খুব কম কথা বলে উচ্চকিত নারীবাদ। খুব কম জেনে উচ্চকিত প্রতিবাদ। খুব কম অভিব্যক্তি দিয়েও নারীশক্তির জয়জয়কার। সরবে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ না বলেও যে নিঃশব্দ বিপ্লব করা যায় তা বুঝিয়ে দিয়েছিল পুষ্পা রানি, মঞ্জু মাই, ফুল— এই তিন নারী। নারীবাদের উচ্চকিত বার্তার বিরুদ্ধে মোলায়েম প্রতিবাদেই বদলে গেছিল বহুবছরের মরচে-ধরা সামাজিক পরিকাঠামো। ছবির নাম ‘লাপাতা লেডিজ’ পরিচালক কিরণ রাও। ছবিটার প্রসঙ্গ এল তার কারণ ২০২৫ সালে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড নমিনেশনে ভারত থেকে প্রথম ছবি হিসেবে নাম ঘোষিত হয়েছে কিরণ রাও পরিচালিত এই ছবির৷ ২৯টা ছবির মধ্যে সেরার সেরা হিসাবে জায়গা পেয়েছে ‘লাপাতা লেডিজ’। যাঁর কাহিনিকার একজন বাঙালি— বিপ্লব গোস্বামী।
চলতি বছরের মার্চে ‘লাপাতা লেডিজ’ মুক্তি পেয়েছিল বড়পর্দায়। লক্ষণীয় ভাবে সফলতা পায়নি এই ছবিটা কিন্তু ঠিক একমাসের মাথায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেতেই উঠেছিল ঝড়। ২৬ এপ্রিল নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই দেশে, বিদেশে এই ছবির জয়জয়কার। কিছুদিন আগেই পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কিরণ জানিয়েছিলেন, বহুদিনের স্বপ্ন তাঁর ছবি যেন ভারতকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে খ্যাতি এনে দিতে পারে৷ সেই স্বপ্ন আক্ষরিক অর্থেই পূরণ হতে চলেছে। দ্য ফিল্ম ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া এই ছবিকেই সেরা ছবি হিসাবে অভিহিত করেছে। তাই ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ফিচার ফিল্ম বিভাগে ‘লাপাতা লেডিজ’ অস্কার মনোনয়নের দৌড়ে শামিল হল।
আরও পড়ুন-আজ কাপ অভিযানে হরমনপ্রীতের ভারত, শুভেচ্ছা জানালেন রোহিত-পন্থরা
কেন ‘লাপাতা লেডিজ’ অস্কার নমিনেশনে? এটা বুঝতে হলে বিশ্লেষণ জরুরি। ‘লাপাতা লেডিজ’কে তখন যেভাবে দেখানো হয়েছিল এই ছবি সেই সব কিছুর ঊর্ধ্বে। তথাকথিত ফুল আর দীপকের মিষ্টি প্রেমের গল্প এটা নয় আবার ঘোমটার আড়ালে বৌ-বদলের ঘটনাও এটা নয়। এই গল্প আসলে ভারতের মাটিতে বসবাসকারী প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের মেয়েদের আর্থ, সামাজিক অবস্থানের, সেখান থেকে তাঁদের উত্তরণের, সর্বোপরি নারী ক্ষমতায়নের। নারীবাদের বিজয়কেতন উড়িয়েছে এই ছবি তাও আবার খুব ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপে। অজ পাড়াগেঁয়ে কতিপয় মহিলা যাঁরা কিনা হারিয়ে যেতেই পারতেন। লাপাতা হয়েই যাঁদের জীবন কেটে যেত কিন্তু তা হয়নি। ভুয়ো সংস্কারের ঘোমটা খুলে তাঁরা বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছে। পুষ্পা রানি যাঁকে দিয়ে পরিচালক এই ছবির নারী জাগরণের মূল বার্তা দিয়েছেন তাঁর উত্তরণটাই সবচেয়ে সুন্দর। অরগ্যানিক চাষাবাদের পদ্ধতি সম্পর্কে পড়াশুনো করে কৃষিকাজে সাহায্য করতে চাওয়া পুষ্পা প্রথমেই সমাজের রক্ষণশীল বেড়াজাল ভাঙতে পারেনি। মা পড়াশুনো ছাড়িয়ে এক লম্পটের ঘাড়ে তুলে দেয় তাকে। কিন্তু বিধিবাম। এহেন পুষ্পার শ্বশুরবাড়ি যাবার পথে বর বদলে গেল— তখন সেই সুযোগ সে আর হাতছাড়া করে না। আসলে পথই বাতলে দেয় পথের খোঁজ। ফুলের শ্বশুরবাড়িতে শুরু হয় তাঁর মুক্তির পথের অন্বেষণ। সেই পথচলায় রয়েছে অনন্য ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, আত্মবিশ্বাস। এসপার নয় উসপার করার মতো সাহস।
আরও পড়ুন-নিয়মরক্ষার ম্যাচেও জয় চায় ডায়মন্ড হারবার
অন্যদিকে— ছোট্ট, অজ্ঞাত গাঁয়ের এক অখ্যাত মেয়ে ফুল। যেখানে মেয়ে একটু বড় হলেই বিয়ে হয়ে যায়। ছোট থেকে স্বামীর নাম মুখে আনতে নেই, শ্বশুরবাড়ির নামটাও মনে রাখা জরুরি নয় এটাই শিখে এসেছে সে। বিয়ের পরে ফুল তার বরের সম্পত্তি। এমন সম্পত্তি হয়ে যাওয়া অস্থিত্বহীন এক নারীর মনে, শরীরে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার গল্প ‘লাপাতা লেডিজ’। যেখানে সোশ্যাল স্যাটায়ারের মাঝে রয়েছে তীব্র নারীবাদ। এই নারীবাদ সুষ্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে মঞ্জু মাই চরিত্রটা আসার পর থেকেও। স্টেশনের এক দুঃস্থ চা-ওয়ালির কী অপূর্ব ব্যক্তিত্ব। যার কাছে হার মানতে পারে আচ্ছা-আচ্ছা পুরুষও। পিতৃতন্ত্রের মুখে সপাটে চড় কষানো একটা চরিত্র মঞ্জু যে বারংবার বিবেক হয়ে সমাজের যা কিছু অন্যায়, অন্যায্য, জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকা নির্লজ্জ পিতৃতন্ত্রের যা কিছু খারাপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সেই সবকিছুকে। আসলে লাপাতা হয়ে যাওয়া অস্তিত্বকে খুঁজে পাওয়ার গল্প ‘লাপাতা লেডিজ’। নারী পরিচালকের তৈরি নারীতন্ত্রের গল্প ‘লাপাতা লেডিজ’। গোটা বিষয়টা নারীকেন্দ্রিক হলেও এখানে পুরুষের ভূমিকাও কম নয়। একদিকে যেমন কঠিন পিতৃতন্ত্র অন্যদিকে সেখানে দেখা গেছে থানার ঘুষখোর পুলিশের মানবিক পুরুষতন্ত্রও। অতিরঞ্জিত না হওয়া একটা চরিত্র থানার বড়বাবু। শেষ বাজিটাই তিনিই মেরেছেন। পুরুষ হয়ে পুরুষতন্ত্রের ভাঁওতাবাজিকে উপড়ে দিয়েছেন। এমন একটা পরিপূর্ণ নারীতন্ত্রের ছবি অস্কার-মনোনয়ন পাবে সে তো বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন-নারীর ক্ষমতায়ন, এগিয়ে বাংলা
রণবীর কাপুরের ‘অ্যানিম্যাল’, কার্তিক আরিয়ানের ‘চান্দু চ্যাম্পিয়ন’, প্রভাসের ‘কল্কি’, ভিকি কৌশলের ‘শ্যাম বাহাদুর’, রাজকুমার রাওয়ের ‘শ্রীকান্ত’, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মালায়লাম ছবি ‘অ্যাটাম’— এই অস্কার মনোনয়নের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল। সব ছবিকে ছাপিয়ে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগের জন্য ৯৭তম অ্যাকাডেমি পুরস্কারে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে ‘লাপাতা লেডিজ’।
এই ছবিটির মনোনয়নের খবর আসামাত্র উঠেছে বিতর্কের ঝড়ও। ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ কেন গেল না অস্কারে তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন নেটিজেনদের একাংশ। লাপাতা লেডিজের থেকে পায়েল কাপাডিয়ার ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ অস্কারের জন্য আরও যোগ্য বাছাই ছিল বলে মত অনেকের। কিন্তু ফিল্ম ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (এফএফআই) ২৯টি শর্টলিস্ট করা ছবির তালিকা থেকে ‘লাপাতা লেডিজ’কেই বেছে নিয়েছে। তাঁদের এমন সিদ্ধান্তের কারণ জানিয়েছেন এফএফআই জুরি চেয়ারম্যান জানু বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘জুরিকে এমন একটি চলচ্চিত্র বেছে নিতে হয়, যা সব দিক থেকে পারফেক্ট। অর্থাৎ ভারতের সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরবে এমন একটি সিনেমা দরকার ছিল। তাই ‘লাপাত লেডিজ’কে বেছে নেওয়া হয়েছে। কারণ সিনেমাটিতে এমন অনেক দৃশ্য রয়েছে, যা বেশ শিক্ষণীয়।
আরও পড়ুন-বৃষ্টি মাথায় পুজো উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী, আজ জেলার ৪০০
স্পেশ্যাল স্ক্রিনিং হিসেবে ছবিটি সুপ্রিম কোর্টেও দেখানো হয়েছিল। সামাজিক পটভূমিতে তৈরি সিনেমাটি অস্কারের জন্য মনোনীত হতে পারে, এমনটা আগেই মনে করেছিলেন পরিচালক।
অস্কারের শেষ সিদ্ধান্ত কী হবে জানা নেই কিন্তু সহজ-সরল গ্রামজীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পিতৃতন্ত্রের ওপর নারীতন্ত্রের জয়জয়কারেই ছবি জিতে নিয়েছে জুরিদের মন। ছবির একঝাঁক নতুন অভিনেতা নীতাংশি গোয়েল, স্পর্শ শ্রীবাস্তব, প্রতিভা রান্টা তথা ছায়া কদম এবং রবি কিষাণের মতো দুঁদে অভিনেতার অভিনয় মুগ্ধ করেছে ভারত তথা বিদেশি দর্শকদের। এটাই বোধহয় সেরা প্রাপ্তি।