শিক্ষার্থীদের যা করতেই হবে

ছাত্র ছাত্রীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকবে, থাকবে শৃঙ্খলাবোধ আর আনুগত্য চেতনা । সৃজনশীলতার দীপ নিত্য দ্যোতিত হবে তার ভেতর। অস্থির আবহে আজ অন্তিম পর্বে সেসব মনে করিয়ে দিলেন রাজ্যের শিক্ষা দফতরের সহ সচিব ও বিশিষ্ট। শিক্ষাবিদ ড. পার্থ কর্মকার

Must read

উচ্চাকাঙ্ক্ষা
একজন আদর্শ ছাত্রের মনে সব সময় উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকবে। সে সবসময় নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এবং সেগুলি অর্জনের জন্য কঠোরভাবে পরিশ্রম করবে। সে সমস্ত অ্যাকাডেমিক এবং অতিরিক্ত পাঠ্যক্রমিক ক্রিয়া-কলাপে অংশগ্রহণ করবে। কারণ এগুলি তার সাফল্যের চাবিকাঠি মনেপ্রাণে অর্থাৎ কায়মনোবাক্যে এগুলি মেনে চলবে।

মনোযোগী
মনোযোগ একটি বিশেষ বিষয়। একজন আদর্শ ছাত্র তার পড়াশোনায় সব সময় মনোযোগী হবে। সে তার শিক্ষক এবং গুরুজনদের দ্বারা শেখানো পাঠের গুরুত্ব বুঝবে, একইসঙ্গে বাস্তব জীবনে এটি প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে। মনঃসংযোগ ছাড়া কোনও শিক্ষা সম্পন্ন হয় না। মনঃসংযোগ আমাদের প্রত্যেকের একান্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। মনঃসংযোগ করতে হলে মনের রূপ, মনের যে প্রকৃতি, মনের ব্যবহার আমাদের জানতে হবে। মন আমাদের সাধারণভাবে সর্বকর্মে অনুপ্রবেশ ঘটায়। মন সকল বিষয়বস্তু দ্বারা আকৃষ্ট করে আমাদের ধাবিত করে, সুখের লোভ দেখায়— এটি হচ্ছে মনের প্রকৃতি মন। এই মন সুখস্মৃতি বহন করে, বারবার সেই সুখ আস্বাদনের দিকে আমাদের নিয়ে যায়। মন আমাদের সম্পূর্ণ বশীভূত করে আমাদের ওপর প্রভুত্ব করতে চেষ্টা করে। কিন্তু মনকে প্রভুত্ব করতে দিলে অনেক সময় যে কাজগুলো আমাদের ক্ষতিকর, যে কাজগুলো ছাত্রজীবনে করা উচিত নয়, আমাদের মন সেগুলির দিকে আকৃষ্ট হয়। মনের প্রকৃতি স্বামী বিবেকানন্দের কথায় খুব পরিষ্কার, তিনি বলেছেন, ‘আমার মতে মনের একাগ্রতা সাধনই শিক্ষার প্রাণ, শুধু তথ্য সংগ্রহ করা নহে। আবার যদি আমাকে নতুন করিয়া শিক্ষা লাভ করিতে হইত এবং নিজের ইচ্ছামতো আমি তাহা করিতে পারিতাম, তাহা হইলে আমি শিক্ষণীয় বিষয় লইয়া মোটেই মাথা ঘামাইতাম না। আমি আমার মনের একাগ্রতা ও নির্লিপ্ততার ক্ষমতাকে ক্রমে ক্রমে বাড়াইয়া তুলিতাম; তারপরে ওইভাবে গঠিত নিখুঁত যন্ত্র-সহ খুশিমতো তথ্য সংগ্রহ করিতে পারিতাম। মনকে একাগ্র নির্লিপ্ত করিবার ক্ষমতা বর্ধনের শিক্ষা শিশুদের এক সঙ্গেই দেয়া উচিত।”

শৃঙ্খলাবদ্ধ ও আজ্ঞাবহ
একজন ছাত্রের জীবন হবে সর্বদা শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং আজ্ঞাবহ। তিনি তার পিতা-মাতা শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং গুরুজনদের প্রতি আজ্ঞাবহ থাকবে। সে তার দৈনন্দিন জীবনে শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকবে একইরকম ভাবে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজে সে শৃঙ্খলা বজায় রাখবে। সে সমস্ত নৈতিক ও সামাজিক আইনকে সম্মান করবে। নৈতিকতা বজায় রাখার জন্য সে সংযম পালন করবে। অর্থাৎ ভাল বোধকে নিজের মধ্যে জাগ্রত রাখবে।

সময়ানুবর্তী
একজন শিক্ষার্থীকে (Students) মনে রাখতে হবে ‘Time and tide wait for none.’ এই বিখ্যাত উক্তির মধ্যে খুব পরিষ্কার, সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ানুবর্তী না হলে কোনও কাজেই সঠিক সময়ে করা যাবে না। সঠিক সময়ে সব কাজ না করলে মানসিক দুর্বলতা আসবে আত্মবিশ্বাস হারাতে থাকবে।

আন্তরিক এবং নিষ্ঠাবান
আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা একজন ছাত্রের সাফল্যের চাবিকাঠি। আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠার সাহায্যে প্রত্যেকটি মানুষ তার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করতে পারে তাই ছাত্রদের এই দুটো বিষয় অভ্যাস করা প্রয়োজন। স্বামী বিবেকানন্দ এক জায়গায় বলেছেন, ‘কাপুরুষ ও মূর্খরাই অদৃষ্টের দোহাই দেয়। বীরপুরুষগণ মাথা উঁচু করে বলে, আমাদের অদৃষ্ট আমরাই গড়বো।” স্বামীজির আদর্শ শক্তির একটি উদ্বোধন। শক্তি সুখ সত্যিই আনন্দ শক্তি অনন্ত এবং অবিনশ্বর জীবন গঠন করতে পারে। আর এইটি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সৎ কাজ করে গেলে সম্ভব।

সৃজনশীল
একজন ভাল ছাত্র সৃজনশীল মনের অধিকারী। আন্তরিক এবং নিষ্ঠাবান শিক্ষার্থী ভালবেসে বিষয়ভিত্তিক পড়ার মধ্য থেকে সৃজনশীল চিন্তা দিয়ে নতুন এবং উদ্ভাবনী কোনও কৌশল-তা বিজ্ঞানেরই হোক আর অন্য বিষয়ের হোক সেইগুলো অর্জন করতে পারে। এই সৃজনশীলতা তাকে একজন দক্ষ শিক্ষার্থী শুধু নয় একজন চিন্তাশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন ভবিষ্যৎ নাগরিক হতে সাহায্য করবে।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
প্রতিটি বিষয় অধ্যয়নের সঙ্গে একজন শিক্ষার্থীর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ যে যাই পড়াশোনা করুক না কেন— তা যুক্তি দিয়ে বিচার করে, সত্যতা যাচাই করে তবে পড়বে, মনে রাখবে— অর্থাৎ স্মরণ, মনন এবং নিদিধ্যাসন তিনটি হবে। যুক্তি দিয়ে না বুঝে সে কখনওই কোনও কিছুকে আবেগের অনুভূতিতে সত্য হিসাবে গ্রহণ করবে না।

আরও পড়ুন- সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, শুভবুদ্ধির উদয় হোক: আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

সহানুভূতি ও সমানুভূতি
একজন আদর্শ ছাত্র অবশ্যই সহানুভূতিশীল হবে এবং তার মধ্যে সমানুভূতি থাকবে। সহানুভূতির সঙ্গে সমানুভূতি থাকলে সে অন্যের দুঃখ-যন্ত্রণা কি উপলব্ধি করতে শিখবে। এইটি তার পরিবারের পক্ষে যেমন ভাল অর্থাৎ পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের প্রতি তার ভালবাসা, শ্রদ্ধা বাড়বে। ঠিক তেমনি তার সমাজের প্রতিও ভালবাসা দরদ বাড়বে এবং সমাজের কল্যাণে অংশগ্রহণ করবে।

শারীরিক এবং মানসিক শক্তি
একজন আদর্শ শিক্ষার্থী মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটে শারীরিক বিকাশের সঙ্গে। স্বামীজি শিক্ষার্থীদের, যুবকদের, ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলছেন, “হে আমার যুবক বন্ধুগণ, তোমরা সবল হও— তোমাদের নিকট ইহাই আমার বক্তব্য। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমার স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে। আমাকে অতি সাহসপূর্বক এই কথাগুলি বলিতে হইতেছে; কিন্তু না বলিলেই নয়। আমি তোমাদিগকে ভালবাসি।” পুরোটা পড়লে বোঝা যায় যে স্বামীজি সবসময়ই এটা চাইতেন যে দেশের মানুষ আগে স্বাস্থ্যবান ও কর্মঠ হোক তবে তো দেশের জন্য কাজ করতে পারবে। স্বামীজি আরও বলেছেন, “আমি চাই এমন লোক— যাদের পেশীসমূহ লৌহের ন্যায় দৃঢ় ও স্নায়ু ইস্পাত-নির্মিত, আর তার মধ্যে থাকবে এমন একটি মন, যা বজ্রের উপাদানে গঠিত। বীর্য, মনুষ্যত্ব— ক্ষাত্রবীর্য, ব্রহ্মতেজ!” এর থেকে বোঝা যায় একজন শিক্ষার্থীর সুস্থ, স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক শক্তি কতটা দরকার।

প্রকৃত দেশপ্রেমিক
একজন আদর্শ ছাত্র একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। সে তার দেশ এবং দেশের মানুষকে ভালবাসবে। এই প্রসঙ্গে স্বামীজি আহ্বান করেছেন, এসো, মানুষ হও। নিজের সংকীর্ণ গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে গিয়ে দেখ, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে। তোমরা কি মানুষকে ভালবাস? তোমরা কি দেশকে ভালবাস? তাহলে এস, আমরা ভাল হবার জন্য— উন্নত হবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি।

আদর্শবাদী
একজন আদর্শ ছাত্র শক্তিশালী নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। ‘সরল জীবনযাপন এবং উচ্চ চিন্তা’ তার জীবনের মূলমন্ত্র। একজন শিক্ষার্থী যেমন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র এবং বিনয়ী হবে, তেমনি হবেন নির্ভীক এবং সাহসী।। স্বামীজি বলেছেন, ‘হে বীরহৃদয় যুবকগণ, তোমরা বিশ্বাস কর যে, তোমরা বড় বড় কাজ করবার জন্য জন্মেছ। ওঠ, জাগো, আর ঘুমিও না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের ভিতরেই আছে। এ কথা বিশ্বাস করো, তা হলেই ঐ শক্তি জেগে উঠবে।’
তাই আমি প্রিয় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলব, প্রতিটি বিষয় মনোযোগের সঙ্গে ভালবেসে পড়ো, শিক্ষক মহাশয়েরা যে পাঠদান করেন তা স্মরণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করো। নিজের অর্জিত শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার মানসিকতা তৈরি করো। গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বাড়াও। তাদের মান্যতা দাও। তোমরা আত্মবিশ্বাসী, সাহসী, দেশপ্রেমিক ও নিঃস্বার্থপর নাগরিক হয়ে উঠবে। কেননা তোমরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

Latest article