মহালয়া মানেই পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের সূচনা। দেবীর মর্ত্যে আগমনের বাকি মাত্র আর হাতে গোনা ক’টা দিন। পুরাণ অনুযায়ী দুর্গাপুজোকে অকালবোধন নামে উল্লেখ করা হয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই অকালবোধন কী? কে করেছিলেন দেবীর অকালবোধন? কেন করেছিলেন?
পুরাণ অনুযায়ী, প্রিয়তমা পত্নী সীতাকে উদ্ধারের সময় লঙ্কার রাজার সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল শ্রীরামচন্দ্রের। শ্রীরামচন্দ্র অত্যন্ত চিন্তিত সেই সময়। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। মন মেজাজ অত্যন্ত খারাপ।
“মিথ্যা পরিশ্রম কৈনু, সঞ্চয় বানর
মিথ্যা কষ্টে করিলাম বন্ধন সাগর
মিথ্যা করিলাম যত রাক্ষস সংহার
লক্ষণের শক্তিশেল ক্লেশ মাত্র সার।।”
আরও পড়ুন-পুজোতে শিশামারা নদীর সঙ্গে গল্প
মিতা, শ্রীরামের এরকম অবস্থা দেখে বিভীষণ অত্যন্ত দুঃখিত। শুধু বিভীষণই নন, রঘুবীরের অবস্থা দেখে লক্ষ্মণ, বীর হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, নল, নীল, জাম্বুবান সবাই শোকে কাতর হলেন।
“রোদন করিছে সবে ছাড়িয়া সমর
দেখিয়া রামের দুঃখ কাতর অমর
দেবরাজ বিধাতারে সবিনয় কয়,
শ্রীরামের দুঃখ আর প্রাণে নাহি সয়।”
ইন্দ্রের কথা শুনে কমণ্ডলুপানি (ব্রহ্মা) বললেন একমাত্র উপায় হল দেবী পূজা।
ইন্দ্রের শুনিয়া বাণী কন কমণ্ডলু পানি
উপায় কেবল দেবী পূজা
তুমি পূজি যে চরণ জিনিলে অসুরগণ
বোধিয়া শরতের দশভুজা
পূজা কইলে রাম তাঁর হবে রাবণ সংহার,
শুন সার সহস্রলোচন।
অর্থাৎ ব্রহ্মা বললেন, পুরাকালে ইন্দ্র যেমন শরতে দেবী দুর্গার পূজা করে অসুর বিজয় করেছিলেন এখন রাবণ বধের জন্য রামচন্দ্রকেও দেবীর সেই অকালবোধন করতে হবে। সুরপতি ব্রহ্মা এটা শুনে, প্রেমে পুলকিত মনে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। সব শুনে রাম অধীর আগ্রহে ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসা করলেন কী কী বিধান কী উপায় সব আমাকে খুলে বলো।
শ্রীরাম কহেন তবে, কীরূপে পূজিতে হবে
অনুক্রম কহ শুনি তার।
তারপর রাম নিজের মনেই বললেন বসন্ত শুদ্ধ সময়। কিন্তু শরৎকাল তো অকাল পুজোর পক্ষে। দেবী এখন নিদ্রায় আছেন। তাছাড়া দেবীবোধনে বিহিত তিথি কৃষ্ণা নবমী। কৃষ্ণ নবমীর দিনে বোধন করা যায়। সে তিথিও অতিক্রান্ত। রাজা সুরথের শুক্লা প্রতিপদে কল্পারম্ভের দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু সে তিথিও গত।
কল্পারম্ভে সুরথ-রাজার
সেদিন নাহিক আর, পূজা হবে কি প্রকার,
শুক্লা ষষ্ঠী মিলিবে প্রভাতে।
তীরে এসে তরী ডোবে আর কি! তিথিনক্ষত্র মিলছে না। রাম পড়েছেন মহা বিপদে। উপায় একটা বের হল। ব্রহ্মা বললেন—
“করো ষষ্ঠী কল্পেতে বোধন।”
আরও পড়ুন-বস্ত্র বিতরণ থেকে ডান্ডিয়া, মণ্ডপ মাতালেন মুখ্যমন্ত্রী
অধর্মের লড়াই। তাই ধর্ম স্থাপনার বৃহত্তর স্বার্থে প্রয়োজন হলে দেবীর অকালবোধন করতে হবে। উপদেশ পেয়ে রাম খুব খুশি হলেন এবং ব্রহ্মা গেলেন নিজের ধামে। অন্ধকারের পরে যেন আলোর দিশা পেলেন রঘুবীর। আঁধার কেটে ভোর হল। শুক্লা ষষ্ঠীর ভোরে রাম স্নান করে, বনফুল, ফলমূল নিয়ে সাগরের কূলে গিয়ে কল্পারম্ভ শুরু করলেন।
“পূজি দুর্গা রঘুপতি, করিলেন স্তুতি নতি,
বিরচিল চণ্ডী পূজা গান।”
প্রেমানন্দে চণ্ডীপাঠ করে রাম উৎসব করলেন। দেবীর গুণ গেয়ে, নেচে সঙ্গে হনুমানেরাও জয় গান দিতে লাগলেন।
দেবীর অর্চনায় সূর্য অস্তে চলে গেল। সায়নকালে রাম বোধনে বসলেন।
নিজের হাতে রাম মৃন্ময়ী মূর্তি গড়লেন।
“আপনি গড়িল রাম মূরতি মৃন্ময়ী
হইতে সংগ্রামে দুষ্ট রাবণ বিজয়ী
আচারেতে আরতি করিলে অধিবাস
বান্ধিলা পত্রিকা নববৃক্ষের বিলাস।।”
এইভাবে ষষ্ঠীর রাত গেল। আবার সূর্যোদয়ের পর রাম বেদবিধি মতে পুজো আরম্ভ করল।
সপ্তমী সাঙ্গ হয়ে অষ্টমী এল। আবার রঘুনাথ পূজা অর্চনা করল। কিন্তু দেবীর সাড়া মিলল না।
নিশা কালে সন্ধিপূজা কৈলা রঘুনাথ
নৃত্য গীতে বিভাবরী হইল প্রভাত।
নবমীতে পূজে রাম দেবীর চরণে
নৃত্য গীতে নানা মতে নিশি জাগরণে
নবমীতে রঘুপতি, পূজিবারে ভগবতী
উদ্যোগ করিল ফল–মূল।
আরও পড়ুন-জেলের আবাসিকদেরও উৎসবের ছোঁয়া, পাতে পড়ছে বিরিয়ানি-চিংড়ি
সমস্ত বানর সেনারা ফুল সংগ্রহ করে আনলেন। অশোক, কাঞ্চন, জবা, মল্লিকা, মালতী, পলাশ, পাটুলি, বকুল, স্থলপদ্ম, কদম্ব, পারুল, রক্তোৎপল শতদল, কুমুদ, আমলকীর পাতা, পারিজাত, শেফালী, করবী, কনক, চম্পক, কোকনদ, ঝম্পক, চম্পক, নাগেশ্বর কাষ্টমল্লিকা, দোপাটি, যূথী, দ্রোণপুষ্প মাধবী, টগর, তুলসী, তিসি, কেতকী, পদ্ম, কৃষ্ণকলি, স্বর্ণযূথিকা, শিউলি, গোলাপ, কৃষ্ণচূড়া এবং অজস্র বনফুল সচন্দনে অর্পিত হল দেবীর ঘটে। নৈবেদ্যের আয়োজন বানররা করল অপূর্ব অপূর্ব সব বনফল দিয়ে। এই সমস্ত উপাচার দিয়ে পরম আনন্দে রাম শঙ্করীকে পুজো দিলেন লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে।
পুজো করলেন বটে কিন্তু দেখা পেলেন না দেবীর। (এরপর ১৯ পাতায়)
(১৬ পাতার পর)
বিভীষণে কন রাম কি হইবে আর
আমা প্রতি দয়া বুঝি না হইল দুর্গার।
বঞ্চনা করিলা দেবী বুঝি অভিপ্রায়
সীতা উদ্ধারে আর নাহিক উপায়।
বিভীষণ কাতর হয়ে এক উপায় বললেন। এক কাজ করো রঘুবীর। একশো আটটা দুর্লভ নীলপদ্মের অর্ঘ্য দাও দেবীকে। তাহলে তিনি প্রসন্ন হবেন।
শুনে রাম আরও চিন্তিত হলেন। নীলপদ্ম দেবের দুর্লভ। “দেবের দুর্লভ যাহা কোথায় পাবে নর”—
আমার দুর্ভাগ্য আর কিছু করার উপায় নেই। রঘুবীরকে কাতর দেখে হনুমান বললেন, স্থির হও। চিন্তা দূর করো। আমি দাস। আমি থাকতে প্রভুর মনে কেন চিন্তা আসবে!
“স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ভ্রমিয়া ভূমণ্ডল
মুহূর্তে আনিয়া দিব শতনীলোৎপল”
দেবীদহে নীল পদ্ম আছে। মানস সরোবরের তীরে, নীল পাহাড়ের উপরে অবস্থিত দেবীদহ। অত্যন্ত দুর্গম সে-পথ। সেখানে রয়েছে দুর্লভ নীলপদ্ম।
সময় লাগে সে-পথে দশ বছর!
হনুমান বললেন কুছ পরোয়া নেই। আমি এনে দেব। বলে শ্রীরামকে প্রণাম করে শ্রীহনুমান দেবীদহের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
হনুমানকে পাঠিয়ে শ্রীরামচন্দ্র দেবী চণ্ডিকার স্তব করতে লাগলেন।
“দুর্গে দুঃখহরা তারা দুর্গতিনাশিনী
দুর্গমের শরণ্যা বিন্ধ্য গিরি নিবাসিনী”
আরও পড়ুন-দামোদর নদে ধরা পড়ল ইলিশ, উঠল নিলামে
নানারকম স্তবস্তুতি করতে লাগলেন দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র এক মনে। হৈমবতী অমর ঈশ্বরী তুষ্ট হলেন।
এরই মধ্যে শুক্ল পক্ষের পঞ্চমীর মধ্যরাতে হনুমান একশো আটটা নীলপদ্ম তুলে রামের কাছে এল। আনন্দিত মনে রাম শঙ্করীর চরণে অর্পণ করতে লাগলেন। গুনে গুনে রাম পদ্ম দিচ্ছেন, দেখা গেল একটি পদ্ম কম! একটু আগে হনুমান গুনেছে তখন ঠিকই ছিল— এরই মধ্যে কী হল!
কেঁদে পড়লেন রাম দেবীর চরণে।
যোগমায়া যোগে মোরে আনিলে ভূতলে
বিড়ম্বনা করিয়া ভাসালে শোকজলে।
রাগে, দুঃখে, হতাশায় রাম ঠিক করলেন—
“নীল কমলাক্ষ মোরে বলে সর্বজনে
নয়ন যুগল মোর ফুল্ল নীলৎপল
সংকল্প করিব পূর্ণ বুঝিবে সকল
এক চক্ষু দিব আমি দেবীর চরণে
এত বলি কহে রাম অনুজ লক্ষ্মণে
কমললোচন মোরে বলে সর্বজনে
এক চক্ষু দিব আমি সংকল্প পূরণে।”
কাঁদতে কাঁদতে রাম দেবীর প্রসন্নতার জন্য নীলপদ্মসদৃশ চোখটা উপড়ে ফেলতে তূণ থেকে বাণ হাতে নিয়ে একটি চোখ উৎপাটন করতে উদ্যত হলেন। সেই সময়ে সন্তুষ্ট দেবী আবির্ভূতা হলেন।
রামের হাত ধরে তাঁকে নিবৃত্ত করলেন। সবিস্ময়ে রাম দেখলেন সেই মৃন্ময়ী প্রতিমা চিন্ময়ী রূপে তাঁর সামনে আবির্ভূতা! এবারে তিনি বললেন রামচন্দ্রের ভক্তিতে তিনি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছেন। এবং এই মুহূর্ত থেকে তিনি পাপিষ্ঠ রাবণকে পরিত্যাগ করলেন। দেবীর রক্ষাবলয় রাবণকে আর রক্ষা করবে না।
রামের অভিলাষ পূর্ণ হবে। মহাষ্টমীর সকালে রামের ধনুকে দেবী শক্তিময়ী হিসেবে আবির্ভূতা হবেন। মহা অষ্টমী ও মহা নবমীর সন্ধিলগ্নে শ্রীরামের হাতে বিনাশ হবে রাবণ। সুতরাং এখন রামচন্দ্র রাবণকে বধ করতে পারবেন। সমস্ত মর্ত্যলোকে অকালবোধন নামে এই পুজো পরিচিতি পাবে। এই শরৎকালেই দেবী মহিষাসুরমর্দিনী রূপে বিরাজ করবেন মর্ত্যে। এই বলে দেবী অন্তর্হিত হলেন।
কৃত্তিবাস লিখেছেন—
নাচে গায় কপিগণ
প্রেমানন্দে নারায়ণ
নবমী করিল সমাধন
দশমীতে পূজা করি
বিসর্জিয়া মহেশ্বরী
সংগ্রামে চলিল রঘুপতি।।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে ষষ্ঠাদিকল্পের ক্রম অনুযায়ী দুর্গাপুজোর যে বর্ণনা আছে, সাধারণত সেই ক্রম ও পদ্ধতি এখনও বঙ্গদেশে অনুসৃত হয়ে থাকে।