পুজোয় সাবেকি রান্না

সাবেক রান্নার ইতিহাসে বাঙালি সবসময় এগিয়ে। বিশেষ করে দুর্গাপুজোর সময় বাঙালির হেঁশেলে নানা ধরনের সাবেকি রান্নার চল ছিল। আজও কিছু কিছু বাঙালিবাড়িতে পুজোর সময় সাবেকি রান্নার চল আছে। সেইসব সাবেকি রান্নার গল্প বললেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

দুর্গাপুজোর আমেজের সঙ্গে ভোজনরসিক বাঙালির সম্পর্ক যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। নিরামিষ থেকে আমিষ, মিষ্টি থেকে টকঝাল সাবেকি রান্নায় মিলেমিশে এক হয়ে আছে বাঙালির দুর্গাপুজো। পুজো মানে কবজি ডুবিয়ে চর্ব, চোষ্য, লেহ্য, পেয়—। পুজোর চার দিন কী কী রান্না হবে সবকিছুই প্রায় ঠিক হয়ে যায় আগে থেকেই এটাই বাঙালিদের ট্রাডিশন। সাবেকী রান্নার ইতিহাসেও দুর্গাপুজো এবং পুজোর খাওয়দাওয়ার একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। কারণ
দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী এবং অষ্টমীর দিন বহু বাড়িতেই নিরামিষ খাওয়ার চল রয়েছে। আর তা বহুযুগ ধরেই। শুধু নিরামিষ নয়, অনেকে চালের তৈরি কোনও জিনিসই খান না এই দিনগুলিতে। তাই লুচি-ছোলার ডাল বা আলুর দম, ধোঁকার ডালনা, সুজি, চাটনির মতো সাবেক পদগুলো বাঙালি হেঁশেল আলো করে রাখে। বাঙালি বাড়ির হেঁশেলে গমগম করত মা-ঠাকুমাদের গলা। আর যাঁরা নিরামিষ খেতেন না তাঁদের বাড়িতে শুক্তনি থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের মাছ, মাংস, চাটনি, পায়েস প্রায় সবই থাকত। এ তো বাইরের খাবার খাওয়ার প্রচলন হয়নি।

আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার দিন ঘোষণা! রেকর্ড সংখ্যায় ভিড়ের সম্ভাবনা

তবে সাবেকি বাঙালি পদ বলতে প্রথমেই যেটার কথা মনে আসে তা হল শুক্ত। কিন্তু শুক্তকে সাবেক পদ বলে আখ্যা দেওয়া হলেও সুস্বাদু এই পদটি কিন্তু মোটেও বাঙালিদের নিজস্ব পদ নয়। আসলে ট্রাডিশনের আদান প্রদানে শুক্ত আজ বাঙালি সাবেক হেঁশেলের মেন পদ।
সাবেকি শুক্ত
প্রাচীন ভারতীয় রান্নার ইতিহাস থেকে জানা যায় কেরলবাসীর হাত ধরে শুক্ত রান্না সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে এর আগে পর্তুগিজদের মধ্যে এই শুক্ত রান্নার প্রচলন ছিল। প্রাচীনকালে পর্তুগিজদের একচেটিয়া খাবার ছিল শুক্ত। যে সমস্ত উপকরণ দিয়ে শুক্ত রান্না হত সেগুলো সবই ছিল স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। তবে পরবর্তীকালে এই সাবেকি রান্নার ধরন অনেকটাই বদলে গেছে। আজ এই সাবেকি রান্নায় যুক্ত হয়েছে দুধ এবং পোস্ত ব্যবহার। দুর্গাপুজোয় এই শুক্তর গুরুত্ব আছে।
সাবেকি রান্নার কথা পদ্মপুরাণে বেহুলার বিয়ের নিরামিষ খাবারের মধ্যেও উল্লেখ আছে। এছাড়াও ভারতচন্দ্রের লেখা অন্নদামঙ্গল কাব্যেও ২২ রকমের সাবেকি নিরামিষ পদের মধ্যেও শুক্ত ছিল অন্যতম। তবে সেসময় এই পদটি তিতো নামে পরিচিত ছিল। পুরাণ মতে রাঘব পণ্ডিত মহাপ্রভুর জন্য নীলাচলে যে-সমস্ত জিনিস নিয়ে গিয়েছিলেন তার মধ্যেও এই পদটি ছিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি খাবার।

আরও পড়ুন-বাংলা যা পারে, আর কেউ পারে না উচ্ছ্বসিত উৎসবের কামনা মুখ্যমন্ত্রীর

রাজরাজেশ্বরীর ভোগেও আছে সাবেকি ছোঁয়া
আগেকার দিনে রাজা, মহারাজা, জমিদার বাড়িতে পুজো উপলক্ষে সাবেকি রান্নাবান্না হত। কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পূজিতা দুর্গা রাজরাজেশ্বরী দেবীর ভোগেও ছিল সাবেকি রান্নার ছোঁয়া। মহাঅষ্টমীতে মাকে রাজবাড়ির নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি দুধে সেদ্ধ মিষ্টি পোলাও নিবেদন করা হত আর আজও হয়ে থাকে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই এই ভোগটি রাজ পরিবারের প্রধান রানি নিজের হাতে রান্না করতেন এবং বর্তমানেও এই নিয়ম চলে আসছে। এই পোলাওটি বাসমতী চাল, গাওয়া ঘি, পেস্তা, চিনি, দুধ, খোয়া ক্ষীর, গরমমশলা, কাজু, কিশমিশ, গোলাপজল এবং এক বিশেষ ধরনের হলুদ রং দিয়ে তৈরি করা হত।
বনেদি বাড়ির সাবেকি রান্না
প্রায় প্রত্যেকটা বনেদি পরিবারেই পুজো উপলক্ষে রান্না হত এক একটি বিশেষ পদ। আজ শতক পেরিয়েও সেই সময়কার রীতিনীতি ভাঙতে পারেনি অনেক পরিবার। আজও পুজোর সময় তাদের রান্নাঘরে সেই সমস্ত সাবেকি পদ রান্না করা হয়ে থাকে। শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো ছিল সুতানুটির সব থেকে বড় পুজো। আর এই পুজাতেই একটি সাবেকি পদ নবাবি রুই কোপ্তা কারি রান্না করা হত। অনেকেই মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারেন না, আর তাদের কথা ভেবেই এই দেব বাড়িতে মাছের এই পদটি রান্না করা হত, মাছের কাঁটা বেছে তাকে কোপ্তা আকারে গড়ে নিয়ে তারপর এটি রান্না করা হত। উত্তর কলকাতায় প্রসিদ্ধ লাহা পরিবারে পুজোর সময় অন্যতম রান্নাগুলির মধ্যে ছিল প্রধান ছিল সুজির নাড়ু আর শিঙ্গি-মরিচ। উত্তর কলকাতায় মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সাবেকি রান্নার মধ্যে কাঁচা তেঁতুলের চাটনি অন্যতম জিভে জল আনা একটি খাবার। কাঁচা তেঁতুল হাত দিয়ে ফাটিয়ে তার মধ্যে সর্ষেবাটা দিয়ে এই চাটনি রান্না করা হয়। আবার বিখ্যাত মল্লিক বাড়ির পুজোর দিনগুলোতে নিরামিষ খাবারদাবারের আয়োজন করা হলেও, ঠাকুর বিসর্জনের পর পাঁঠার মাংস খাওয়ার চল রয়েছে, আর এই মল্লিক বাড়ির উল্লেখযোগ্য পদ হচ্ছে মেটে চচ্চড়ি।

আরও পড়ুন-‘’সাধারণ মানুষ তাঁদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন’’, মহালয়াতে জনজোয়ার নিয়ে মুখ খুললেন দেবাংশু

সাবেকি রান্নার আঁতুড় ঘর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল
সাবেকি রান্নার কথা মনে আসলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি রান্নার কথা। এই ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল ছাদ সবকিছুই ছিল বাড়ির মেয়েদের দখলে। আর এই ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা রান্নার ওপর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর হাতের দইয়ের মালপো, মানকচুর জিলিপি, চিঁড়ের পুলি, পাকা আমের মিঠাই-এর ভক্ত ছিলেন সবাই। রবীন্দ্রনাথের দাদা হেমেন্দ্রনাথের মেয়ে প্রজ্ঞা সুন্দরীর হাত ধরে রান্নাঘরে ঠাঁই পেয়েছিল খেজুরের পোলাও, বিটের হিঙ্গি, পেঁয়াজের পরমান্ন, রামমোহন দোলমা পোলাও ইত্যাদি। ঠাকুরবাড়ির সাবেকি রান্নার মধ্যে ডুমুরের ছেঁচকি, মোচা ছেঁচকি, নিরামিষ ডিমের বড়ার কারি, দুধ দিয়ে বেগুন ভর্তা, নারিকেলের অম্বল, আলুর দমপক্ত, উচ্ছে দিয়ে মসুর ডাল এগুলোই এখন বাঙালির দুর্গাপুজো মণ্ডপ আলো করে রয়েছে। পুজোগন্ডার দিনে বহুযুগ ধরে অভিজাত, বনেদি বাঙালি পরিবারের হেঁশেলে ঠাকুরবাড়ির সাবেকি পদ রান্না হয়ে আসছে।
বাঙালির পুজো ও সাবেকি রান্না
সে-যুগ থেকে এ-যুগ, সবসময়ই বাঙালি বনেদি পরিবার থেকে মধ্যবিত্ত বা সাধারণ পরিবারে উৎসব মানেই হোল বাঙালিয়ানা। আর এই বাঙালিয়ানার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালি সাবেকি রান্না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রান্নার ধরন বদলালেও বদলাইনি সেই সাবেকিয়ানা। সেই সময় পুজো উপলক্ষে বাঙালির হেঁশেলে যে মহাভোজের আয়োজন করা হত তার মধ্যে অন্যতম ছিল কালিয়া এবং পোলাও। আদা রসুন পেঁয়াজ বেঁটে ঘন করে রান্নাকে বলা হত কালিয়া। এই কালিয়া মাছ এবং মাংস দুয়েরই হত। এছাড়াও নিরামিষ কালিয়ার মধ্যে এঁচোড়ের কালিয়া খুবই জনপ্রিয় একটি সাবেকি পদ। তবে আগেকার দিনে পোলাও বলতে মিষ্টি মিষ্টি ঘি-ভাতকেই বোঝানো হয়ে থাকে। আর এই পোলাওয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মোগলাই মশলা যুক্ত করা হত। সাবেকি রান্নার মধ্যে অন্যতম রান্নাগুলো ছিল চিতল গাদার জল বড়ার কালিয়া যেটি পরবর্তীকালে চিতল মাছের মুইঠা নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এছাড়াও ভাজাঝালের চিংড়ি মাছ, রুই মাছের টিকলি কালিয়া, করলা দিয়ে পুঁটি মাছের তেতো চচ্চড়ি— ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য সাবেকি রান্না।

আরও পড়ুন-হাসপাতালের মধ্যে গুলি করে ডাক্তার খু.ন, পলাতক দুই নাবালক

এখন বাঙালি
কিছু কিছু বাঙালি পরিবারে আজও দুর্গাপুজোর সময় বিভিন্ন ধরনের সাবেকি রান্না হয়ে থাকে। সকালের জলখাবারে থাকে চিরাচরিত ময়দার লুচি অথবা পুরভরা কচুরি আর তার সঙ্গে থাকে কাজু কিশমিশ নারকেল দেওয়া মিষ্টি মিষ্টি স্বাদের ছোলার ডাল অথবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে আলুর দম। আর এই জলখাবারের সঙ্গে শেষ পাতে মিষ্টি তো থাকেই থাকে। আর দুপুরের মেনুতে ষষ্ঠী থেকে দশমী এক এক দিন এক এক রকমই পদ থাকে। তবে প্রায় সমস্ত বাঙালি বাড়িতেই নবমীর দিন পাঁঠার মাংস খাওয়ার চল এখনও আছে। বনেদি বাড়ি বা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়িতে পুজোর ক’দিন সাবেকি রান্না হয়েই থাকে। কিন্তু যারা সাবেকি রান্নায় খুব একটা পটু নয়, তাদের কথা ভেবে আজকালকার বহু হোটেল বা রেস্টুরেন্টে পুজো উপলক্ষে তাদের মেনুতে সাবেকি পদ রাখে। আর তাই পুজোর ক’দিন আপামর বাঙালি সেই সাবেকি পদের স্বাদ আস্বাদন করতেই পারেন।

Latest article