অরণ্যের অধিকার

বাঘ সংরক্ষণ (Tiger conservation)  প্রকল্পের কারণে উৎখাত করা হয়েছে অরণ্যবাসীদের। কোপ পড়তে চলেছে আরও কয়েক হাজার অরণ্যবাসীর উপর। কেন্দ্রীয় সরকারের এই অমানবিক আচরণের বিরোধিতা করেছে কিছু সংগঠন। দাবি জানিয়েছে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের। দাবি পূরণ না হলে হয়তো আন্দোলনে নামবেন আদিবাসীরা। তাঁরা হারাতে চান না অরণ্যের অধিকার। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

অনায়াস সহাবস্থান
বাঘে-মানুষে একঘাটে জল? অকল্পনীয় ব্যাপার। তবে এমন ঘটনাও ঘটে। এক ঘাটে জল না খেলেও, এক অরণ্যে উভয়ের বসবাস নতুন কিছু নয়। আপাত হিংস্র মনে হলেও, বাঘ কিন্তু নিরীহ প্রকৃতির প্রাণী। এমনটাই দাবি গবেষকদের। খুব প্রয়োজন না পড়লে এই ‘বড় বিড়াল’ মানুষকে আক্রমণ করে না। আসলে বাঘ সম্পর্কে ভুল ধারণা সাধারণ মানুষের মনে চেপে বসেছে।
বাঘের ভয় নেই অরণ্যবাসীদের। এঁরা মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ের। বছরের পর বছর গভীর অরণ্যের আলোকালোয় কাটিয়ে দেন জীবন। বনাঞ্চলে ঘুরে সংগ্রহ করেন ফল, মধু, কাঠ ইত্যাদি। বনজ সম্পদে তাঁদের অধিকার রয়েছে। মাঝেমধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও, বাঘের সঙ্গে যাপন তাঁদের জীবনেরই অঙ্গ। এইভাবেই বাঁচতে তাঁরা অভ্যস্ত। তাই তো অনায়াস সহাবস্থান করেন মানুষখেকোদের সঙ্গে।

আরও পড়ুন-ত্রাণ বিলির নাটক গদ্দারের, চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা পুরশুড়ায়, ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী

যতটা বাঘের, ততটা মানুষের
মনে রাখতে হবে, অরণ্য যতটা বাঘের, ততটাই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের। এটা বিশ্বাস করেই তাঁরা জঙ্গল কামড়ে পড়ে থাকেন। যেতে চান না দূরে কোথাও। সভ্য নাগরিক সমাজ তাঁদের চেনে না, জানে না। তাঁরাও বোঝেন না সভ্য সমাজ-মন। গভীর দূরত্ব আঁকা দুই পক্ষের মধ্যে।
তবে জঙ্গলে খুব একটা স্বস্তিতে নেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এর পিছনে রয়েছে মানুষের মস্তিষ্ক। ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি (এনটিসিএ) গত ১৯ জুন একটি বিজ্ঞাপন জারি করেছে। তারা ৮৪৮টি গ্রামের ৮৯৮০৮ পরিবারকে চিহ্নিত করেছে এবং রাজ্য কর্তৃপক্ষকে বাঘ সংরক্ষণের মূল এলাকা হিসাবে বিজ্ঞাপিত এলাকার অভ্যন্তরে বসবাসকারী বাসিন্দাদের ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে’ স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দিয়েছে এবং দ্রুত এই কাজ রূপায়ণ করার আহ্বান জানিয়েছে। ফলে মাথায় বাজ অরণ্যবাসীদের। এই বাসিন্দারা বেশিরভাগই আদিবাসী এবং অন্যান্য বনে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত এবং বন অধিকার আইন, ২০০৬ [এফআরএ]-এর পাশাপাশি দ্য ওয়াইল্ডলাইফ (প্রোটেকশন) অ্যাক্ট, ১৯৭২-এ অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বনজ পণ্য ব্যবহার করার অধিকার রয়েছে।
কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রককে একটি চিঠি দিয়েছিল ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি। বক্তব্য ছিল, উপরে উল্লিখিত ৮৯৮০৮ পরিবার বাঘের আবাসস্থল বা মূল অঞ্চলে বসবাস করছে। ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটির বক্তব্য, জঙ্গলের মধ্যে মানুষের বসবাস ভারত জুড়ে বাঘ সংরক্ষণে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। অবিলম্বে স্থানান্তরিত করা হোক।
প্রসঙ্গত, বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের সূচনালগ্ন থেকে ২৫০০৭টি পরিবার-সহ ২৫৭টি গ্রামকে ইতিমধ্যেই অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এখন ৬৪৮০১টি পরিবার-সহ ৫৯১টি গ্রাম চিহ্নিত হয়েছে।
সংরক্ষিত অঞ্চল তৈরি
যাওয়া যাক অতীতে। ৫০ বছরের বেশি সময় আগে, ১৯৭৩-এ ‘প্রোজেক্ট টাইগার’ হাতে নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। প্রকল্পের শুরুতে বাঘের সংখ্যা ছিল ১৮২৭। এখন বেড়ে হয়েছে ৩১৬৭। ১৯৭২-এ সরকার বন্যপ্রাণী শিকার ও ব্যবসা রুখতে বিশেষ আইন প্রণয়ন করে। এর দ্বারা বনসম্পদ ব্যবহারের অধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংরক্ষিত অঞ্চল তৈরি করা হয়। যেমন জাতীয় উদ্যান, যেখানে জঙ্গলে বসবাসকারীদের বনজ সম্পদের উপর অধিকার নেই। অন্যদিকে রয়েছে অভয়ারণ্য, যেখানে অনুমতিক্রমে তাঁরা সীমিত বনজ সম্পদ ব্যবহার করতে পারেন।
কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ দফতর বাঘ সংরক্ষণের লক্ষ্যে এই আইন সংশোধন করে তৈরি করেছে ‘টাইগার রিজার্ভ’। বাঘ সংরক্ষণ পরিচালনায় তৈরি করেছে ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজার্ভেশন অথরিটি’। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে জাতীয় উদ্যান, টাইগার রিজার্ভ-এর ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছে। ১৯৭৩-এ নয়টি টাইগার রিজার্ভ নিয়ে শুরু হয় ‘প্রোজেক্ট টাইগার’। এখন মোট ১৯টি রাজ্যে ৫০টি টাইগার রিজার্ভ। ১৯৭২-এর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০০৬-এ সংশোধিত হয়, বৃদ্ধি পায় টাইগার রিজার্ভ।

আরও পড়ুন-সিবিআই-ইডির পর্দাফাঁস, অনুব্রতকে জামিন দিয়ে বলল প্রতিহিংসা

নামমাত্র পুনর্বাসন
সংরক্ষণবাদীদের বিশ্বাস, বাঘ সংরক্ষণ করতে গেলে সেখানে মানুষকে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। থাকতে দেওয়া যাবে না। ফলে টাইগার রিজার্ভ অঞ্চলে অধিবাসীদের জোর করে উৎখাত করা হচ্ছে। নামমাত্র পুনর্বাসন দিয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের মান অত্যন্ত খারাপ। কেন্দ্রীয় দফতর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন দ্বারা যুগ যুগ ধরে জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষের জমির অধিকারের ফয়সালা না করে, তাঁদের মতামত অগ্রাহ্য করে একের পর এক অঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করেছে। বন্যপ্রাণী ও মানুষের সহাবস্থান অসম্ভব, এই অবৈজ্ঞানিক মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে এই সব অঞ্চলে বাসিন্দাদের উৎখাত করা হচ্ছে।
২০০৬ থেকে টাইগার রিজার্ভের দ্রুত বৃদ্ধি ও জনজাতিদের উৎখাতের মাত্রা বৃদ্ধি শুরুর সময়ে তখনকার সরকার জঙ্গলের অধিকার ও পরিচালনায় জঙ্গলে বসবাসকারীদের নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে ‘বন অধিকার আইন ২০০৬’ প্রণয়ন করে— এই আইনে সব সংরক্ষিত অঞ্চলে জঙ্গলে বসবাসকারীদের অধিকার সুরক্ষিত। ‘ক্রিটিক্যাল ওয়াইল্ডলাইফ হ্যাবিট্যাট’ নামের কিছু এলাকাকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বাদ রাখা হয়। ওই এলাকার বাসিন্দাদের উৎখাত করতে হলে তাঁদের অনুমতি নিতে হবে, পুনর্বাসন প্রকল্প সম্পন্ন করার পরেই স্থানান্তরিত করা যাবে। কিন্তু আধিকারিকরা এই সব বিশেষ সংরক্ষিত অঞ্চলে বন অধিকার আইন প্রয়োগে অনিচ্ছুক। তাঁদের বিশ্বাস, মানুষের উপস্থিতিতে বাঘ সংরক্ষণ সম্ভব নয়।
ন্যাশনাল টাইগার কনজার্ভেশন অথরিটি বন আধিকারিকদের এক নতুন সংরক্ষিত অঞ্চল (ক্রিটিক্যাল টাইগার হ্যাবিট্যাট) তৈরির নির্দেশ দেয়, যেখানে মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই বাঘ সংরক্ষণ করা হবে। এখান থেকে মানুষকে উৎখাত করলে বন অধিকার আইনের শর্ত মানার প্রয়োজন নেই। ২০০৬-এর আইনে অবশ্য শুধু ইচ্ছুক অধিবাসীদের স্থানান্তর ও পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে। ২০০৮-এ স্থানান্তর ও পুনর্বাসন নিয়ে প্রকাশিত নির্দেশিকায় ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতি পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা বা সমমূল্যের জমি, বাড়ি করে দেওয়ার কথা বলা আছে। ২০২১-এ তা বাড়িয়ে ১৫ লক্ষ হয়েছিল। তথ্য বলছে, ২০০৮-২০১৯ সময়কালে ৫০টি টাইগার রিজার্ভ থেকে ১৭৩টি গ্রামের ১৪,৪৪১টি পরিবারকে এই প্রকল্পে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানান্তর ও পুনর্বাসনের নিয়ম মানা হয়নি। বাসিন্দাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ব্যাঘ্র প্রকল্পে অর্থের জোগান বাড়তে থাকায় এইসব অঞ্চলে বসবাসকারীদের অনুমতি পেতে নেওয়া হচ্ছে নানা কৌশল। স্থানান্তরের জন্য তাঁদের ক্রমাগত চাপ দেওয়া হচ্ছে। বন্ধ করা হচ্ছে যাতায়াতের রাস্তা। গরু-ছাগল আটকের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে পুনর্বাসন প্রকল্পে জঙ্গলের জমি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা রাজস্ব জমিতে পরিণত করা হয়নি। মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারি কল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে।

আরও পড়ুন-নাবালিকাকে অপহরণ চলন্ত বাসেই গণধর্ষণ

সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের এই পদ্ধতিতে বাঘ সংরক্ষণে কিছু সাফল্য এলেও, জনজাতিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি হয়েছে। নষ্ট হচ্ছে সংরক্ষিত অঞ্চলের জীববৈচিত্রও। গবেষণা বলছে, জীববৈচিত্র ঠিক রাখতে, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে স্থানীয় মানুষের যোগদান জরুরি। অথচ তা অস্বীকার করছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁদের সিদ্ধান্ত হয়ে উঠেছে মানুষের কল্যাণের বিরোধী, অমানবিক।
স্বাভাবিক কারণেই ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি (এনটিসিএ)-র সাম্প্রতিক পদক্ষেপে কপালে ভাঁজ অরণ্যবাসীদের। জঙ্গল ছেড়ে তাঁরা যেতে চান না। এইসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বেশকিছু সংগঠন। তারা ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি (এনটিসিএ)-র ‘অবৈধ’ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য, অনৈতিক কাজ করছে কেন্দ্রীয় সরকার। পদক্ষেপটি আদিবাসী সম্প্রদায়গুলিকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করবে। পিছিয়ে দেবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। রক্ষা করতে হবে আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার।
এই দাবি আরও জোরালো হবে। দাবি মানা না হলে নেবে আন্দোলনের চেহারা। আগামী দিনে হয়তো জোট বাঁধবেন অরণ্যবাসী আদিবাসীরা। তাঁরা সমস্বরে গর্জে উঠবেন— এই অরণ্য, এই মাটি আমাদের মা। কেউই ছিঁড়ে নিতে পারবে না আমাদের শিকড়।

Latest article