নারীর ক্ষমতায়ন, এগিয়ে বাংলা

সামাজিক জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, গার্হস্থ্যে নারীরা যেভাবে অবদমিত হন তা থেকে মুক্তি ও স্বাভাবিক সমান দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের বিচার করা তথা ন্যায্য পরিবেশে কাজ করার অধিকার ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্ত করে। আজ প্রথম পর্বে লিখছেন অধ্যাপক ড. প্রদীপ্ত মুখোপাধ্যায়

Must read

“Beware; for I am fearless and therefore powerful.”
— Mary Wollstonecraft Shelley

নারীর ক্ষমতায়ন সুরক্ষা ও স্বাতন্ত্র যেকোনও সমাজের শান্তি, স্থিতি ও উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সর্বত্র ক্ষেত্রে নারীদের স্বাভাবিক অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমানতা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে স্বাধীনতার সময় থেকেই সংবিধানের মাধ্যমে নারীদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের জন্য সমান সুযোগের বিধিনিয়ম চালু আছে। তবে মনে রাখা জরুরি, ক্ষমতায়ন একদিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা অন্যদিকে অধিকার আদায়ের পরিবেশের সম্মিলিত এক রূপ। সেখানে জীবনযাপনে আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বা শক্তিসম্পন্ন হওয়া আবশ্যিক। নিরবচ্ছিন্ন বা স্থিতিশীল উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্যেও নারীর ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা জরুরি। অর্থাৎ ক্ষমতায়নের সঙ্গে সুরক্ষার প্রসঙ্গ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সামাজিক জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, গার্হস্থ্যে নারীরা যেভাবে অবদমিত হন তা থেকে মুক্তি ও স্বাভাবিক সমান দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের বিচার করা তথা ন্যায্য পরিবেশে কাজ করার অধিকার ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্ত করে। উল্লেখ্য নারীবাদী তাত্ত্বিকগণ নারীর কার্যকরী (Essential) ভূমিকার উপর গুরুত্ব দেন। কিন্তু তাদের সমালোচনা নির্মাণবাদী (Constructivist) ভাষ্যের প্রতি। কার্যকরী দৃষ্টিভঙ্গি নারীদের বিশেষ শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার কথা বলে। অন্যদিকে নির্মাণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নারীদের দুর্বল, গার্হস্থ কাজের মানুষ প্রভৃতি নেতিবাচক দিক দিয়ে বিচার করে। এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেই নারীদের প্রকৃত স্বাধীনতা তথা ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ব্যাটন ধরেন।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

একসময়ের সতী, জোহার, দেবদাসী, পর্দা প্রথা তথা পুরুষতান্ত্রিক ভারতে মনুবাদী চিন্তাবিদগণ যেমন স্বাধীনতার আগে ও পরে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অবদান যথার্থভাবে লিপিবদ্ধ করেননি; তেমনই তাদের ক্ষমতায়নের জন্য সামাজিকীকরণের উপাদানগুলিকে (যেমন পরিবারে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সমান আচরণ, বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন-এর ক্ষেত্রে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব প্রভৃতি) কার্যকরীভাবে ব্যবহার করেননি। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেই সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় আইনের চোখে সমানতা, ১৫ নম্বর ধারায় লিঙ্গ ভেদে সমান স্বাধীনতা, ১৬ নম্বর ধারায় চাকরির সমানতা, ১৯ নম্বর ধারায় স্বাধীনতার অধিকার, ৪২ ধারায় যথাযথ কাজের পরিবেশ ও মাতৃত্বকালীন সুবিধার অধিকার, ৩২৬ ধারায় ভোটাধিকার প্রভৃতি অন্যান্য নানান বিধি নিয়মের মাধ্যমে নারীদের সমান অধিকার লিপিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আজ ৪৯ শতাংশের বেশি ভারতীয় নাগরিক মহিলা হওয়া সত্ত্বেও যখন নারী স্বাধীনতা সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে চর্চা গুরুত্ব পাচ্ছে তখন নারীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবার প্রবণতার প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ। নারীদের প্রতি অত্যাচার, বৈষম্যমূলক আচরণ তাদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নানান জটিলতা প্রভৃতি নারীবাদী চিন্তার অন্যতম দিক। আসলে ক্ষমতায়নের নানান ব্যবস্থা লিপিবদ্ধ থাকলেও ভারতে এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা রয়েছে যা প্রকৃত ক্ষমতায়নের পথে বাধাস্বরূপ। বিষয়টা খানিক গ্লাস সিলিং এফেক্ট-এর মতো। যেখানে ক্ষমতায়নের সকল পথ খোলা ও প্রশস্ত হিসাবে দেখা যাবে কিন্তু বাস্তবে তাকে অতিক্রম করা অসম্ভব। কারণ সেই পথ অদৃশ্য এক কাঁচের মাধ্যমে আটকানো যেখানে সব রাস্তা দেখা যায় কিন্তু হাঁটা যায় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে আসার পরেই এই গ্লাস সিলিং এফেক্ট ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করেন।
আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনা নারী স্বাধীনতা সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নের অন্যতম পন্থা। তবে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। কারণ সেক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ জড়িয়ে থাকে। স্বাধীনতার সময় থেকেই তথা সংবিধানের মাধ্যমে নারীরা রাজনৈতিক অংশগ্রহণে পুরুষের ন্যায় সমান সুযোগের অধিকার পায়। সংবিধানের ৩২৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী সকল ১৮ বছর বয়স্ক ভারতীয় নাগরিক লিঙ্গভেদে ভোটদানের অধিকারী। অর্থাৎ নারী-পুরুষ সমান ক্ষমতার অধিকারী। এই মর্মেই অর্থাৎ ভোটদানের মতোই ভোটে প্রার্থী হতেও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাস্তব চিত্র অন্য কথা বলে! ভারতে রাজনৈতিক অংশগ্রহণে স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি যে চিত্রটি ধরা পড়ে সেটি মোটেও সুখকর নয়। প্রথম লোকসভায় মাত্র ২২ জন মহিলা সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন অর্থাৎ মোট সাংসদদের ৪.৫% মহিলা সাংসদ ছিলেন ২০১৪ সালে হয় ৬৬ অর্থাৎ ১২.১৫% এবং ২০১৯ ও ২০২৪ সালে যথাক্রমে ৭৮ ও ৭৪। প্রসঙ্গত বিশ্বব্যাপী তুলনামূলক বিচারে সংসদে মহিলা প্রতিনিধির সংখ্যার প্রেক্ষিতে হিসাব অনুযায়ী ১৪০টি দেশের মতো মধ্যে ভারতের স্থান ১০৩ আর এশিয়ার মধ্যে ১৮টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৩। ঠিক যেমনটি গণতন্ত্র সূচকের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত। উল্লেখ্য, যে দেশ যত বেশি গণতান্ত্রিক সেই দেশে ততটাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয়। তাই ভারতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে সংসদে ও বিধানসভায় নারীদের অংশগ্রহণের যে চিত্র পাওয়া যায় তা যথেষ্ট হতাশার। কিন্তু এর মধ্যেও কিছু আশার আলো দেখা যায়। যেমন ২০১৪ সালে সর্বভারতীয় কৃত্যকে যে ১০১৬ জন নিযুক্তির সুপারিশ পেয়েছেন তার মধ্যে একের তিন অংশের কাছাকাছি অর্থাৎ ৩৫২ জন নারীও রয়েছেন। অর্থাৎ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তথা আমলাতন্ত্রে নিজের যোগ্যতায় নারীরা নেতৃত্বে পৌঁছাচ্ছেন বলা যেতে পারে।

আরও পড়ুন-মতবিরোধ, কাজে ফিরছেন এনআরএসের জুনিয়ররা, কর্মবিরতির বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা কলকাতা হাইকোর্টে

এবার আসা যাক বাংলার কথায়। তৃণমূল কংগ্রেস, মানবতাবাদী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায়, বাংলা থেকে ২০২৪ সালের ভোটে ১১ জন সাংসদকে সংসদে প্রেরণ করতে পেরেছে অর্থাৎ মোট জয়ী প্রার্থীর ৩৮ শতাংশ মহিলা। এই বছর ভোটের ফলাফলের পর বিশ্ববন্দিত দৈনিক The Hindu লেখে, ‘‘At 38% Trinamul Congress sents highest proportion of women MPs to lok sabha”। একইভাবে ২০১৯ সালের ভোটে ৪২টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ১৭ জন মহিলাকে প্রার্থী করেছিল অর্থাৎ মোট আসনের ৪১%। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, যে সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন হয়নি, নারীরা যেখানে ভাল থাকে না সামগ্রিকভাবে সেই সমাজ ভাল থাকতে পারে না। সেই কারণেই ক্ষমতায় আসার পরেই স্থানীয় শাসনের মহিলাদের জন্য ৫০% আসন সংরক্ষণ করেন। খেয়াল রাখতে হবে ৭৩ ও ৭৪ তম সংবিধান সংশোধন অনুযায়ী ৩৩% আসন স্থানীয় ক্ষেত্রে সংরক্ষণ করা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। তারপরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে প্রথমবারের জন্য ওই সংরক্ষণ ৫০%-এ নিয়ে যাওয়া হয়।
(এরপর আগামিকাল)

Latest article