৯ জন মৎস্যজীবী
তিলোত্তমার ন্যায়বিচার আমরা সবাই চাই। এই নারকীয় ঘটনার দোষীদের ফাঁসি চেয়েছেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। ভারতের ন্যায় সংহিতা আইনের কিছু দুর্বলতা কাটিয়ে রাজ্য বিধানসভায় আমরা বিল এনেছি যাতে এই ধরনের অপরাধীর শাস্তি হয় মৃত্যুদণ্ড। এই মুহূর্তে আরজি কর-কাণ্ডের বিচারের ভার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। তদন্ত করছে সিবিআই। এই বিচার প্রক্রিয়ার ওপর আমাদের ভরসা রাখতেই হবে। জুনিয়র ডাক্তার বাবুরা এটা আপনারা ভাল করেই জানেন। বাকি রইল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে পরিকাঠামোগত কিছু পরিবর্তনের দাবি। এই দাবি পূরণের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে আপনারা কথা বলবেন কার সাথে? এই দফতরের সর্বোচ্চ অথরিটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর সাথে। এটাই তো নিয়ম। তাই আলোচনার ব্যবস্থা! মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছে গেলেন আপনাদের কাছে। আলোচনার পথ তৈরি করলেন, দরজা খুলে রাখলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে রইলেন আপনাদের জন্য। একজন মুখ্যমন্ত্রী কতটা সহনশীলতা দেখাতে পারেন সারা দেশবাসী সেটা প্রত্যক্ষ করেছে।
আমরা জানি সরকারি হাসপাতালগুলিতে ৯০ হাজারের ওপর সিনিয়র ডাক্তার অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে চলেছেন। ৭৫০০ জুনিয়র ডাক্তার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে সিনিয়রদের সাথে একযোগে চিকিৎসা করেন। বিশেষ করে কলকাতায় অবস্থিত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে এই সার্ভিস-এর খুবই প্রয়োজন। কারণ কলকাতার হাসপাতালগুলিতে রোগীর চাপ অনেক বেশি থাকে। ফলে আপনাদের এই নিরবিচ্ছিন্ন কর্মবিরতি চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটা গ্যাপ তৈরি করেছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে আবেদন থেকেছে আপনাদের কাছে, দাবি থাকুক প্রতিবাদ থাকুক কিন্তু চিকিৎসায় ফিরুন। আলোচনায় বসুন সমাধান বেরোবে। কিন্তু এই যে কর্মবিরতি, এতে লাভ-ক্ষতি ছিল কার?
লাভ : (১) বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোমগুলির। রোগী বাড়ছে, ব্যবসা বাড়ছে।
(২) সিপিএমের মতো রাজনৈতিক দলের। যাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছেন মানুষের সমর্থন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে অচল অবস্থা থাকলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অপমান করলে এরা মজা পায়।
ক্ষতি : সাধারণ গরিব মানুষের। যারা চিকিৎসা পাচ্ছে না। যাদের বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ নেই।
আরও পড়ুন-কুলিক পাখিরালয়ে দেখা মিলল গ্লসি আইবিসের
জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা এগুলো আপনারা অনুধাবন করলে মঙ্গল হয় সাধারণ মানুষের।
পৃথিবীতে যতগুলি রাষ্ট্র ব্যবস্থা আছে তার দুটি থাকে। একটি দর্শনের দিক অপরটি তার প্রয়োগের দিক। প্রতিটি দর্শনে মানুষের জীবযাত্রার মান উন্নয়নের কথা থাকলেও তার প্রয়োগের দিক নিয়ে প্রশ্ন থেকেছে। এই যে পশ্চিমবঙ্গে শাসন করেছিল একটি কমিউনিস্ট পার্টি সিপিএম। তাদের ম্যানিফেস্টোতে গরিব মানুষের কথা থাকত, মেহনতি মানুষের কথা থাকত কিন্ত ওই মানুষগুলিকে নিয়ে ওরা মিছিল করত, মিটিং করত কিন্তু সরাসরি তাদের মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিল তারা কোনওদিন! তাই আমলাসোল, উত্তরবঙ্গের চা-বাগানের অভুক্ত শ্রমিকের মৃত্যু সেদিন খবরের কাগজের শিরোনাম হত। কবি লিখেছিলেন, “কেমন ক্ষমতা দেখি যদি পারো জ্বালো/ দিনান্তে মানুষের ঘরে উনুনের আলো”। আর আজকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই নিরন্ন মানুষগুলির ঘরে উনুনের আলো জ্বালানোর বন্দোবস্ত করেছেন খাদ্যসাথী প্রকল্পের মাধ্যমে। তাই না খেতে পেয়ে মানুষের মৃত্যু আজ এই বাংলায় অতীত। শুধু দর্শন নয় সেই দর্শনের ফলিত রূপ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা ভেবে দেখেছেন কখনও এই কথাগুলি!
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি চেয়েছে রাজ্যে অরাজকতা তৈরি হোক। তারা মনেপ্রাণে চায় অচল অবস্থা থাকুক। তারা চায় মুখ্যমন্ত্রী অসম্মানিত হোক। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইচ্ছা-বিরোধী দলগুলির থাকতেই পারে কিন্তু তার জন্য ২০২৬ সালের নির্বাচন আছে। চেষ্টা করে তারা দেখতেই পারে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। তাই বলে ভ্যান্ডালিজম তৈরি করার চেষ্টা নিন্দনীয়। এগুলো আমাদের ভাবতে হবে। আপনারা তো ডাক্তার। শিল্পী নচিকেতা গেয়েছিলেন— “ডাক্তার মানে সে তো মানুষ নয়/আমাদের চোখে সে তো ভগবান।” আমরা আপনাদের ভগবান ভাবতেই ভালবাসি।”