অভয়ার জাস্টিসের দাবিতে জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনে নামতেই লোকসভা ভোটে তৃণমূলের কাছে ১২-২৯ গোলে নাস্তানাবুদ বঙ্গ বিজেপি বুকে পেয়েছিল হাতির বল। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বিজেপির ধরনামঞ্চে হাজির হয়েছিলেন দলের সব গোষ্ঠীর নেতা। নির্বাচনের আগে অমিত শাহের এক হওয়ার হুইপেও বঙ্গ বিজেপির নেতাদের মধ্যে অটুট ছিল ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্ক। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে ‘অনুপ্রাণিত’ বিজেপি নেতারা বাংলাকে ‘বাংলাদেশ’ বানানোর অভিপ্রায়ে ধরনামঞ্চে বসেছিলেন পাশাপাশি। কিন্তু দেখে মজা লাগছে, জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি তুলে নেওয়ায় বিজেপি নেতৃত্ব বেজায় ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভের প্রকাশ দিলীপ ঘোষের উক্তিতে, “এতদিন ধরে মানুষকে খেপিয়ে কী লাভ হল?” অর্থাৎ, জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের ময়নাতদন্তে বঙ্গ বিজেপি বুঝে গিয়েছে, ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে তাদের নিট প্রাপ্তি শূন্য। তাই এই খেদোক্তি। বিজেপি বিধায়ক অশোক দিন্দাও লাভের ঘরে শূন্য দেখে রেগেমেগে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে ‘স্বার্থপর আন্দোলন’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর মতে, অভয়ার জাস্টিসের জন্য নয়, চিকিৎসকদের নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যেই এই আন্দোলন।
আরও পড়ুন-ভোট বৈতরণী পার হওয়া যাবে কীভাবে? মহারাষ্ট্র নিয়ে মহাচিন্তায় বিজেপি
এখানেই শেষ নয়। সিবিআই, ইডির বিরুদ্ধে এতদিন যেসব কথা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা বলতেন এখন সেটাই বলছেন বিজেপির নেতৃবর্গ। আড়ালে আবডালে বলে ফেলছেন, কেন্দ্রীয় এজেন্সি ‘রাজনৈতিক প্রভু’দের নির্দেশে শুধু ঝাল মেটাতে পারে, কিন্তু কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা আরজি কর-কাণ্ডে প্রশাসন ও সরকারের সমালোচনা করেছেন, নানান ত্রুটির দিকে আঙুল তুলেছেন, কিন্তু কখনওই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেননি। আর সেটা বিজেপির প্রত্যাশার বাড়া ভাতে ছাই ফেলার জন্য যথেষ্ট। সেজন্যই তাঁদের অত মনঃকষ্ট। চিকিৎসকদের দাবি, সিস্টেমের বদল, সরকারের নয়। আর সেটা টের পেতেই বিজেপিতে শোকের আবহ। তার উপর সিজিও কমপ্লেক্সে অভিযান করে জুনিয়র ডাক্তাররা বুঝিয়ে দিয়েছেন, অভয়ার জাস্টিস দেওয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবেই কেন্দ্রীয় এজেন্সির।
রাজনীতির সমীকরণ বদলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বঙ্গ বিজেপিকে ভাবিয়ে তুলেছে। অভয়ার জাস্টিসের দাবিতে বাংলা এককাট্টা। কিন্তু গণআন্দোলনে আলোড়িত হয়েছে মূলত কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন শহর এলাকা। অগাস্টের গোড়ায় আরজি করের ঘটনার পরে বিক্ষিপ্ত ভাবে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন আদিবাসী-জনজাতিরা। তাঁদের মেয়েদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদও জুড়েছিল সেই আন্দোলনে। তবে তা দানা বাঁধেনি, ছড়ায়ওনি। পাহাড় থেকে জঙ্গলমহল— ছবিটা একই। বাজারি কাগজের মতো বিজেপির সঙ্গে সঙ্গে সিপিএমও সেটা বুঝে ফেলেছে।
আরও পড়ুন-ভারতে বিদেশি পর্যটকের শীর্ষে বাংলাদেশ, দ্বিতীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
তাই নতুন করে ছক কষা, ঘুঁটি সাজানো চলছে। উদ্দেশ্য পুজোটাকে পণ্ড করা। পুজো কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটানো।
নাগরিক সমাজকে ব্যবহার করে বামদের নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তোলার মরিয়া প্রয়াস স্পষ্ট। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাংলার আকাশে আগে পুজো কখনও এসেছে বলে মনে পড়ে না। এরা সত্যি অভয়ার বিচার চায় না, অশান্তি চায়! বিধানসভা ভোট কিন্তু এখনও ১৮ মাস দূরে। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চল বন্যার কবলে। পরপর নিম্নচাপের ভ্রুকুটি। ব্যবসা- বাণিজ্যের অবস্থা এমনিতেই ভাল নেই। গোদের উপর বিষফোড়া, উৎসবকে বানচাল করতে ফেসবুকে বামেদের বিপ্লব। কিছু পোস্ট দেখলে মনে হচ্ছে, উৎসব করলেই আপনি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, বিচারের বিরোধী। এসবই বামপন্থীদের পুরনো ফর্মুলা। পুজোর ক’টা দিন ছেড়ে দিলে কি বিচার পালিয়ে যেত! কে জানে?
আরও পড়ুন-দুর্গাপুরে পুজোর কার্নিভাল নিয়ে জরুরি বৈঠক হল নিগম কার্যালয়ে
অথচ, বামেদের মুখপত্র ‘গণশক্তি’তে পুজোর বিজ্ঞাপন, জুতোর বিজ্ঞাপন। পাতা জুড়ে লেখা, ‘দুর্গাপুজো উদযাপন করুন গৌরবের সাথে।’ মানে, জনগণকে বিপ্লব করতে রাস্তায় নামিয়ে নিজেরা নেপো হয়ে বিজ্ঞাপনের দই খাব। আরও একটা বিষয়। বামেরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, তা সর্বজনবিদিত। তাহলে কেন সেই দলের মুখপত্রে এহেন বিজ্ঞাপন? ফেসবুকে বিপ্লব-পুজো নয়, উৎসব নয়। আর টাকা পেলে উলটো স্লোগান কাগজে। কমরেড, এটা পার্টির কাগজ, বাণিজ্যিক নয়। টাকার জন্য আত্মাকে বিক্রি করতে পিছ পা নন ওঁরা। শুধুমাত্র অর্থের জন্য নৈতিকতা থেকে সরে আসায় কোনও বাধা নেই!
নিঃসন্দেহে একটা দুঃখজনক খুন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গিয়েছে সরকারি হাসপাতালের অন্দরে। পুজোর মাত্র দু’মাস আগে যারা সেই কাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের জন্য কোনও ধিক্কার কিংবা শাস্তিই যথেষ্ট নয়। একইসঙ্গে এটাও ঠিক, বিচারেরও তো একটা প্রক্রিয়া থাকে। পুজো প্যান্ডেলের সামনে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বললেই কি অপরাধীদের ভোররাতে ফাঁসি হয়ে যাবে, অভয়া বিচার পাবেন? চার্জশিট, তদন্ত রিপোর্ট, নিম্ন আদালত থেকে ধাপে ধাপে সুপ্রিম কোর্টের রায়, শেষে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন, কিছুই লাগবে না! তাহলে তো প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হয়। প্রকৃত বিচার বলতে বামেরা কি সেটাই বোঝাচ্ছেন?
এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার চেষ্টাই চলছে সব মহল থেকে। আরজি কর কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ এবং স্থানীয় টালা থানার ওসি গ্রেফতার হয়েছেন। কয়েক ডজন ডাক্তার, পুলিশ, নেতা, বিধায়ককে একাধিকবার জেরা করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে নিয়মিত তদন্তের স্টেটাস রিপোর্টও জমা দিচ্ছে সিবিআই। ছাত্রদের দাবি মেনে কলকাতার পুলিশ কমিশনার-সহ একাধিক সরকারি কর্তাকেও সরানো হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের নিরাপত্তা ঢেলে সাজায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আজ, সোমবারও শুনানি আছে। কিন্তু যেটা উদ্বেগজনক তা হচ্ছে, বিচারকে শিখণ্ডী করে আড়াল থেকে রাজনীতির ইতিউতি উঁকি। আসল উদ্দেশ্য বিচার না চেয়ার? রাতদখল না ক্ষমতা দখল? সামনাসামনি না পেরে, নাগরিক আবেগকে ব্যবহার করে ঘোলাজলে মাছ ধরার এই ভড়ং কিন্তু ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বাংলার দুর্গাপুজোর দিকে চেয়ে থাকে গোটা বিশ্ব। বহু বিদেশি পর্যটক আসেন ঠাকুর, প্যান্ডেল, শিল্পের উৎকর্ষ দেখতে। আর গরিব চেয়ে থাকে দুটো পয়সার মুখ দেখবে বলে। এই উৎসবের উপরই আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি অনেকাংশে দাঁড়িয়ে।
এমতাবস্থায় বামেদের এই নোংরা রাজনীতি প্রতিহত করতে পাড়ায় পাড়ায় মানুষের জোট তৈরি হোক উৎসবের পক্ষে। এই বিচার পাওয়ার চক্করে এ-রাজ্যের বামপন্থীরা ক্রমেই গরিব প্রান্তিক কৃষক, শ্রমিক, সংখ্যালঘু মানুষদের থেকে আরও সরে এলিট ধনীদের পার্টিতে পরিণত হচ্ছে। এই পথে শূন্যের কলঙ্ক বাম শরীর থেকে ঘুচবে না, বরং আরোপিত ‘দ্রোহকাল’ বিজেপির মতো তাদেরও আরও জনবিচ্ছিন্ন করবে।
দেওয়াল লিখনটা পড়তে পারছেন না, কমরেড!