সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলা নদীমাতৃক অঞ্চল। নদীর উপর অনেক মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করে। সেই নদী যখন ভেসে গিয়ে বন্যায় কবলিত হয় লাখ লাখ মানুষ তখন স্বাভাবিক জীবনের প্রসঙ্গে নানান প্রশ্ন জেগে ওঠে। এই গৌরচন্দ্রিকার মূল কারণ বর্তমানে বাংলার ৮-১০ টি জেলায় বন্যার প্রাবল্য এবং সেখানকার জনপদের অসহনীয় জীবন। দামোদরের নিম্ন অববাহিকায় এবং তার কাছাকাছি অঞ্চলের প্রায় ১০০০ স্কয়ার কিলোমিটার অঞ্চল এবং ৫০ লক্ষ মানুষ এই বন্যায় প্রভাবিত হচ্ছে।সাধারণত প্রবল বৃষ্টি কিংবা জলাধারের থেকে অপরিকল্পিত জল ছাড়ার জন্য বন্যা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন-কুণালের কথা-সুর, তিন গানের অ্যালবাম এবার পুজোর চমক
পশ্চিমবঙ্গের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত রাজ্যের বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপ এবং জলবায়ুর কারণে অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হয়। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলায় সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয়। এই অঞ্চলগুলিতে বার্ষিক গড় প্রায় ৩৫০০ মিমি বৃষ্টিপাত হয়। পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় অঞ্চলগুলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুর এবং হাওড়ার জেলাগুলিতে তুলনামূলকভাবে কম বৃষ্টিপাত হয়। এই এলাকায় গড়ে প্রায় ১৫০০ মিমি বার্ষিক বৃষ্টিপাত হয়। কলকাতা, হুগলি, বর্ধমান এবং মুর্শিদাবাদ জেলাগুলি সহ রাজ্যের বাকি অংশে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত হয় প্রায় ১২০০-১৫০০ মিমি। লক্ষণীয় যে পশ্চিমবঙ্গে বার্ষিক বৃষ্টিপাত বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে এবছর যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে আর যতটা অঞ্চল বন্যাকবলিত তাদের মধ্যে সমানুপাতিক সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে না। আসলে ২০০৯ সালের বন্যা ও বৃষ্টির যে সমানুপাতিক সম্পর্ক দেখা গিয়েছিল তার পরবর্তীকালে বৃষ্টির গড় পরিমাপ ২০২৪ এ এসে খানিকটা কম। তাহলে এই বন্যা কেন? এখানেই মুখ্যমন্ত্রী অপরিকল্পিত বাঁধ নিয়ন্ত্রণ তথা জলাধার থেকে পরিকল্পনাহীন জল ছাড়া ঘটনাকে দোষী করেছেন এবং এই বন্যাকে ম্যানমেড বন্যা বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে পথে নামলেন পুজোর আয়োজকরা
নিয়ম অনুযায়ী ঝাড়খন্ড, বাংলা সরকার, পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকার এবং ডিভিসির প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটির মাধ্যমে জল ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয় (DVRRC)। প্রতিবছর বর্ষার সময় যে জল ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় জমে তা একদিকে ডিভিসি এবং অন্যদিকে ঝাড়খন্ড সরকারের বাঁধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলা এবং ঝাড়খণ্ডের সীমানায় দুটি জলাধার রয়েছে। একদিকে মাইথন বাঁধ বরাকর নদীর উপর অন্যদিকে পাঞ্চেত দামোদর নদীর উপরে জল নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু তার ওপরে তিনটে বাঁধ রয়েছে, ঝাড়খণ্ডের সীমানায়। একটা তিলাইয়া। তিলাইয়া বাঁধের জল মাইথনে আসে। তিলাইয়া ডিভিসি নিয়ন্ত্রিত। তার পাশাপাশি রয়েছে কোনার বাঁধ। কোনার বাঁধ থেকে জল আসে পাঞ্চেতে। কোনারের পাশাপাশি আরও একটি বাঁধ রয়েছে, যার নাম তেনুঘাট। মনে রাখা জরুরি, তেনুঘাট কিন্তু ডিভিসির পরিচালনাধীন নয়। এটি পরিচালিত করে ঝাড়খন্ড সরকার। সেখান থেকেও জল পাঞ্চেতে আসে। তেনুঘাট থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছিল ১৬-১৭ তারিখে। স্বাভাবিকভাবেই সেই জল পাঞ্চেতের জলস্তর বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ডিভিসি প্রায় ২ লক্ষ থেকে ২.৫ কিউসেক জল ওই সময় ছেড়ে দেয়। সবমিলিয়ে মোট ৫ লক্ষ কিউসেক (প্রায়) জল ছাড়া হয়েছে। কিন্তু ওই সময় ওই পরিমাণ জল না ছাড়লেও জলাধারের ধারণ ক্ষমতায় সমস্যা হতো না। এইখানেই তৈরি হয় নতুন বিতর্ক।
আরও পড়ুন-২,১৮৩ থেকে ১১৭ টাকা বাড়িয়ে করা হল ২,৩০০ টাকা, ধানের সহায়ক মূল্য বাড়াল রাজ্য
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ২০ তারিখ (২০/৯/২৪) প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানান যে তিনি ডিভিসির কর্তাকে স্বয়ং নিজে ফোন করে নির্দিষ্ট জলসীমা অতিক্রম হওয়ার আগেই জলাধার থেকে জল না ছাড়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু সেই অনুরোধের কোন তোয়াক্কা না করেই ডিভিসি কর্তৃপক্ষ একপাক্ষিক সিদ্ধান্তে জল ছেড়ে দেয় এবং তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়। এরপর জলশক্তি মন্ত্রক থেকে জানানো হয় যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অবহিত করেই জল ছাড়া হয়েছে। কিন্তু যেখানে প্রশ্ন থেকে যায় তা হল, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী যখন ডিভিসির কর্তাকে ফোন করছেন, অনুরোধ করছেন যাতে পরিকল্পনা বিহীন ভাবে জলাধার থেকে জল না ছাড়া হয়; তখন তার থেকে বড় কোন প্রশাসক আছেন যাকে জল ছাড়া সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে! এখানেই সমন্বয়ের প্রসঙ্গ জরুরি এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সদিচ্ছার অভাবের তথা মিথ্যাচারের বিষয় পরিষ্কার হয়। তবুও পুনরায় ২১/০৯/২০২৪ তারিখে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে নির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে জানান যে তিনি কাকে, কোন সময় জলধারের জল ছাড়া থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন। উক্ত চিঠিতে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী পরিষ্কার জানিয়েছেন যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অবহিত না করেই এক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকার একপাক্ষিক ভাবে জলধার থেকে জল ছেড়েছে।
উল্লেখ্য মাইথন ব্যারেজে ৪৯৫ ফুট এবং পাঞ্চেতে ৪২৫ ফুট জলস্তরকে স্বাভাবিক ধারণযোগ্য স্তর বলা। সেই স্তর পার করলে তা বিপদসীমার উপরে যায় এবং তখনই জল ছাড়ার বাধ্যতা তৈরি হয়। কিন্তু কিন্তু এক্ষেত্রে অর্থাৎ ১৬-১৭ তারিখে পাঞ্চেতের জলস্তর ৪২৫ ফুট অবধি পৌঁছালেও মাইথনের জলস্তর ৪৮৭ ফিটও পার করেনি। কিন্তু ২০২১ সালে পাঞ্চেতে ৪৩০ ফুটের ওপরে জলস্তর গিয়েছে। তখন কিন্তু এ হেল ভাবে ব্যাপক অঞ্চল প্লাবিত হয়নি। স্বাভাবিক কারণেই মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক ছিল। তাহলে প্রশ্ন ওঠে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে অনুরোধ গেলেও কেন সেই অনুরোধ রাখা হলো না বরং সরকারকেই ঘুরিয়ে দোষারোপ করা হলো কিন্তু তার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ জনসমক্ষে আনা হয়নি। যদিও পূর্বেই উল্লেখিত মুখ্যমন্ত্রী ২১ তারিখে তাঁর চিঠিতে যাবতীয় তথ্যের উল্লেখ করেছেন। যাকে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এখনও নাকচ করা হয়নি। এখানেই সত্য মিথ্যা পরিষ্কার হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২১ তারিখেই উক্ত চিঠিতেই ডিভিআরআরসি থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব তুলে নেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী এবং তারপর দুজন আধিকারিক সেখান থেকে পদত্যাগ করেছেন।
আরও পড়ুন-দাবা অলিম্পিয়াডে জোড়া সোনা ভারতের
ডিবিসির কর্মকর্তারা জলের পরিমাপ মাপা ও বন্যা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যর্থ একথা তিনি বারবার স্মরণ করিয়েছেন। একইসঙ্গে পাঞ্চেত ও মাইথনের রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রেও যে সমস্যা রয়েছে তার সমাধান হয়নি। সর্বাত্মক বন্যা ব্যবস্থাপনা প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকার যেভাবে রাজ্য সরকারকে বঞ্চনা করে এসছে তা আজ সর্বজনবিদিত ইতিমধ্যে ২০২২ সালের জুন মাসে উত্তর দিনাজপুর দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদা ও তৎসহ ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান সম্পাদন করার জন্য রাজ্য সরকারের তরফে কেন্দ্র সরকারকে বারংবার প্রজেক্ট রিপোর্ট দেওয়া হলেও কেন্দ্র সরকারের তরফে কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সবুজ সংকেত দেওয়া হয়নি। অবশ্য ইতিমধ্যেই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান শুরুর কাজে হাত দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাধ্যমেই। কিন্তু কেন্দ্র সরকার বন্যা ব্যবস্থাপনা ও সীমান্ত এলাকা প্রকল্পে (FMBAS) উক্ত পরিকল্পনাকে এখনও অন্তর্ভুক্ত করেনি। আবার মুর্শিদাবাদের লালগোলা ব্লকে গঙ্গা পদ্মা নদীর ভাঙ্গন রোধে কেন্দ্রীয় সরকারের সীমান্ত এলাকায় নদী ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে (RMBA) ১০০% অর্থ অনুমোদনের কথা; যা আজ অবধি কেন্দ্র সরকার রাজ্যকে দেয় নি।
আরও পড়ুন-ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আমতার জলভাসি মানুষদের পাশে ‘অভিষেকের দূত’
নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, বাঁধ তৈরি, ভাঙ্গন রোধ, বন্যা সমস্যার মোকাবিলা প্রভৃতির জন্য কেন্দ্র রাজ্য সমন্বয় অত্যাবশ্যক। রাজ্যের তরফ থেকে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন ফোরামে; যেমন ইস্টার্ন জোনাল কাউন্সিল, নীতি আয়োগ প্রভৃতিতে; গত ১০ বছর কেন্দ্রীয় সরকারকে বিভিন্নভাবে রাজ্যের বক্তব্য জানিয়েছে। সহযোগিতার জন্য সাংবিধানিক নিয়ম মনে করিয়েছে। তথাপি কেন্দ্রের তরফে সাড়া দেওয়া হয়নি ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ৪৫০ কোটির কিছু বেশি অর্থ এজন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। যা সার্বিক খরচের ১০%ও নয়। স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্র সরকারের সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্র তথা অর্থনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নিয়ম লঙ্ঘনের রীতি সমানভাবে চলছে। এ সময় হাতে হাত রেখে কাজ করার সময়। কিন্তু কেন্দ্র সরকার সমান্তরাল বঞ্চনা চালিয়ে যাচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সকল স্তরের নেতাকর্মী, বিধায়ক, সাংসদ তৎসহ আশা কর্মীরা জলে নেমে মানুষের সেবায় রত রয়েছেন। অন্যদিকে শুভেন্দু অধিকারী, বিরোধী দলনেতা, যাকে বিজেপি চোর বলেছিল, সে বলে বেড়াচ্ছে ২০২৬ সাল থেকে বন্যা হতে দেবে না! এ কথা থেকে পরিষ্কার যে কেন্দ্রের হাতে বন্যা রোধ করার ক্ষমতা রয়েছে। অবশ্য বারংবার এক নারীর হাতে পরাস্ত হয়ে পুরুষতান্ত্রিক বিজেপি দল বাংলাকে ক্ষতির সম্মুখীন করছে। সে ১০০ দিনের কাজের টাকা হোক কিংবা মাথায় ছাদ অথবা বন্যা রোধ। তাই বাংলার মানুষ এ কথা ভুলবে না যে, কিভাবে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আমাদের দিদি মানুষের সেবায় বন্যা মোকাবিলায় এবং ত্রাণ সরবরাহে মাঠে নেমে মানুষের পাশে থাকছেন।