(গতকালের পর)
পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিশ্ব ব্যাঙ্কের সহায়তায় উইমেন এমপ্লয়মেন্ট প্লাটফর্ম (WEP) শুরু করেছে; যাতে নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি সম্ভবপর হয়। এই কারণেই ২০২৪-’২৫ সালের বাজেটে আলাদা করে জেন্ডার অ্যান্ড চাইল্ড বাজেট স্টেটমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ৪৪% নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। নারী ও শিশুবিকাশ এবং সমাজকল্যাণ দফতরের খাতে প্রায় ২৬৫৯০ কোটি টাকা বাজেট-বরাদ্দ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-নিরঞ্জনের পর গঙ্গায় ভাসে লাল ফোঁটার সাদা টিকটিকি
নারী স্বাধীনতার ও আত্মনির্ভরতার একটা অন্যতম ক্ষেত্র স্বনির্ভর গোষ্ঠী। ২০১০-’১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৫৫৩টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী ছিল যা বর্তমানে ১৬,২২২টি হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ২৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সকল মহিলা পরিচালিত স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিতে ১৬ লক্ষ মহিলা বার্ষিক প্রায় এক লক্ষের বেশি অর্থ আয় করে। আগামী বছর এই গোষ্ঠীগুলিতে নারীদের অংশগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ২২ লক্ষ স্থির করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উপজাতি সদস্য দ্বারা পরিচালিত লোকাল এরিয়া মাল্টিপারপাস সোসাইটির (LAMPS) মাধ্যমে মহিলাদের জন্য টাকা জমানো, ঋণের সুবিধা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে ১০ হাজার মহিলা পরিচালিত স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যার জন্য ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় এক লক্ষ উপজাতি মহিলা উপকৃত হবেন।
এ ছাড়াও সরকারি মহিলা কর্মচারীদের জন্য যেখানে, অধ্যাপিকা-শিক্ষিকা প্রমুখরাও অন্তর্ভুক্ত। ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি-সহ শিশু পরিচর্যার জন্য দু’বছরের ছুটি অনুমোদন করেছেন (Child Care Leave)। এর আগে কোনও সরকার এ-ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার বিক্ষিপ্তভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। আবার বিধবা ভাতার জন্য প্রায় ১৬০৭ কোটি টাকা ২০২৩-’২৪ সালে ব্যয় হয়েছে। যেখানে ১৯.২৭ লক্ষ নারী উপকৃত হয়েছেন ২০২৪ সালে দুয়ারে সরকারের মাধ্যমে আরও এক লক্ষেরও বেশি বিধবা ভাতার আবেদন জমা ও মঞ্জুর হয়। মাননীয় নেত্রী এক কোটির বেশি আশা কর্মীর সাম্মানিক বৃদ্ধি ও অবসরকালীন সুবিধা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায়শই সঠিক সময়ে তাদের দেয় অর্থ পাঠায় না। অন্যদিকে, প্রায় সাত হাজারের বেশি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর সাম্মানিক বৃদ্ধি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই সঙ্গে ছয় বছরের নিচে ৬৯.১১ লক্ষ শিশুকে এবং ১২.২৯ লাখ গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের জন্য মাস-প্রতি ২৬ দিন করে নিয়মিত গরম রান্না করা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পূর্বোক্ত সকল সুবিধা যাতে প্রতিটি নারী পেতে পারে তার জন্য মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ৩৪১টি ব্লকে একটি করে ‘সহেলী সভা’ গড়ে তুলেছেন। সেই সভা এমন এক বাস্তববাদী পদক্ষেপ যার ভিত্তিতে মহিলারা প্রতিটি কল্যাণকামী প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করতে পারে অর্থাৎ সহেলি সভা নারীরা তাদের প্রাপ্য সুবিধাগুলি কীভাবে পাবে সেই সম্পর্কে অবহিত ও সাহায্য করে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সরকার সর্বস্তরের মহিলাদের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এনে তাদের প্রকৃত ক্ষমতায়নের এবং সমাজ গঠনের পথ (কারণ মহিলারাই পরিবারের অন্যতম ভিত্তি) প্রশস্ত করেছেন।
আরও পড়ুন-মৃত্যুপুরী লেবানন: মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২ হাজার, গৃহহীন ১২ লক্ষ
পূর্বোক্ত প্রকল্পগুলি একদিকে যেমন নারীদের ক্ষমতায়নের সহায়ক তেমনি তাঁদের সুরক্ষার পথকেও প্রশস্ত করে। কারণ যখনই ক্ষমতায়ন সুনিশ্চিত হয় তখনই সুরক্ষার প্রসঙ্গ তার সমানুপাতিক হয়। তথাপি কতগুলি সুরক্ষার ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখা অত্যন্ত জরুরি পশ্চিমবঙ্গে ৮৮টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট রয়েছে তার মধ্যে ৫২টি মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট। ওই ৫২টি কোর্টে ৩ লক্ষ ৯২ হাজার ৬০০টি মামলা নিবন্ধিত হয়েছে এবং তার মধ্যে ৩ লক্ষ ১১ হাজার ৪৭৯টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১১ সালের আগে পশ্চিমবঙ্গে একটিও মহিলা থানা ছিল না। বর্তমানে ৪৯টি মহিলা থানা হয়েছে। রাস্তায় নারী-সুরক্ষার জন্য মহিলা সুরক্ষা টহল বাহিনী তৈরি হয়েছে। এনসিআরবির রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতা ভারতের মধ্যে সবথেকে নিরাপদ শহর। তা সত্ত্বেও নারীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা যাতে না হয় সেই কারণে দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী কড়া শাস্তির বিধানের জন্য বারংবার কেন্দ্র সরকারকে জানিয়েছেন। তাতে উপকার না হওয়ায় অর্থাৎ কেন্দ্র সরকার কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি বিধানসভায় ‘অপরাজিতা বিল’ (২০২৪) পাশ করেন। এই বিলে নারীদের উপর ধর্ষণের মতন নির্যাতনের ঘটনার আটকানোর জন্য একদিকে যেমন ফাঁসির মতন কঠোর সাজার ব্যবস্থা রয়েছে তেমনই অনুসন্ধান তথা তদন্ত প্রক্রিয়া যাতে দ্রুত শেষ হয় এবং মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয় সেই বিষয়েও দিক নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। এই আইনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ভারতের একটি অন্যতম রাজনৈতিক দল এনসিপি-র তরফে শরদ পাওয়ার উদ্ধৃতি করেন যে ভারতের সর্বত্র অপরাজিতার মতন আইন লাগু হওয়া আবশ্যক।
নারী-সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলা ভারতকে পথ দেখাচ্ছে। তাই তো কন্যাশ্রী প্রকল্প রাষ্ট্রসঙ্ঘের মঞ্চ থেকে পুরস্কার পায়। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক বিশ্বাস ব্যবস্থা। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলার সরকার গরিব-প্রান্তিক শ্রেণির মহিলাদের কাছে তাঁদের আত্মসম্মান ফিরিয়ে দিতে যথেষ্ট ভূমিকা নিয়েছে। ভারতের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাই যখন বিভিন্ন পুরুষতান্ত্রিক মনুবাদী
দল তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা করেন তখন মনে হয় পশ্চিমবঙ্গ তাঁর নেতৃত্বে এমন এক গণতান্ত্রিক আবহ পেয়েছে যেখানে বিরোধী স্বর আটকানো হয় না। তবে এমন বিরোধী স্বর ভারতব্যাপী আর কোথাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যত বিরোধিতাই হোক না কেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী একজন নারী হিসেবেই আবার এ-কথাটা প্রমাণ করতে পেরেছেন যে নারী-সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নের জন্য বাংলা যা ভাবে ভারতের অন্যান্য রাজ্য তারপরে ভাবে। তাই নজরুলের কথায় (সাম্য) শেষ করা যাক— ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর; অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ (শেষ)