বাংলা ভাষাকে ভারতের একটি ‘ধ্রুপদী’ ভাষার মর্যাদা দান করা হল। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে সম্প্রতি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলার মানুষ, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষাদফতর এই দাবি করে আসছিলেন। এখন সেটা মান্যতা পেল। কিছুদিন আগে যখন ভারতের দক্ষিণ অংশের একাধিক ভাষা এই মর্যাদা পেল তখন আমরা বাঙালিরা খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম। বাংলা বাদ কেন? এটা ভেবেছিলাম। বিগত ২ বছর আমাদের শিক্ষাদফতরের সংশ্লিষ্ট সংস্থা (ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ) অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এই সংস্থার অধীনে কাজ করেছেন প্রচুর শিক্ষাবিদ, গবেষক-সহ কর্মীরা। বাংলার মর্যাদা দানের পক্ষে যুক্তিগুলি ভালভাবে সন্নিবেশিত করেছেন একটার পর একটা দলিলে। ৪টি খণ্ডে সেগুলি যুক্ত করে কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থায় পাঠানো হয়েছে। ইতিবাচক ফলও এসেছে।
আরও পড়ুন-কাঁকসা হাটতলার পুজো উদ্বোধনে নায়িকা কৌশানি
রাজ্য শিক্ষাদফতর ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির সকলকে আমাদের ধন্যবাদ। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সব সময় এ ব্যাপারে সজাগ থেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীও তাই। এঁদের ধন্যবাদ দেওয়া বাহুল্য। তবে বাংলার মানুষের কাছে, বাঙালির কাছে, বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে সমগ্র প্রক্রিয়াটি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘ধ্রুপদী’ শব্দটির প্রয়োগ শিল্পসাহিত্যে দেখা যায়। অর্থ হল অভিজাত্যপূর্ণ, বা অত্যুৎকৃষ্ট। যেমন ধ্রুপদী সঙ্গীত। ধ্রুপদী নৃত্য ইত্যাদি। ধ্রুপদী সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গিটির জন্ম হয়েছিল গ্রিসে। পরবর্তীতে ধ্রুপদী সাহিত্যতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা হয়। কী মানদণ্ডে ধ্রুপদী তকমা দেওয়া হয় সেটা বলি। মোটামুটি ৩টি কারণকে ধরা হয়। (ক) আজ থেকে যা ১৫০০ বা তার বেশি বছরের পুরনো। (খ) ভাষাকে হতে হবে স্বাধীন ও স্বাবলম্বী অর্থাৎ অন্য কোনও একটা ভাষা থেকে জন্ম নেওয়া ঐতিহ্য-পরম্পরা নয়। (গ) ওই ভাষাতে উন্নত মানের সাহিত্য রচিত হতে হবে। নিশ্চয় আমাদের পাঠকরা জানেন যে, এই সমস্ত মানদণ্ড অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ৬টি ভাষাকে ‘ধ্রুপদী’ ভাষার মান্যতা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হল তামিল, সংস্কৃত, গ্রিক, লাতিন, চিনা এবং আরবি। ধ্রুপদী ভাষায় চর্চা কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সেভাষা মৃতপ্রায়। ধ্রুপদী ভাষাগুলো থেকেই ঋণগ্রহণ করে অনেক ভাষা আধুনিক শব্দ ভাণ্ডার গড়ে তোলে এবং আধুনিক হয়ে ওঠে। যেমন সংস্কৃত ভাষা। ২০০৪ সালে ভারত সরকার আমাদের দেশে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিয়েছিল। এই সময় ভাষার বয়সকাল ১ হাজার বছর ধরে নেওয়া হয়েছে। এখন সেটাই বলবৎ আছে। বাংলাভাষা কতদিনের পুরনো তা নিয়ে অনেক কথা ও অনেক বিতর্ক আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেন মহাশয়ের সূত্র যদি মান্য করি তাহলে বাংলা দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর ভাষা। কিছু ‘চর্যাগীতি’র কবিদের সময়কাল ধরে ড. শহীদুল্লাহ প্রমাণ করেছেন যে, চর্যার আদিকবি মীননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথের সময়কাল সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝিকাল। অর্থাৎ আনুমানিক ৫৬০ খ্রিস্টাব্দ। ড. শহীদুল্লাহ প্রমাণ করেছেন ‘পত্রসম্ভব’-এ উল্লেখ আছে শবরূপা যখন তিব্বতে যান সেটা ৬৭০/৬৫০ খ্রি.। সুকুমার সেন তারপর বলেন ‘বিক্রমোবর্শী নাটকের অপভ্রংশ গানগুলি যদি ৭ম/৮ম শতাব্দীর রচনা হয় তাহলে চর্যার গানগুলিও সেই সময়কালের। অর্থাৎ ৭ম/৮ম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করেন। সেই সময় ধরে বলা যায় চর্যার গান ও কালিদাসের রচনা একই সময়ের। তাহলে বাংলা ভাষার সময়কাল ১৪০০ বছর বা তার বেশি প্রমাণ হচ্ছে। আমরা যেন ভুলে না যাই যে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব আসার পরেই চর্যাগান লেখা হয়েছে। তার আগেও তা লোকভাষা হিসাবে প্রচলিত ছিল। মানুষ কথাবার্তা বলত। সুতরাং বাংলাভাষার প্রাচীনত্ব প্রশ্নাতীত। বাংলা ভাষা স্বাধীন ও স্বাবলম্বী কিনা তা নিয়ে বিতর্ক বহুদূর বিস্তৃত। একসময় বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত ভাষার দুহিতা বলা হত। বর্তমান সময়ে ভাষাতাত্ত্বিকেরা সেটা সত্য বলে মনে করেন না। বরং সংস্কৃত এবং বাংলাকে ভগিনী বলে মনে করেন। এটা সত্য যে, বাংলাভাষার আর্যীকরণ হয়েছে। প্রাকৃতজনের মুখের ভাষা থেকে তার উত্তরণ হয়েছে। তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেড়েছে। বাংলার উদ্ভব কালে তৎসম শব্দের সংখ্যা কম ছিল সেটা জানা কথা। চার্যাগীতির ভাষা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তাতে ৫০ শতাংশের কম তৎসম শব্দ আছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পর বাংলায় তৎসম শব্দের প্রয়োগের পরিমাণ বেড়েছে।
আরও পড়ুন-অধরা পদকের যন্ত্রণা নিয়েই অবসর দীপার
অতীত এবং বর্তমান বাংলাভাষার ভাষারূপের পার্থক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আদি বাংলাভাষায় নিদর্শন হিসাবে চার্যাগীতির ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও আন্বয়িক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আধুনিক বংলাভাষার হুবহু মিল নেই। সময় পেরিয়ে এবং অন্য ভাষার প্রভাবে তা পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাভাষা আজ নানা উপভাষা নিয়ে বিরাজ করছে।
বাংলা ভাষায় উন্নত সাহিত্য রচনা নিয়েও কথা বলার আছে। দীনেশচন্দ্র সেন প্রথম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখেন। তিনি তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ অধ্যায়ে লেখেন অষ্টাদশ পুরাণ ও রামচরিত যারা সংস্কৃত ছাড়া অন্য ভাষায় লিখবে বা শুনবে তারা রৌরব নরকে যাবে। কৃত্তিবাস ওঝা, মালাধর বসু, কাশীরাম দাশদের কী হয়েছে বলা যায় না। তুর্কি আক্রমণের পর মুসলমান শাসকদের সাহায্যে বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ল। রাজসভার অনুপ্রেরণায় মধ্যযুগে রচিত হল একের পর এক বাংলা সাহিত্য। বাংলা সাহিত্য ও ভাষার শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে। এই ভাষা মুখে নিয়েই জন্মেছেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যে প্রথম নোবেল জয়ী তিনি এশিয়ার মধ্যে। মূল বইটি বাংলায়।
আরও পড়ুনকাঁকসা হাটতলার পুজো উদ্বোধনে নায়িকা কৌশানি
মধ্যযুগের বাংলা ভাষায় লেখা ঘনরাম চক্রবর্তীর ‘শ্রীধর্ম্মাঙ্গল’ কাব্যটি একটি মহাকাব্য। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’— ধ্রুপদী সাহিত্যের দাবিদার। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’র চলচ্চিত্রায়ণ আর রবীন্দ্র-নজরুলের মধুময় সঙ্গীত ধ্রুপদী মান ছাড়া আর কী হতে পারে? আজ যখন বাংলা ভাষা ধ্রুপদীমান সম্পন্ন হয়েছে তখন আমাদের প্রিয় গবেষক ও সাহিত্যকদের কথা। যাঁরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে বাংলা ভাষাকে নতুন রূপে আবিষ্কার করেছেন। তার জন্য কষ্ট স্বীকার করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নীহারঞ্জন রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. শহীদুল্লাহ। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতকোত্তর অধ্যায়ে পড়ানো শুরু হল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ নিল বাংলা বানান ও পরিভাষা সংস্কারে ও সংকলনে। আধুনিক সময়ে অনেক গবেষক বাংলা ভাষার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। সকলের পরিশ্রম আজ মান্যতা পেয়েছে। বাঙালির কাছে এটা একটা গর্বের ব্যাপার তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়। সারা বাংলা যখন উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা, আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। তখন এমনতর আনন্দসংবাদ আমাদের বাংলাকে আরও উজ্জ্বল করেছে।