সাহিত্য এবং ভ্রমণ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে বহু খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকের রচনায়। নিছক ভ্রমণকাহিনি নয়, তার পরতে পরতে রয়েছে জীবন পর্যবেক্ষণ, প্রকৃতি অবলোকন, সাহিত্যের স্বাদ। বিশুদ্ধ ভ্রমণসাহিত্যগুলো বারংবার পড়ার কৌতূহল জাগে। বাংলায় লেখা হয়েছ বেশকিছু ভ্রমণ উপন্যাস। যেমন— প্রবোধ সান্যালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যর ‘দুরাকাঙ্ক্ষের বৃথা ভ্রমণ’ও একটি অনবদ্য উপন্যাস। যদিও সেটা ঠিক ভ্রমণ-বিষয়ক নয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’। বইটি ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সময় নাম ছিল ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী’। সেটাও কিন্তু ভ্রমণসাহিত্য নয়। জলধর সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্নদাশঙ্কর রায়, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ জনপ্রিয় ভ্রমণসাহিত্য উপহার দিয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখের ভ্রমণ-বিষয়ক লেখা পেয়েছে আলাদা মাত্রা।
আরও পড়ুন-সব ছোটদের জন্য
যুবক বয়সে পালামৌ গিয়েছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পালামৌ নিয়ে তাঁর রচনা ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পাহাড়ের বর্ণনা, নারী ও পুরুষের বর্ণনা, লাতেহার পাহাড়ের কিছু অভিজ্ঞতা উপস্থাপন থেকে তাঁর দেখার চোখ, তীক্ষ্ণ, কাব্যময়, ভাবনাবাহী মনের পরিচয় মেলে।
জলধর সেন ভ্রমণ-বিষয়ক বই লিখেছেন দশটি। তার মধ্যে ‘হিমালয়’ বইটি অতি-জনপ্রিয়।
১৮৯০-এর জুলাই সারদা মাকে প্রণাম করে কলকাতা ছাড়েন স্বামী বিবেকানন্দ। ফেরেন সাত বছর পর। বিশ্ববিজয়ী হয়ে। তাঁর ‘পরিব্রাজক’ রচনাটি ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় প্রকাশ পায় ‘বিলাত যাত্রীর পত্র’ নামে, পরে এর নাম বদলে করা হয় ‘পরিব্রাজক’।
বিশ্বপরিভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ভ্রমণকথার বই আটটি— ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়েরী’, ‘পথের সঞ্চয়’, ‘জাপান যাত্রী’, ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরী’, ‘জাভা যাত্রীর পত্র’, ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘পারস্য যাত্রী’। ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ বইতেও আছে ভ্রমণ। এ-ছাড়াও নানা দেশজ ভ্রমণের পরিচয়ও মেলে রবীন্দ্রজীবনী ও স্মৃতিকথা পড়লে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর তিব্বত প্রসঙ্গ-সহ দার্জিলিং ভ্রমণ কথা, ‘সখা’, ‘সাথী’, ‘সন্দেশ’, ‘মুকুল’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল। এক জায়গায় তিনি লিখছেন, ‘পর্বতের কোলে মেঘের নিদ্রা দেখিতে বড়ই সুন্দর। চঞ্চল মেঘ সমস্ত দিন ধরিয়া ছুটাছুটি করে। তাই কি সন্ধ্যাকালে তাহার ঘুম পায়? ওই দ্যাখো, তাহারা কেমন শান্ত হইয়া পর্বতের গায়ে শুইয়া পড়িয়াছে। সমস্ত রাত্রি তাহারা ওই রূপ ভাবে কাটায়। সকালবেলা সূর্যের আলো তাহাদের গায়ে পড়িবামাত্র তাহাদের ঘুম ভাঙিয়া যায়।’
আরও পড়ুন-দার্জিলিং-কালিম্পংয়ে ফের ধস
বেশ কয়েকটি ভ্রমণ গ্রন্থ আছে বুদ্ধদেব বসুর। সেগুলি হল— ‘আমি চঞ্চল হে’, ‘সমুদ্রতীর’, ‘সব-পেয়েছির দেশে’, ‘দেশান্তর’। সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি, সরস সাহিত্যের আমেজ তাঁর লেখনীকে করে তুলেছে অনন্য। পাঠকের ইচ্ছে হবে সমুদ্রতীরের দেশগুলোতে পুনর্বার নতুন চোখে বেড়িয়ে আসতে। ধরা পড়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বরূপ।
জসীমউদ্দিনের লেখনীতে মায়া-মমতা ও সারল্যের ছাপ পাঠকদের সবসময়ই মুগ্ধ করেছে। লেখক, গীতিকার, কবি হিসেবে বারবার তিনি উপহার দিয়েছেন কালজয়ী সাহিত্য। ‘হলদে পরীর দেশে’ তাঁর হাতে গোনা কিছু ভ্রমণ-বিষয়ক বইগুলির মধ্যে অন্যতম। আছে লেখকের যুগোস্লাভিয়া ভ্রমণের কাহিনি, এছাড়াও আছে কিছুদিন রোম দেশে কাটানোর বিবরণও।
অন্নদাশঙ্কর রায় ইউরোপ গিয়েছিলেন ১৯২৬ সালে। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘যেদিন আমি বিদেশ যাত্রা করেছিলুম সেদিন শুধু দেশ দেখতে যাইনি। গেছলুম মানুষকেও দেখতে। মানুষের সঙ্গে মিলতে, মানুষের সঙ্গে নানা সম্বন্ধ পাতাতে।’ তাঁর ইউরোপ দেখা শুরু লন্ডন থেকেই। পরে পারি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি। লিখেছেন ভ্রমণগদ্য। তাঁর শাণিত গদ্যভাষা পাঠকের বুদ্ধি-বিচারকে উদ্দীপ্ত করে যায়।
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ ১৯৪৯ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশের সময়ই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এই বই আড্ডাধারীদের মধ্যে গল্প জমানোর ভঙ্গিতে বলা। পরিহাস ও বক্রোক্তিতে খুব উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন-২৯৭৬টি পুজো, নয়া নজির কলকাতার
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘আরণ্যক’ সেই অর্থে ভ্রমণকাহিনি নয়, তবে কাহিনির হাত ধরে পাঠকমন পৌঁছে যায় অচেনা-অজানা জগতে। মুখোমুখি হয় বিচিত্র চরিত্রের, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার।
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যয়ের ভ্রমণকাহিনি মানেই মজার মোড়কে জারিত। যাঁরা তাঁর ‘রেলরঙ্গ’ পড়েছেন তাঁরাই জানেন রেলভ্রমণের জাদুকথা। তাঁর ‘কুশী প্রাঙ্গণের চিঠি’, ‘দুয়ার হতে দুয়ারে’, ‘একই পথে দুই প্রান্তরে’ও রেল-কেন্দ্রিক ভ্রমণকথা অনাবিল আনন্দদায়ক।
সতীনাথ ভাদুড়ী প্যারিস যাত্রা করেন। নিজব্যয়ে দেশভ্রমণ। ফিরে এসে লেখেন। লেখাটি ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ হয়। ‘পথে প্রবাসে’ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী বলেন, ‘‘এ শুধু ভ্রমণ বৃত্তান্ত নয়, একখানি যথার্থ সাহিত্যগ্রন্থ।’’ বইটি প্রচলিত ভ্রমণ বৃত্তান্তের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত এক আশ্চর্য রসসাহিত্য।
হুমায়ুন আহমেদ লিখেছেন ‘পায়ের তলায় খড়ম’, ‘রাবণের দেশে আমি এবং আমরা’, ‘দেখা না দেখা’, ‘হোটেল গ্রেভার ইন’, ‘মে ফ্লাওয়ার’ এবং ‘যশোহা বৃক্ষের দেশে’ নামক ৬টি ভ্রমণ-বিষয়ক গ্রন্থ। সদলবলে বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকা, ঘোরা, জীবন কাটানোর মুখরোচক গল্প দুই মলাটে তাঁর ভ্রমণসমগ্রের অন্তর্ভুক্ত।
কালকূট ছদ্মনামের আড়ালে ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ লিখেছিলেন সমরেশ বসু। উত্তর ভারতে কুম্ভমেলা দেখার আশ্চর্য স্মৃতি করেছিলেন উজাড়। তার মধ্যে বুনে দিয়েছিলেন নিটোল গল্প।
সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে দেশ-বিদেশের নানা জায়গার বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন গ্যাংটক, রাজস্থান, বেনারস প্রভৃতি।
আরও পড়ুন-২৩টি বাড়ি পুনর্নির্মাণে অনুমোদন পুরসভার
বিভিন্ন দেশে বেড়িয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনি। ‘অর্ধেক জীবন’ বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘যে পৃথিবীতে জন্মেছি তাকে পুরোপুরি দেখব না?’ প্রকৃতি, মানুষ, বিভিন্ন জায়গায় বিচিত্র ইতিহাস সুনীলকে বারবার টেনে নিয়ে গেছে। নিজের রাজ্য আর দেশকেও তিনি চিনতেন হাতের তালুর মতো। তাঁর ‘ভ্রমণ সমগ্র’ বেরিয়েছে। ‘তিন সমুদ্র সাতাশ নদী’, ‘কবিতার জন্য সারা পৃথিবী’, ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ও পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখনীর ভক্ত মাত্রেই জানেন, কী সহজে তিনি আপামর মধ্যবিত্ত বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, ভালবাসা, আবেগের কথা মাত্র কয়েকটি বাক্যেই তুলে ধরতে পারেন। ‘বাঙালের আমেরিকা দর্শন’ বইটিতেও যেন সেই মধ্যবিত্তের চোখে আমেরিকার রূপ ধরা পড়েছে।
নারায়ণ সান্যাল তাঁর ‘জাপান থেকে ফিরে’ বইটিতে লিখেছেন জাপানে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড এক্সপো অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার গল্প এবং জাপান দেশে তাঁর নানান অভিজ্ঞতার কথা। আছে জাপানের সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার নানান বিবরণ।
নবনীতা দেবসেনের ভ্রমণও বহুধা বিস্তৃত। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, চিন ঘুরেছেন এবং লিখেছেন। তাঁর ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’, ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে’, ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে’ প্রভৃতি অতীব জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
আরও পড়ুন-বাহ কমরেড! টাকা পেলেই মুখপত্রে ‘উল্টো স্লোগান’, দ্বিচারিতা সিপিএমের
বর্তমান সময়ে অমরেন্দ্র চক্রবর্তী, প্রবালকুমার বসু, মাহমুদ হাফিজের নানা রচনা থেকে জানতে পারি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে। পাতায় পাতায় চমৎকার বর্ণনা। সেইসব দেশের জনজীবন, সংস্কৃতির ছবি ফুটে ওঠে। এঁদের ভ্রমণ বিষয়ক রচনাগুলো যথেষ্ট পরিমাণে সাহিত্যগুণসমৃদ্ধ।