অকালবার্ধক্য!
হুঁ, তাই বটে। বার্ধক্য কার ভাল লাগে বলুন তো—
বার্ধক্য মানেই, বয়সটা বেড়ে গেলে/ হারিয়ে যায় আনন্দ/ কেউ করে অবহেলা/ কেউ বলে অন্ধ/ কেউ ডাকে বুড়ো বলে/ কেউ করে ব্যঙ্গ! তার উপর আবার সেই বার্ধক্য যদি বাচ্চা বেলাতেই এসে যায়— এই যেমনটি প্রজেরিয়ার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। শৈশব থেকেই শরীরে দেখা দেয় বার্ধক্যের করুণ ছাপ! মন এখনও শিশু অথচ শরীরের বিকৃত গঠন যেন বাচ্চাটিকে বৃদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করছে। হুঁ, প্রজেরিয়ার জন্যই এমনটা হয়; এটি একটি অত্যন্ত বিরল প্রগতিশীল জিনঘটিত রোগ, বলা ভাল সমস্যা, যার দরুন মানবদেহে নানাবিধ রোগের সঞ্চার হয়।
আরও পড়ুন-শাহের মন্তব্যে প্রতিবাদ ওপারে
প্রজেরয়েড সিনড্রোম
আমাদের শরীরের মধ্যে কোষের অভ্যন্তরে অনেক কারণেই নানারকম জিনগত পরিবর্তন দেখা দেয়, যার ফলে অনেকসময় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানবদেহের শারীরবৃত্তীয় প্রাকৃতিক বয়সকালের অস্বাভাবিক পরিবর্তনজনিত লক্ষণ, যদিও এই ঘটনা বিরল; এদেরকে একত্রে ‘প্রোজেরয়েড সিনড্রোম’ বলা হয়ে থাকে। এইরকমই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিরল জিনগত প্রোজেরয়েড সিনড্রোমই হল প্রজেরিয়া, যা যথার্থ ভাবেই মানবদেহের অপরিণত বৃদ্ধাবস্থার অনুরূপ।
প্রাথমিক লক্ষণ
শিশু জন্মের ৯-২৪ মাসের মধ্যেই তার দেহে এই রোগের লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে। দেহে হাড় এবং মাংসপেশির বৃদ্ধি ঠিকমতো না হওয়ায় সামগ্রিক দৈহিক বৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যায়; তবে আশ্চর্যের বিষয় শরীরের স্নায়বিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি কোনওপ্রকার ব্যাহত হয় না। নির্দিষ্ট বয়স অনুপাতে উচ্চতা এবং ওজন গড় উচ্চতা এবং ওজনের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পায়। ত্বকের নিচে চর্বি শেষ হয়ে যায় এবং চামড়া শক্ত এবং কুঁকড়ে যায়। চোয়াল, থুতনি, মুখ ও ঠোঁট ছোট হয়ে যায়; মুখমণ্ডলের তুলনায় মাথা অনেক বড় হয়ে যায়। নাক বেঁকে গিয়ে পাখির ঠোঁটের মতো দেখতে লাগে; চোখ, চোখের পাতা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় ফলে পুরোপুরি চোখ বন্ধ করা যায় না। গলার স্বর চড়া হয়ে যায়, শরীরের সব জায়গার লোম ঝরে পড়ে, এবং এমনকী শিরা উপশিরাগুলো চামড়ার উপর দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায়। দেখে মনে হয় যেন অকালেই বার্ধক্য নেমে এসেছে; তবে সচেতন ভাবে যদি প্রাথমিক কিছু লক্ষণ দেখে সন্দেহের বশে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যায় তবে অকালবার্ধক্যজনিত অকালমৃত্যুর হার অনেকটাই কমানো সম্ভব হয়েছে আজকাল।
আরও পড়ুন-বদলাপুর, এনকাউন্টার কি আসলে সাজানো গল্প?
রোগ পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য
প্রজেরিয়া শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘প্রো’ অর্থাৎ অকাল বা অপরিণত এবং ‘জেরাস’ অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়স শব্দ দুটি থেকে। এই বিরল জিনগত রোগটির সর্বপ্রথম বর্ণনা দেন ইংরেজ সার্জেন, প্যাথোলজিস্ট, অপথ্যালমোলজিস্ট এবং ডার্মাটোলজিস্ট ড. জোনাথন হাচিনসন সেই ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। এরপর ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনভাবে এই রোগটি সম্পর্কে বিশদ ধারণা দেন ইংরেজ সার্জেন ড. হেস্টিংস গিলফোর্ড। এই দুই ডাক্তারবাবুর নামানুসারে এই রোগটিকে হাচিনসন-গিলফোর্ড সিনড্রোম বা হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রজেরয়েড সিনড্রোম বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও এই রোগটি প্রজেরিয়া সিনড্রোম বা জোসেফ সিনড্রোম নামেও পরিচিত।
কোষ মধ্যস্থিত মাত্র একটি জিনের অপ্রাকৃতিক পরিবর্তনের জন্যই এই রোগটি হয়ে থাকে। ওই জিনটির নাম ‘লামিন এ’ যা কোষের কেন্দ্রে নিউক্লিয়াসকে একত্রে ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় প্রোটিনের জোগান দেয়। দুর্ভাগ্যবশত ওই নির্দিষ্ট জিনটির অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণে ‘প্রোজেরিন’ নামক অন্য একটি প্রোটিন উৎপাদন করে, যা কোষের গঠনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে; ফলস্বরূপ প্রজেরিয়ার বার্ধক্যজনিত সমস্যাগুলো দেখা দিতে শুরু করে। তবে আশার আলো এই যে, এইরূপ জিনের পরিবর্তনের জন্য কোনওপ্রকার অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক পরিবেশগত কারণ দায়ী নয়; এটি অকস্মাৎ হয়ে থাকে যে কোনও শিশুর দেহে। আরও ভাল খবর হল, অন্যান্য প্রজেরয়েড সিনড্রোম যেমন, ওয়াইডমান-রাউশেনস্ট্রাউচ সিনড্রোম বা নিওন্যাটাল প্রজেরয়েড সিনড্রোম ও ওয়ার্নার সিনড্রোম বা অ্যাডাল্ট প্রজেরিয়ার মতো হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রজেরিয়া বংশগত নয়। এই রোগের ক্ষেত্রে আক্রান্ত জিনটি পরবর্তী প্রজন্মের দেহে বয়ে যায় না।
আরও পড়ুন-একাধিক প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে মালদহের জেলাশাসক
এই রোগের কারণে আক্রান্তের দাঁতের গঠন বিকৃত হয়ে যায় এবং গাঁট অনমনীয় হয়ে ওঠে, ইনসুলিন হরমোন ঠিকমতো তৈরি হয় না, বয়ঃসন্ধির ছাপ স্পষ্ট হয় না, নিতম্বের গঠন নষ্ট হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে মারাত্মক হল, ধমনীর গাত্র পুরু এবং শক্ত হয়ে ওঠা। এর ফলে ধমনী নানারকম পুষ্টিকণা ও অক্সিজেন-সহ বিশুদ্ধ রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে মানবদেহের বাকি অংশে এবং মস্তিষ্কে ঠিকঠাক পৌঁছে দিতে পারে না; ফলত হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের শিকার হন এই রোগীরা। জন্মের একবছরের মধ্যেই মোটামুটি সব লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে এবং গড়ে প্রায় ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে ওরা।
চিকিৎসা ও আশার আলো
প্রজেরিয়া নির্মূলকরণের কোনও পথ্য বা পন্থা এখনও পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের হাতে আসেনি; তবে এই রোগের ব্যবস্থাপনা এবং উপসর্গজনিত সুস্থতার লক্ষ্যে আজকের অত্যাধুনিক চিকিৎসা এবং গবেষণা যথেষ্ট উপযোগী বলে প্রমাণিত। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে স্যাম বার্নস নামে একটি প্রজেরিয়া আক্রান্ত শিশু তাঁর পিতামাতা ও আন্টির সহায়তায় দ্য প্রজেরিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশন গড়ে তোলেন এবং এই সংস্থাটি ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ওই বিশেষ জিনের পরিবর্তনটি আবিষ্কার করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে সেটা নির্ণয়ের জন্য একটি ‘ডায়াগনস্টিক টেস্টে’রও উদ্ভাবনা করেন। আক্রান্তের দেহের শুগার টেস্ট, ডিএনএ সিক্যুয়েন্স, ক্রোমোজোম স্ট্রাকচার, আরএনএ অ্যানালিসিস, জিন এক্সপ্রেশন, বায়োকেমিক্যাল প্রোটিন অ্যানালিসিস প্রভৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এই রোগ চিহ্নিত করা হয়।
আরও পড়ুন-পর্যটকদের সুবিধায় কোচবিহার পুরসভার একগুচ্ছ উদ্যোগ
২০২০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ‘লোনাফার্নিব’ বলে একটি ওষুধকে প্রাথমিকভাবে এই রোগের হাত থেকে মৃত্যুসংখ্যা কমানোর জন্য ব্যবহারের অনুমোদন দেয়; এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অনুমোদন দেয় ২০২২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। এই ওষুধটির রাসায়নিক নাম ‘সি২৭এইচ৩১বিআর২সিএলএন৪ও২’। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে প্রজেরিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, এই রোগটি পৃথিবীতে প্রতি ৫-১০ মিলিয়নে একজনের হয়ে থাকে, তবে ভারতবর্ষের সংখ্যাটা তুলনামূলক বেশি অন্যান্য দেশের তুলনায়। গোটা দেশের মোট আক্রান্তের প্রায় এক-চতুর্থাংশ! বর্তমানে সিম্পটোমেটিক ট্রিটমেন্টের তৎপরতার জন্য অনেক রোগীই সুস্থ আছেন; তবে পরিসংখ্যান বলছে এই রোগে আক্রান্ত বহু শিশু আজও চিকিৎসা ব্যবস্থার বাইরে, যে কোনও গাফিলতির জন্যেই হোক। এটা কাম্য নয়— প্রজেরিয়ার কারণে শুধুমাত্র রোগীর শারিরীক কষ্ট হয় তা নয়, সে সবসময় মানসিক যন্ত্রণাতেও ভোগে; তাই রোগীর সঙ্গে কোনওপ্রকার সামাজিক দূরত্ব বা বিদ্বেষ না রেখে আমাদের মানবিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় শ্রেয়, এতে সুস্থ সমাজ গড়ে উঠবে।