ক’দিন আগেকার ঘটনা। অসমের নগাঁও জেলার ধিং এলাকার ঘটনা। নাবালিকা ধর্ষণের শিকার হল। নির্যাতনকারীর সংখ্যা তিন। তিনজনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় অমেয় রোষ বর্ষিত হল একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ওপর। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ভাষ্যের সেই ক্রোধের অনুরণন শোনা গেল। অতীতে তিনি সংখ্যালঘুদের ‘সাম্প্রদায়িক সংগঠন’ বলতে দ্বিধা করেননি। এবার সুযোগ পাওয়া মাত্র তিনি সখেদে সরোষে হুঁশিয়ারির সুরে বললেন, মিঞা মুসলমানরা এবার সমগ্র অসমের দখল নেবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বঙ্গভাষী মুসলমান সম্প্রদায়কে অবজ্ঞাভরে ‘মিঞা মুসলমান’ বলে চিহ্নিত করা হয়।
হিমন্ত বিশ্বশর্মার বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ামাত্র তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল। গণমাধ্যমে এবং সমাজমাধ্যমে। সেই সূত্রে উঠে আসছে কতিপয় জিজ্ঞাসা।
আরও পড়ুন-আসন্ন শীতে বাতিল বহু দূরপাল্লার ট্রেন
প্রথম প্রতিক্রিয়াটি অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী মানুষজনের। রাজনীতিক তো বটেই, অরাজনৈতিক নাগরিকদেরও। তাঁদের অভিমত, অসমের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে এরকম বক্তব্য জানানোয় ভারতীয় সংবিধানের মূল ভিত্তি যে বিষয়টি, সেই ধর্মনিরপেক্ষতা আহত হয়েছে। অথচ এই সংবিধানের শপথ নিয়েই হিমন্ত মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। সুতরাং, সাংবিধানিক পদাধিকারী হিমন্তর বক্তব্য অসাংবিধানিক।
দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে উদ্বিগ্ন সুশীল নাগরিক সমাজের তরফে। তাঁদের আশঙ্কা ভারতীয় সমাজজীবনে অন্তঃসলিলা বিদ্বেষ-বিভাজনের ধারাটি অসমের মুখ্যমন্ত্রীর এ-ধরনের মন্তব্যে উৎফুল্ল হবে। সোৎসাহে জাতিগত বা সাম্প্রদায়িক হিংসার বাড়-বাড়ন্ত ঘটাবে।
তৃতীয় প্রতিক্রিয়া মূলত গৈরিক শিবিরের। তাঁদের সুস্পষ্ট অভিমত, ভারতীয় সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি স্বীকৃত বিষয়। সুতরাং, হিমন্ত বিশ্বশর্মা এরকম বক্তব্য প্রকাশ করে কোনও সংবিধানবিরোধী কাজ করেননি।
জগতে নিন্দুকের অভাব নেই। ‘তোতাকাহিনী’র যুগে তো ছিলই না, এখনও নেই। তাদের বক্তব্য, অসমের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ঘৃণাভাষণ দোষে দুষ্ট হলেও বেআইনি নয়। কারণ ভারতে ‘ঘৃণাভাষণ’ আইনি পরিসরে সুসংজ্ঞাত নয়।
আরও পড়ুন-প্রশ্নে নিরাপত্তা, ট্রেনে যুবতীর শ্লীলতাহানি
এহেন প্রেক্ষিতে হেমন্ত বিশ্বশর্মাকে বাক্ স্বাধীনতার নিরিখে ছাড় দেওয়া যায় কি না, সেটা অনুধাবন করতে হলে জন স্টুয়ার্ট মিল-এর ‘অন লিবার্টি’ ফিরে পড়া দরকার। উনিশ শতকের এই দার্শনিক উল্লিখিত গ্রন্থে স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও পরিসর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ফলত, উদারনীতিবাদের বিষয়ে বইটি আকর গ্রন্থের মান্যতা প্রাপ্ত।
মিল মনে করতেন, মানুষ যদি তাদের পছন্দ-অপছন্দ স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে, তবেই সামাজিক পরিসরে সত্যিকার সুখ মিলবে। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ন্যূনতাই স্বাধীনতার বুনোট মজবুত করে। তিনি মনে করতেন, যদি একজনের স্বাধীনতা অন্যের বিড়ম্বনার কারণ হয়, তবেই সভ্য নাগরিক সমাজে রাষ্ট্র নাগরিকদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। নচেৎ নয়।
বিষয়টার মধ্যে কোনও মারপ্যাঁচ নেই। একেবারে সোজাসাপটা বক্তব্য। আমাদের কাজ যদি আত্মকেন্দ্রিক হয়, অর্থাৎ সে কাজের পরিণাম যদি কর্তার উপরেই কেবল বর্তায়, তবে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কাজের প্রভাব যদি অন্যের ওপর পড়ে, কাজের ফল যদি কর্তা ব্যতীত অন্য কাউকে ভুগতে হয়, তবে রাষ্ট্র সেকাজে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। মোদ্দা কথা, চাইলে যে কেউ লাঠি হাতে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারে। তাতে বাধা দেওয়ার প্রশ্ন নেই। কিন্তু সেই লাঠি দিয়ে অন্য পথচারীদের মারতে মারতে হাঁটলে, তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। মদ্যপান ব্যক্তি স্বাধীনতার মাপকাঠিতে ছাড় পাবে ততক্ষণ, যতক্ষণ না মদ্যপানকারী ব্যক্তি অন্য কাউকে মারধর কিংবা গালিগালাজ করছে বা তার মাতলামি অন্যর বিরক্তি বা অসুবিধার কারণ হচ্ছে না।
তা বলে, অন্যের অসুবিধার কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের অছিলায় কোনও কাজকে বেআইনি বলে দাগিয়ে দিতে পারে না। মিলের এই যুক্তিকে আশ্রয় করে নভতেজ সিং জোহর বনাম ভারত ইউনিয়ন মামলায় সুপ্রিয় কোর্ট সমকামিতাকে আইনবিরুদ্ধ কর্ম হিসেবে ঘোষণার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল।
আরও পড়ুন-নতুন লড়াইয়ের আগে সতর্ক ডায়মন্ড হারবার
এখন প্রশ্ন হল, একজনের কাজকর্মে অন্যের ক্ষতি হচ্ছে বলে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে চাইলে সেক্ষেত্রে ‘ক্ষতি’র সংজ্ঞা কী হবে? যদি একজন ব্যক্তি মারণরোগে আক্রান্ত হয়ে ৪০ বছর শয্যাশায়ী অবস্থায় দিন কাটায় আর তাঁর পরিবার কিংবা চিকিৎসক যদি বলেন, তাঁকে মেরে ফেলা হোক, তাহলে এই মৃত্যু-নির্দেশ কি ওই অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষতি করল নাকি তাঁর হিতসাধন করল? প্রাণনাশ নিঃসন্দেহে ক্ষতিসাধন। কিন্তু এক্ষেত্রে তো প্রাণহানি যন্ত্রণা হানির একমাত্র উপায়। এক্ষেত্রে কি সংশ্লিষ্ট পরিবার বা চিকিৎসকের সিদ্ধান্তে বা কার্যকলাপে অন্যের ক্ষতি হচ্ছে?
আরও একটি প্রশ্ন। ক্ষতি কি কেবল শারীরিকভাবেই হয়? তথ্য বিস্ফোরণের যুগে ভুয়ো তথ্যের কারণেও তো ক্ষতি হতে পারে। এবং সব সময় সে-ক্ষতি সঙ্গে সঙ্গে নজরে নাও পড়তে পারে।
এসব কথা মনে করার ও করানোর দরকার পড়ত না, যদি না হিমন্ত বিশ্বশর্মার দুরভিসন্ধি সামনে আসত এবং একই সঙ্গে সোমবার আইনের ছাত্রী ঋতিকা সর্দার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বসে পড়ে চক্রান্তের বিরুদ্ধে আওয়াজ না তুলতেন। আন্দোলনরত ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠক চলাকালীনই মুখ্যমন্ত্রীর ছবি হাতে স্লোগান দিতে দিতে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের মুখে এসে মাটিতে বসে পড়েন তিনি। ‘আমার মাটি আমার মা, বাংলাদেশ হবে না’— লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রাজ্যের বিরুদ্ধে চক্রান্ত রুখতে সরব হন তিনি। তাঁর বক্তব্য, তিনিও আর জি কর-কাণ্ডের বিচার চান। কিন্তু এই ঘটনাকে সামনে রেখে যেভাবে বাংলাদেশের গান-স্লোগান ব্যবহার করে বিরূপ প্রচার চলছে তা ন্যক্কারজনক।
অর্থাৎ, সুচারু ভাবে দুষ্ট লোকের নষ্ট খেলা শুধু অসমে নয়, চলছে এ-রাজ্যেও। সতর্ক থাকতে হবে আমাদের সবাইকেই। হিমন্তের বিষদাঁত ভাঙতে আরও বেশি করে ঋতিকাদের সামনে আসতে হবে। এটাই সময়ের ডাক।