ছন্দাপতন

‘খবর পড়ছি ছন্দা সেন’— আজও ধ্বনিত হয় অনেকের কানেই। আকাশবাণী, দূরদর্শনের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিলেন ঘরের মেয়ে। বাংলায় সিরিয়াস ও মনোযোগী সংবাদপাঠ আবহের অন্যতম কান্ডারি। চলে গেলেন। স্মরণে অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

১৯৭৫। কলকাতা প্রথম চোখ রাখল দূরদর্শনে। এক অন্য অভিজ্ঞতা। দেখাও যায়। শোনাও যায়। নানারকম অনুষ্ঠান। অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাংলা সংবাদ। সেইসময় মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিলেন ছন্দা সেন। সংবাদ পাঠের মধ্যে দিয়ে। সাদাকালো ছবি। স্পষ্ট উচ্চারণে খবর পড়তেন তিনি। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। দীপ্ত কণ্ঠস্বর। ভীষণ উজ্জ্বল। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন দর্শকদের ঘরের মেয়ে।
সংস্কৃতে এম এ। ১৯৭৪-এ স্থায়ী ঘোষিকা হিসেবে আকাশবাণীতে যোগ দেন। তার আগে কয়েক বছর অস্থায়ী কর্মীর কাজ করেছেন। সেইসময় কয়েকজন অস্থায়ী কর্মী মিলে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল অস্থায়ী থেকে স্থায়ী কর্মী হয়ে ওঠা। ছন্দা সেন সেই সংগঠনে পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আকাশবাণীতে খবর পড়া, ঘোষণা ছাড়াও নানা আলেখ্য বা ফিচারে দিয়েছিলেন কণ্ঠ।

আরও পড়ুন-গোয়ার বিরুদ্ধে আজ সাবধানি মহামেডান

১৯৭৬-এর ২৩ সেপ্টেম্বর মহালয়ার ভোরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘দেবীং দেবীদুর্গতিহারিণীম’ নামে যে সংগীত আলেখ্যটি প্রথম প্রচারিত হয়েছিল, তাতে সংস্কৃত স্তোত্র পাঠে অংশ নিয়েছিলেন ছন্দা সেন। সঙ্গে ছিলেন গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়, ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। ভাষ্যপাঠে ছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপ্লবী কবি বেঞ্জামিন মলওয়েজের জীবনী অবলম্বনে লেখা অলোক ভট্টাচার্যের ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ নাটকে সংবাদ পাঠিকার ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন ছন্দা সেন।
তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রচিত হয়েছিল চৈতালি দাশগুপ্তর। তিনি জানালেন, ‘ছন্দাকে সামনে দেখার আগে ওর সংবাদপাঠ শুনেছিলাম। খবর পড়া শুনে হয়েছিলাম মুগ্ধ। দূরদর্শনে যেদিন প্রথম সামনে থেকে দেখি, সেদিন ছিল খুব সাধারণভাবে। মানুষটা ছিল খুব সহজ সরল, স্বাভাবিক। হইহই করতে ভালবাসত। আড্ডা হত আমাদের। খবর পড়ত স্বাভাবিকভাবে। নিষ্ঠাভরে, সুন্দর করে। কীভাবে স্ক্যান করতে হয়, কীভাবে উচ্চারণ করতে হয়, সেটা প্রথম থেকেই ওর ভেতরে ছিল।’
ছন্দা সেনের দীর্ঘদিনের সহকর্মী, বন্ধু, ভ্রাতৃপ্রতিম দেবাশিস বসু। স্মৃতিচারণ করলেন। বললেন, ‘শনিবার শনিবার টেলিভিশনের পর্দায় ছন্দাদিকে দেখতাম। একটা মুগ্ধতা কাজ করত। সবকিছুর মধ্যেই দেখা যেত সাবলীলতা। উচ্চারণে চেষ্টাকৃত নিখুঁত করার বাসনা ছিল না। স্পষ্ট, পরিষ্কার। আমার খুব ভাল লাগত।’ তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭৯ সালে আমি আকাশবাণীতে জয়েন করি। সেই সময় থেকেই ছন্দাদির সঙ্গে যোগাযোগ। শেষ পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল। একসঙ্গে অজস্র কাজ করেছি। প্রাত্যহিকী, সবিনয় নিবেদন। দীর্ঘ তালিকা। ছন্দাদি ছিল দিলখোলা মানুষ। আমাকে খুব ভালবাসত। হাসত প্রাণ খুলে। মাঝেমাঝে করত অভিমানও। অভিমান ভাঙানোটাও একটা ব্যাপার ছিল। সংস্কৃতটা ভাল জানত। কোথাও আটকালে জিজ্ঞেস করতাম। একটা আভিজাত্য ছিল। সহজিয়া ব্যাপার। ছন্দা সেন নামটাই আমাকে আকৃষ্ট করত।’

আরও পড়ুন-কলেজিয়াম কোনও ‘অনুসন্ধান কমিটি’ নয়, বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রকে কড়া কটাক্ষ করল সুপ্রিম কোর্ট

কথা হল সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অসংখ্য স্মৃতি। তিনি জানালেন, ছোট বয়সে বাড়িতে যখন টিভি এসেছে, তখন থেকেই ছন্দাদিকে চিনি। বাবা ওঁর খবর পড়া খুব পছন্দ করতেন। সত্যিই এত সাবলীল এত সহজ দৃপ্ত পড়া, আজও সবাই মনে রেখেছে। একটি ঘটনার কথা বলি। তখন আমি খুব ছোট। আমি আর দিদি একদিন দেশপ্রিয় পার্কে ছন্দাদিকে দেখে অনেকদূর পিছন পিছন ছুটেছিলাম। টিভিতে দেখি, সামনে দেখতে পাচ্ছি, এই আনন্দে। পরবর্তী সময়ে যখন দূরদর্শনে ছন্দাদির সহকর্মী হই, তখন ছন্দাদিকে বলেছিলাম ঘটনাটা। শুনে সে কী হাসি! যেন বিশ্বাসই করতে চাইছিলেন না। আসলে নিজেকে কখনও সেলিব্রিটি ভাবতেন না। কিন্তু তিনি সত্যিই ইতিহাসে লিখে রাখা নাম। একজন কিংবদন্তি। মানুষ তাঁকে ভালবেসেছে। তিনি আমাদের মনে থাকবেন। কারণ তিনি আমার পুরোনো দিন। তিনি আমার ছোটবেলা।
গীতা মুখোপাধ্যায় ছিলেন আকাশবাণীর সংবাদ পাঠিকা। ছন্দা সেনের সহকর্মী। গীতা মুখোপাধ্যায়ের কন্যা ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য। কথায় কথায় জানালেন, মায়ের সঙ্গে খুব ছোটবেলা থেকেই আকাশবাণী যেতাম। সেখানেই প্রথম আমি ছন্দাদিকে দেখি। আলাপ হয়। পরবর্তী সময়ে ওখানে আমি কিছুদিন অ্যানাউন্সারের কাজ করি। তারপর কাজ শুরু করি দূরদর্শনে। অ্যানাউনসার ও নিউজ রিডার হিসেবে। ততদিনে ছন্দাদি পরিচিত মুখ। দূরদর্শনে একসঙ্গে কাজ করলেও, ছন্দাদির সঙ্গে যে খুব বেশি দেখাসাক্ষাৎ হত, তা নয়। বরং আমার মায়ের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ ছিল বেশি। ছন্দাদির ব্যক্তিত্ব অসাধারণ। উপস্থাপনা ছিল ঘরের মেয়ের মতো। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। সংবাদ পাঠ করে পেয়েছিলেন জনপ্রিয়তা। তার প্রধান কারণ অসাধারণ স্বরক্ষেপণ, স্বাভাবিকভাবে খবর পড়া। কোথাও কোনও নাটকীয়তা দেখা যেত না। তিনি আমাদের সাধারণভাবে খবর পড়ার পরামর্শ দিতেন। ওঁর কথা অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। বাংলায় সিরিয়াস ও মনোযোগী সংবাদপাঠ আবহের অন্যতম কান্ডারি ছিলেন ছন্দা সেন। কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০০৬ সালে। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। চলে গেলেন ৭৮ বছর বয়সে। তিনি নেই, তবে বহু মানুষের কানে আজও ধ্বনিত হয় তাঁর কণ্ঠস্বর, ‘খবর পড়ছি ছন্দা সেন।’

Latest article