রথযাত্রা, গণেশ পুজো আর বিশ্বকর্মা পুজো পেরলেই মা দুর্গার আগমনের কাউন্ট ডাউন শুরু। কৃষ্ণ পক্ষের অবসান হয়ে সূচনা হয় দেবী পক্ষের। মা দুর্গার আরাধনার পাশাপাশি এই সময় নবরাত্রি পালিত হয় গোটা দেশ জুড়ে।
মহামায়া সনাতনী
শক্তিরূপী গুণময়ী
শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত দুর্গার ন’টি রূপের পুজো করা হয়ে থাকে। একেই নবরাত্রি উৎসব বলে। নব অর্থাৎ ন’টি রাতের উদযাপন। ভক্তেরা ন’দিন ধরে রাতের জাগরণ করেন এই সময়।
শরৎকালে হয় বলে কেউ কেউ আবার একে শারদ নবরাত্রিও বলে থাকে। নবরাত্রি বছরে দু’বার হয়। চৈত্র নবরাত্রি ও শারদ নবরাত্রি। শারদ নবরাত্রিতে প্রতিপদ তিথি থেকে দেবীর কল্প আরম্ভ করে মহানবমী তিথি পর্যন্ত দেবীর মাহাত্ম্য পাঠ এবং দেবীর পুজো হয়ে থাকে। ব্রহ্মা মা দুর্গার এই ন’টি রূপের নামকরণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন-দুঃস্থ পড়ুয়াদের জন্য পাঠশালা, শিক্ষাদানে অনন্য নজির বলাগড়ের সিভিক ভলান্টিয়ার হীরালালের
নানা রূপে শঙ্করী
মূলত এই পুজোর অর্থ শক্তির আরাধনা। নবরাত্রির পরদিন বিজয়া দশমীতে এই শক্তি পুজো শেষ হয়। দেবী দুর্গার ন’টি আলাদা রূপের পূজার্চনা হয়ে থাকে। নবরাত্রি উৎসব পালনের সঙ্গে সঙ্গে রঙের উৎসবের এক বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। প্রথম নবরাত্রির দিনকে বলা হয় প্রতিপদ। শৈলপুত্রী বা পর্বত- কন্যার এই দিনেই আরাধনা হয়ে থাকে। এইরূপে তিনি মহাদেবের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে পুজো পেয়ে থাকেন। প্রতিপদে দেবীকে লাল রঙের শাড়িতে সাজানো হয়। লাল রং হল শক্তি ও উদ্দামের পরিচায়ক। দ্বিতীয় দিনে মা ব্রহ্মচারিণী হলেন ইতিবাচকতা ও মননশীলতার প্রতীক। এই দিনের রং হল ময়ূরকণ্ঠি অথবা গাঢ় নীল। তৃতীয়দিনে মা চন্দ্রঘণ্টা লক্ষ্যে নিবদ্ধ। তৃতীয় দিনে দেবী দুর্গা চন্দ্রঘণ্টা রূপে আবির্ভূতা হন। এইরূপে দেবীর কপালে থাকে অর্ধচন্দ্র। যা কিনা অসীম সাহস ও সৌন্দর্যের প্রতীক। হলুদ হল এই দিনের রং। যা কিনা উজ্জ্বলতার প্রতীক ও সবার মনকে করে তোলে উদ্দীপ্ত। ভক্তরা এই দিনে হলুদ বা জাফরান রঙের পোশাক পরিধান করেন। চতুর্থীতে মা কুষ্মান্ডা সৃজনশীলতার প্রতীক। তিনি প্রকৃতির দেবী। তাই এই দিনের রং হল সবুজ। মনে করা হয় দেবীর হাসিতে এই পৃথিবী হয়ে উঠেছে সবুজ শ্যামল ও সুফলা। ভক্তেরা সবুজ অথবা বাদামি রঙের পোশাক পরেন এই দিন। নবরাত্রির পঞ্চম দিনে দেবী দুর্গা স্কন্দমাতা অবতারে অবতীর্ণ হন। অভয়দায়িনী মায়ের বাহুতে থাকেন শিশু কার্তিক। এই দিনের রং হল ধূসর। এমনই একমাত্র রূপ যেখানে নিজের সন্তানের কোনও সংকটে মা ঘূর্ণি রূপে সব ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখেন। বাহুবলদাত্রী মা অভয়দাত্রীরূপে সন্তানকে সুরক্ষিত রাখেন। মা কাত্যায়নী হলেন ধার্মিকতার প্রতীক। ষষ্ঠ দিনে দেবী দুর্গার কাত্যায়নী রূপ ধারণ করেন। পুরাণ অনুযায়ী, কাতান নামক এক বিখ্যাত ঋষি ঘোর তপস্যা করেন, দেবী দুর্গাকে নিজের কন্যারূপে লাভ করার জন্য। ওঁর এই প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট দেবী দুর্গা তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ করেন। ঋষি কাতানের কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন মহামায়া। পরনে ছিল কমলা রঙের বস্ত্র। যা কিনা অসীম সাহসের প্রতীক বলে মনে করা হয়। দেবী কাত্যায়নী মহিষাসুরমর্দিনী নামেও পরিচিত। নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে দেবীকে কমলা রঙের শাড়ি পরানো হয়। ভক্তেরা লাল-মেরুন-কমলা-জাফরান এবং প্রবাল রঙের পোশাক পরে মায়ের আরাধনা করেন। মা কালরাত্রি সাহস এবং শান্তির প্রতীক। সপ্তম দিনে মা কালরাত্রির পুজো হয় এবং এটাই মায়ের সবচেয়ে উগ্র হিংসাত্মক রূপ বলে মনে করা হয়। চোখে ভয়ানক আগুনের তেজ ও রোষদৃষ্টি নিয়ে দেবী এদিন শ্বেতশুভ্র শাড়ি পরেন। এর অর্থ হল আক্রোশ ও ক্রোধের মাঝেও উনি শান্তি ও কল্যাণ কামনাকারী। মা হরগৌরী সর্বজনীন দয়ার প্রতীক। নবরাত্রি অষ্টম দিন মা হরগৌরীকে উৎসর্গ করা হয়। দেবীর রং হল গোলাপি। এই দিনে দেবী দুর্গার সব পাপের মোচন করেন বলে মনে করা হয়। গোলাপি হল আশার প্রতীক এক নতুন শুরুর সূচক। কমলা লাল বা গোলাপি রঙের পোশাক পরেন এই মা।
পবিত্রতা প্রেম করুণার দেবী সিদ্ধিদাত্রীর পুজো হয় নবম দিনে। এই দিনে তাঁর বসন হল হালকা নীল। সিদ্ধিদাত্রী রূপের আছে অতি মানবীয় আরোগ্য ক্ষমতা।
আরও পড়ুন-ঐতিহাসিক সাফল্য, দাবা বিশ্ব কুর্নিশ করছে আমাদের, গর্বিত আনন্দ
মায়ের রকমারি ভোগ
শুধু নয় দিনের নয় রঙের বৈচিত্রময় পোশাকই নয়। নবরাত্রির ন’দিনে দেবীর ভোগেও থাকে আলাদা আলাদা উপাচার।
নবদুর্গার পুজোতে প্রথম দিনে দেবী মা পূজিতা হন শৈলপুত্রী রূপে, এ তো আমরা সবাই জানি। ফলমূল ছাড়াও সেদিন গরুর দুধের তৈরি ঘি দিয়ে বানানো প্রসাদ মাকে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয়াতে মা ব্রহ্মচারিণীকে ভোগ দেওয়া হয় চিনি দিয়ে তৈরি কোনও জিনিস।
তৃতীয়াতে মা চন্দ্রঘণ্টাকে পুজো করা হয়। দুধ ও চিনি দিয়ে তৈরি নানারকম খাবার ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়।
চতুর্থীতে মা কুষ্মাণ্ডাকে নিবেদন করা হয় মালপো এবং পরে সেটি দরিদ্র অভাবী মানুষকে দান করা হয়।
নবরাত্রি আরাধনায় পঞ্চমীর দিনে মা স্কন্দমাতার ভোগ দেওয়া হয় সুমিষ্ট কলা।
নবদুর্গার ষষ্ঠীর দিন কাত্যায়নীকে ভোগ নিবেদন করা হয় মধু দিয়ে।
সপ্তমীর দিন মা কালরাত্রির পুজো করা হয়। মাকে আখের গুড়ের নৈবেদ্য অর্পণ করা হয় প্রসাদ হিসাবে।
অষ্টমীর দিন মহাগৌরীকে ছোলা, হালুয়া ও নারকেল দেওয়ার নিয়ম। হালুয়া বা সুজি তৈরি করার পর তাতে অল্প হলুদ খাবার রং মিশিয়ে দিয়ে হালুয়ার রং হলুদ করা হয়। ছোলা ভিজিয়ে সেটা কড়াইয়ে অল্প ঘি দিয়ে মাকে নিবেদন করার নিয়ম।
এই পুজোয় নারকেলকে অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
মহানবমীর দিন মা সিদ্ধিদাত্রীর ভোগ দেওয়া হয় পায়েস দিয়ে। কন্যা পূজন করা হয় এই বিশেষ দিনে।
নয় অবতার কথা
ধর্ম বিনষ্টকারী অসুরদের উত্থান হলেই পৃথিবীতে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। আর তখনই তাদের বিনাশ করে ধরার শান্তি ও শুভ স্থাপনের জন্য দেবী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়ে দুষ্টকে দমন করে শিষ্টের পালন করেন।
আরও পড়ুন-কমল বৃষ্টি, অব্যাহত ডিভিসির জল ছাড়া
মহাকালী
প্রলয়কালে যখন সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জলমগ্ন ছিল তখন ভগবান বিষ্ণুর নাভিপদ্মে উৎপন্ন হন ব্রহ্মা। বিষ্ণুর যোগনিদ্রাকালে তাঁর কর্ণমূল থেকে উৎপন্ন হয়ে মধু ও কৈটভ দৈত্যদ্বয় সরাসরি ব্রহ্মাকে হনন করতে উদ্যত হন। ভীত হয়ে বিষ্ণুকে স্তব করতে থাকেন তিনি। বিষ্ণুর নিদ্রা ভঙ্গ হলে তিনি দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। দীর্ঘকাল যুদ্ধ চলার পর বিষ্ণুকে রক্ষা করার জন্য দেবী মহামায়া তাঁর মায়াশক্তি দিয়ে দৈত্যদের আবৃত করলেন। তখন দৈত্যদের বুদ্ধিভ্রংশ ঘটল। তাঁরা বিষ্ণুকে বলল তোমার যুদ্ধে খুশি হয়েছি। তুমি কী বর চাও বল? সুযোগ পেয়ে বিষ্ণু বললেন, আমি যে তোমাদের বধ করতে পারি এই বর দাও। তথাস্তু বলে দৈত্যদ্বয় সংগ্রামে নিহত হল। যিনি মায়াশক্তি দ্বারা দৈত্যদের বুদ্ধি ধ্বংস করালেন তিনি মা মহাকালী।
মহালক্ষ্মী
দেবতাদের মিলিত তেজ শক্তি দ্বারা শক্তিময়ী নারী সৃষ্টি হয়েছিল এবং যিনি দীর্ঘ সংগ্রামের পর মহিষাসুরকে নিধন করেছিলেন তিনি মহালক্ষ্মী।
মহাসরস্বতী
যে শক্তিময়ী দেবী মহাপরাক্রমশালী শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দৈত্যদ্বয়কে বিনাশ করেছিলেন তিনিই হলেন সর্বজীবের কৃপাপ্রার্থী মা মহাসরস্বতী।
যোগমায়া
কংসের কারাগারে দেবকী ও বসুদেবের ছয় পুত্র নিধন হওয়ার পর যখন দেবকীর সপ্তম গর্ভে অনন্তদেব বলরাম রূপে এলেন তখন তাঁকে রক্ষা করার জন্য যে দেবী দেবকীর গর্ভ নিজ গর্ভে নিয়ে নন্দলায়ে রোহিণীর গর্ভে সঞ্চালন করেছিলেন এবং দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কৃষ্ণকে নিয়ে বসুদেব নন্দালয়ে রেখে যশোদার সদ্যোজাতা কন্যাকে কারাগারে নিয়ে এসেছিলেন। তাকে কংস হত্যা করতে গেলে শূন্যমার্গে উঠে দেবীরূপ ধারণ করে লীন হয়ে গেলেন। তিনি আর কেউ নয়, তিনিই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী। তিনি যোগমায়ার রূপে শ্রীকৃষ্ণলীলার সর্বসহায়ক রূপে ছিলেন।
রক্তদন্তিকা
একসময় বিপ্রচিত্তি নামে এক মহা শক্তিমান অসুরের অত্যাচারে মানব ও দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে দেবী দুর্গার স্মরণ নিলেন। দেবী আবির্ভূতা হয়ে দানব বিপ্রচিত্তি-সহ সকল দৈত্যদের নিধন করেন। দৈত্যদের ভক্ষণ করার সময় দেবীর দাঁতগুলো রক্ত জবার মতো লাল হয়ে গিয়েছিল। তাই দেবী রক্তদন্তিকা নামে খ্যাত।
শাকম্ভরী
একসময় অসুরদের অত্যাচারে অখুশি হয়ে দেবী প্রকৃতি, পৃথিবীতে বৃষ্টি বর্ষণ থেকে শতবর্ষ বিরত ছিলেন। তখন সমস্ত জীবজগৎ খাদ্য এবং পানীয়ের অভাবে অতিষ্ঠ হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করতে লাগল। সেই নিদারুণ সময়ে সকল মুনি-ঋষি মিলে দেবী ভগবতীর উপাসনা করলে দেবী প্রসন্ন হয়ে অবতার রূপ ধারণ করে বর্ষণ করলেন। যার ফলে জীবজগৎ আশ্বস্ত হল। এবং দেবতারা নিশ্চিন্ত হলেন। সেই থেকে দেবী শাকম্ভরী নামে প্রসিদ্ধা।
আরও পড়ুন-নারীশক্তির জাগরণী নবরাত্রি
শ্রীদুর্গা
একসময় পৃথিবীর বুকে দুর্গম নামে এক মহা শক্তিশালী দৈত্যের উৎপত্তি হয়। অসীম বলে বলীয়ান হয়ে সেই দৈত্য স্বর্গ মর্ত্য পাতাল অধিকার করে অত্যাচার শুরু করে। দেবী মহামায়া তাকে নিধন করে দুর্গা নামে প্রসিদ্ধা হন। আদি পুরাণ মতে তিনি দুর্গাসুরকে বধ করে দুর্গা নামে প্রসিদ্ধা হন।
দুর্গাসুরে বধ করিয়া
দুর্গানাম পায় মহামায়া।
দেবী ভ্রমরী
পুরা কালে অরুণাসুর নামে একজন দৈত্য ছিল। সে স্বর্গে গিয়ে মহা অত্যাচার শুরু করেছিল। দেবতাদের স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের স্ত্রীদের নিয়ে সতীত্ব নাশের চেষ্টা করে। দেবীরা দানবদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দেবী ভৈরবীরূপী মা মহামায়ার শরণাগত হলেন। দেবীদের দুঃখ সহ্য করতে না পেরে বৈষ্ণবী দেবী ভ্রমরীর রূপ ধারণ করে সেই অরুণাসুর দৈত্যকে সহজে নিধন করলেন। তাই দেবী দুর্গাকে দেবী ভ্রমরীরূপে পুজো করা হয়।
দেবী চামুণ্ডা
ব্রহ্মার বরে বলীয়ান ছিলেন দৈত্যদ্বয়। তাদের নাম চণ্ড ও মুণ্ড। এই দৈত্য দ্বারা সমগ্র বিশ্ব সংসারে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। দেবতাদের যুদ্ধে পরাস্ত করে দৈত্যদ্বয় স্বর্গ অধিকার করেন। তাদের অত্যাচারে দেবতাদের দুর্গতির শেষ রইল না। দেবতারা বিপদে পড়ে দেবী দুর্গার স্মরণ নিলেন। দেবী ভগবতী অবতার হয়ে চণ্ড মুণ্ডকে বধ করলেন। চণ্ড মুণ্ডকে বধ করার জন্য দেবী দুর্গার অপর নাম হল চণ্ডিকা বা চামুণ্ডা। চামুণ্ডা দেবীর পুজোয় সকল বিঘ্ন নাশ হয়।
মূল কথা হল, দেবী দুর্গাকেই বিভিন্ন নামে সম্বোধন করা হয়েছে।
‘নমো নমো দুর্গে সুখকরণী
নমো নমো অম্বে দুঃখহরণী’।