অগ্নিপুরুষের দেখানো পথেই অগ্নিকন্যা এগিয়ে চলেছেন

আত্ম-অহমিকার প্রাবল্যে ছদ্ম-ধার্মিকতার প্রচণ্ডতায় ভারতবর্ষ যখন আক্রান্ত, তখন আমাদের রাজ্যে জননেত্রী মানবিক ও জনকল্যাণের পথে এগিয়ে চলেছেন। তাঁর কর্মকাণ্ডে দ্যোতিত হচ্ছে বিদ্যাসাগরীয় আদর্শের বৈভব। লিখছেন প্রসেনজিৎ রায়

Must read

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (Ishwar Chandra Vidyasagar) দ্বিশত জন্মবার্ষিকী পার করে আজ এক অন্যরকম ভারতবর্ষে এসে পৌঁছেছি আমরা। আত্ম-অহমিকায় ও ছদ্ম-ধার্মিকতায় কেউ কেউ নিজেকে ‘ঈশ্বরের বরপুত্র’ ঘোষণা করতেও যখন দ্বিধা করছেন না, তখন জাতীয় স্তরের এই নির্লজ্জতাকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে চ্যালেঞ্জ ছুঁডে় দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, নানা মানবিক প্রকল্প প্রচলন ও রূপায়ণের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের সেবাধর্ম ও মানবমন্ত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে।

সারা বিশ্বে সমাদৃত ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প ‘দয়ার সাগর’ ঈশ্বরচন্দ্রের (Ishwar Chandra Vidyasagar) নারী- শিক্ষাপ্রসারের আদর্শের প্রতিধ্বনি। বাল্য-বিবাহ রোধ করার যে সামাজিক আন্দোলন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে অঙ্কুরিত হয়েছিল, আজকের বাংলার ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প চালু করে প্রায় দুশো বছর আগে বিদ্যাসাগর প্রদর্শিত পথেই উন্নয়নের আলোকবর্তিকা হাতে সেই আন্দোলনে অগ্রসর হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধুমাত্র অর্থের অভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে, রাজ্যের কোনও কন্যাকে এই পরিণতির মুখোমুখি হতে তিনি দেবেন না। ২০১৩ সালে চালু হওয়ার পর গত সপ্তাহ পর্যন্ত তিন কোটি তিন লক্ষ তেষট্টি হাজার নব্বই জন কন্যা, এই কন্যাশ্রী প্রকল্পের তিনটি পর্যায়ের দ্বারা উপকৃত হয়েছে। ‘শিশু বিবাহ’ নিষিদ্ধকরণ আইন ২০০৬-এর সফল রূপায়ণে কন্যাশ্রী প্রকল্প যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তার স্বীকৃতি সারা বিশ্ব জানাতে ভোলেনি, নিজস্ব অভিজ্ঞতায় এক কন্যাশ্রী-প্রাপক ছাত্রী বা তার আত্মজনই উপলব্ধি করেন, পড়াশুনো চালিয়ে যেতে এই বৃত্তি কতটা বল-ভরসা হয়ে দাঁড়ায়! শুধু বিদ্যালয়–স্তরের ছাত্রীরা নয়, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যলয় স্তরের পড়াশুনোর জরুরি ব্যয়ভার বহনে এই প্রকল্প আমাদের মেয়েদের অন্যতম ভরসার কারণ। কন্যাশ্রী প্রকল্পের বাস্তাবায়নের পথ ধরে ২০২০ সালে মানবিক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে স্থাপিত হয় কন্যাশ্রী বিশ্ববিদ্যালয়। শুধুমাত্র মেয়েদের লেখাপড়ার আঙ্গিনায় ধরে রাখা নয়, তারা যাতে কলেজস্তর পেরিয়েও উচ্চশিক্ষার দুনিয়ার অক্লেশে প্রবেশের সুযোগ পায়, সেইজন্য কেবলমাত্র ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষেই ৪২,৭৮৩ জনকে কন্যাশ্রী-৩ বৃত্তির আওতায় এনে অর্থ সাহায্য প্রদান করেছেন মানবিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। ২০১০-১১ সালে যেখানে মাত্র ৭৪২৩ জন স্বামী বিবেকানন্দ মেধা-সঙ্গতি বৃত্তি (SVMCM) পেয়েছিল সেখানে ২০২২-২৩ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৮,৮১,০৪৭ এবং এই সুবিশাল বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য অংশের প্রাপক হল আমাদের কন্যাসন্তানেরা, গত ১২টি শিক্ষাবর্ষ পেরিয়ে এখন এই বৃত্তি প্রদানের জন্য ১৪৩০ কোটি টাকা খরচ হয়, যেখানে ২০১০-১১ সালে খরচ হয়েছিল ৯.৪৫ কোটি টাকা।

আমরা জানি, যুগপুরুষ বিদ্যাসাগর বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের সেই ঘর্মাক্ত অধ্যায়ে ব্রিটিশ সরকারের সাথে রীতিমতো মসিযুদ্ধ করেও তাঁর স্থাপিত বিদ্যালয়গুলির জন্য ব্রিটিশদের দিয়ে অর্থবরাদ্দ করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সেই অনুরোধে কর্ণপাত করেনি বলে ১৮৮৫ সালের ৫ অগাস্ট তিনি ব্রিটিশ শিক্ষাবিভাগের ডাইরেক্টর ইয়ং গর্ডন–এর কাছে সরকারি পদ থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন। শিক্ষার বিস্তারে, জনকল্যাণে যিনি এতটুকু বাধা সহ্য করতে পারেননি যুগনায়ক সেই বিদ্যাসাগরের জন্মভূমিতে, তাঁর পবিত্র স্পর্শে ধন্য মাটিতে গত ১২ বছরে ৫২টি নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ১৯টি সরকার-পোষিত বিশ্ববিদ্যালয় ও ১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ ২০১০-১১ সালে ছিল ১২০ কোটি টাকা, যা গত ২০২৩-২৪-এ বেডে় দাঁডি়য়েছে ১৩১১.৪০ কোটি টাকা। এই বিপুল বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করেছে বালিকা তথা ছাত্রী, সার্বিকভাবে নারী শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত উন্নয়ন, যা আসলে বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন ও আদর্শের ধাত্রে গ্রথিত। ভাবতে অবাক লাগে, ২০২২-২৩ সালে একাদশ-দ্বাদশে নথিভুক্ত ছাত্রীদের সংখ্যা ছাত্রদের সংখ্যার তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশি ছিল (ছাত্রী : ছাত্র লিঙ্গ সমতা সূচক বা GPI ১.২৯)। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে এই GPI ছিল ০.৮৭ অর্থাৎ ছাত্রীদের শতকরা হার ছাত্রদের তুলনায় ১৩ শতাংশ কম ছিল। কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প কীভাবে সাফল্য অর্জন করেছে, তা বিশ্বব্যাঙ্কের এই GPI সূচক থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়।

ড্রপ আউট বা বিদ্যালয়-ছুটের হার সংক্রান্ত নিচের পরিসংখ্যানটি দেখলেই বোঝা যাবে, বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রীদের ধরে রাখা গেছে। নিছক আর্থিক কারণে লেখাপড়া ছেডে় দেওয়ার ঘটনা ২০১১ থেকে গত ১২ বছরে অনেকটাই কমেছে, প্রাথমিক ও উচ্চ-প্রাথমিকস্তরে তা শূন্যে নেমে এসেছে।

আরও পড়ুন- পয়সার জন্য কোর্টে চলে যান! বিকাশকে তুলোধনা মুখ্যমন্ত্রীর

২০১১-র পর থেকে ২০২৩ পর্যন্ত নতুন ১০৮১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬০৭০ নতুন উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে। বিভিন্ন স্তরের বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ ২,১৭,৫২৬টি স্থাপিত হয়েছে, যাতে গ্রাম-বাংলা শহর-নগরের একটি শিশুও শিক্ষার পরিসরে প্রবেশ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। ওই ১২টি বছর সময়কালে ৭৫৮টি বিদ্যালয় মাধ্যমিক থেকে উচ্চ-মাধ্যমিকে উন্নীত হয়েছে।

‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পে বাংলার মায়েরা যে অর্থরাশি অর্জন করেন তা তাঁদের মনে শক্তি জোগায়, পায়ের তলার মাটিকে দৃঢ় করে আর এই দৃঢ়ীকরণ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন ছিল। ঘরে ঘরে খোঁজ নিলে জানা যায়, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পাওয়া মায়েরা অনেকেই ‘বাংলার মেয়ে’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপহার সন্তানের পড়াশোনার কাজেই ব্যয় করেন।

বিদ্যালয়ে সহজে পৌঁছানোর জন্য একটি সাইকেল ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষালয় তথা শিক্ষার অনেক কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। তাই ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পে পাওয়া সাইকেল কম সময়ে স্কুলে পাডি় দেওয়ার অবলম্বন বহু বালক-বালিকার কাছে। তপসিলি জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু অনগ্রসর শ্রেণির ছাত্রীদের জন্য এবং বিপিএল পরিবারভুক্ত ছাত্রীদের জন্য ২৩৫টি হস্টেল সক্রিয় রয়েছে, ২০২৩ সালেই আরও ৫১টি নির্মীয়মাণ অবস্থায় রয়েছে।

উচ্চশিক্ষায় ২০১০-১১ সালে যেখানে নথিভুক্ত ছাত্রীর সংখ্যা ছিল, ৫.৬২ লক্ষ সেখানে ২০২১-২২ সালে এই সংখ্যা বেডে় হয় ১৩.৩৫ লক্ষে। উচ্চশিক্ষায় নথিভুক্ত সকলের মধ্যে শতকরা হারে ছাত্রীরা ২০২১-২২ সালে ৫০.৮৩%, যেখানে ২০১০-১১ সালে এই হার ছিল ৪১ শতাংশ।

২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ২০২৩ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় বাংলার ছাত্রছাত্রীরা বিনামূল্যে পেয়েছে এক কোটি পঁচিশ লক্ষ ব্যাগ, বিনামূল্যে পেয়েছে ১১ কোটি ৯৯ লক্ষ ইউনিফর্ম, পেয়েছে দু’কোটি চল্লিশ লক্ষ জুতো। অনেকেরই মনে আছে, জেলা সফরের সময় কোনও স্কুল-পড়ুয়া শিশুদের গ্রামের পথে খালি পায়ে হাঁটতে দেখে তাদের বিনামূল্যে জুতো বিতরণ করার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

শিক্ষা-সংক্রান্ত যাবতীয় প্রকল্পগুলির পাশাপাশি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (Ishwar Chandra Vidyasagar) কল্যাণব্রত স্পর্শ লেগে আছে বিধবা ভাতার প্রকল্পটিতেও, হঠাৎ করে অসহায় হয়ে পড়া মায়েরা যাতে কিছুটা হলেও সুরাহা পান, সেজন্য লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প ও বিধবা ভাতার টাকা একই সাথে পাওয়া যেতে পারে ৬০ বছরের কম বয়সি মহিলাদের জন্য এ-সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রমাণ করে দেয় অনাথ-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে যাঁর এক মুহূর্ত দেরি হয় না, বাংলার অগ্নিকন্যা সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দয়ার সাগর, অগ্নিপুরুষ বিদ্যাসাগরের ঐতিহ্যের যোগ্য ও সার্থক অনুসারী আর বলা বাহুল যে বিদ্যাসাগরের স্পর্শে পূত-পবিত্র বাংলার মাটিতে তিনি বিভেদ, বিদ্বেষ বা হিংসাকে একটুও স্থান পেতে দেবেন না, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রখর আদর্শ ও স্মৃতি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই সুরক্ষিত ও নিরাপদ।

Latest article