মাতৃ আগমন

আজ ষষ্ঠী। দেবীর বোধন। তদুপলক্ষে বাংলার দুর্গোৎসবকে ফিরে দেখার আয়োজন ‘জাগো বাংলা’র পাতায়। আজকের লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৭ বঙ্গাব্দের (১৯২০ খ্রি.) কার্তিক সংখ্যার ‘যমুনা’ পত্রিকায়। ব্রিটিশ-শাসিত বঙ্গদেশে দুর্ভিক্ষের প্রতিবেশে সেবারেও ভাটা পড়েনি মাতৃ আবাহনের। সে-কথাই ফুটে উঠেছে এই লেখায়। লেখক ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

Must read

আজি শরতের শিশিরাঙ্কিত নির্মূল উষায় বালার্কের তরুণদ্যুতি তরলস্পর্শে সদ্যস্নাতা ধরিত্রীর বরাঙ্গ ভরিয়া সজীব দুর্ব্বাদলে অশেষ পুলকের সঞ্চার করিল, প্রকৃতির জীবন সমুদ্র তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়া পড়িয়া উল্লসিতের হৃৎকম্পের মত বহিয়া গেল— ঘুম ভাঙ্গা বিহঙ্গের চকিত কাকলী মধু গন্ধী সমীরণে মিশিতে না মিশিতে বাঙ্গালার মন্ত্র পবিত্র গৃহ তপোবনে ধ্বনিত হইয়া উঠিল— ‘যা দেবী সর্ব্বভূতেষু।’
অতীতের কোন্ স্মৃতি সম্বল পুণ্যক্ষণে এমনি এক মোহময় শরৎপ্রভাতে স্নেহ বিলুলিতা মেনকার মাতৃহৃদয় করুণ আবেগে গাহিয়া উঠিয়াছিল— ‘গৌরী উমা শঙ্করী’, আজিও সেই স্মরণাতীত কালের মাতৃ হৃদয়ের পুঞ্জীভূত ঘন ব্যাকুলতা ভবসংক্ষুব্ধ বিলসিত বাঙ্গালীর মর্ম্মের মাঝখানে নবীন হইয়া, প্রবল হইয়া, একান্ত হইয়া আগমনীর গীতি গাহিয়া উঠিতেছে। অনন্তকালের বক্রগতির সহিত ভাসিয়া আসা এক শুভদিনের পরিকল্পনা তার অপেক্ষা অন্তরকে সজীব করিয়া তুলিয়াছে, বাৎসল্য ভাবাশ্রিত সাধকের স্নেহ চঞ্চল হৃদয় শ্যামকান্তি ধরণীর কুসুমাঞ্চিত উরসে স্তম্ভিত সৌন্দর্য্যের মায়ার খেলা লক্ষ্য করিয়া সেই তনয়া মিলনোৎকণ্ঠিতা পাষাণী জননীর মতই গাহিয়া উঠিতেছে—
‘‘আমার উমা আস্ বে শুনে—
আমোদিনী বিহঙ্গিনী গায় বন বিমোহিনী
হাসে উষা বিনোদিনী জড়িত রতনে।”

আরও পড়ুন-পুজোয় থাকুন সুস্থ

এক স্বপ্নাচ্ছন্ন জগতের প্রাণস্পর্শী সুখচিত্রের মত স্নেহপ্রবণ হৃদয়ের ভাবঘন বিগ্রহ প্রতি অন্তরের ভক্তিচন্দনবাসিত হেমমন্দিরে অপূর্ব্ব গড়িমায় জাগিয়া উঠিতেছে— মর্ম্মের কুঞ্জে কুঞ্জে নির্ম্মুক্ত উষালোকে কাব্যের চকিত ছন্দের মত আগমনীর ললিত রাগিণী ধ্বনিয়া উঠিতেছে; তাই আজ আবেশ বিভোর বাঙ্গালীর হৃদয় ত্র্যস্ত অথচ ধারা গর্ব্বিত; তার আঁধারঘেরা আকাশের শীর্ণ শুকতারা উজ্জল হইয়া উঠিয়াছে, তার ঘুমন্ত কুঞ্জবনের মূর্ছিত মাধুর্য্য শত পুষ্পসম্ভারে জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছে।
চকিতে যেদিন মেনকার আশঙ্কিত হৃদয়ে স্নেহ সুলভ উৎকণ্ঠায় ব্যাকুল হইয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছিল— ‘কুস্বপন দেখেছি গিরি, উমা আমার শ্মশান বাসী’— সম্বৎসরের অদর্শন তখন তাহার এমনি মর্মান্তিক হইয়া উঠিয়াছিল যে, তূর্ণাগত গৌরীর ‘মা মা’ ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই তাহাকে শান্ত করিতে পারে নাই; শ্মশান ভয়-ভীতা জননী আপনার স্নেহাঞ্চলচ্ছায়ে কন্যাকে আবৃত করিয়া তৃপ্তির আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু আধিব্যাধিপীড়িত আমরা মহাকালের মনোমোহিনী মাকে আমাদের ‘উন্মত্ত ভ্রমরমুখর’ ‘নিত্যজ্যোৎস্না প্রতিহত তট বৃত্তিরম্য’ কৈলাসের আনন্দ নিকেতন হইতে কোথায় আহ্বান করিতেছি? আমরা সে সত্যকে হারাইয়া ফেলিয়াছি, সে সত্য একদিন নগরে-কাননে পর্ব্বতে প্রান্তরে এমনি জাগ্রৎ ছিল যে, জগৎ মুগ্ধ বিস্ময়ে অবনতমস্তকে আমাদের নিকট সে সত্যালোক গ্রহণ করিয়া ধন্য হইত; আর আমরা তপস্যায় বল পাই না; ত্যাগে, কর্ম্মে শোভা সম্পন্ন না হইয়া আমরা জগতের চক্ষে ক্রমশঃ হেয় হইতেছি— ক্ষুদ্রতায় অত্যাচারে, তপস্যাহীনতায় আমাদের সোনার গৃহাঙ্গণ আমরা যে শ্মশানে পরিণত করিয়াছি।
বহুদিন আমরা বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর শোভা দেখিতে ভুলিয়া গিয়াছি, সুরথের মত সাধনা নাই— রামচন্দ্রের মত ঐকান্তিকতা নাই, জননীর রাতুল চরণপূজা করিতে নীলোৎপলের অভাবে চক্ষুঃ উপড়াইয়া দেওয়ার কল্পনাও আমাদের নিকট উপহাসের সামগ্রী; মুক্তির ও বিচারের কুহেলিকা আবরণে বিশ্বাসহীনতা আমাদিগকে অধিকার করিয়া ফেলিয়াছে। তাই এখন আর সেই অনুভূতি নাই, আগমনী মন্ত্রের প্রতিশঙ্খোচ্চারণে সেই ভাববিকম্পিত রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠের সচেষ্ট আগ্রহ নাই— তটস্থ মানসে ‘পূর্ণেন্দুসদৃশাননায়’ পূর্ণ বিকাশ উপলব্ধি করিয়া নিমীলিত নয়নের ঘনপদ্মজালবিসর্পী সেই সদ্যগাঢ় মুখশংসী অশ্রুর প্রবাহ নাই। শুধু সেই ম্রিয়মাণ গৌরবের স্মরণাশ্রিত আনন্দ কল্পনা বৎসরান্তে এক বার করিয়া নিরপেক্ষ উৎসাহে ফুটিয়া উঠে— আমাদের সত্যহারা সন্দেহ আকুলিত হৃদয়ের মর্ম্মের মাঝখানে— আমাদের পথহারা ব্যথা ব্যাকুলিত হৃদয়ের মাঝখানে— সত্যগুরুর অচল পদবিক্ষেপের মত একবার করিয়া সেই মহিমোজ্জল শুভদিনের আভাস জাগিয়া উঠি— যে শুভদিন সুরথের ভীষণ আবহের ভৈরব ভ্রুকুটির ভিতর গুপ্ত আকার মতো লুক্কায়িত ছিল, রামায়ণের মর্মন্তুদ দরবারী শোণিত প্রবাহে যে শুভদিন শুভ্র বুদ্বুরূপে ফুটিয়া উঠিয়াছিল।

আরও পড়ুন-এই দুর্গোৎসবে চাঁদা দেন বিল গেটস, পঞ্জিকা নয়, সিয়াটেলের পুজোয় সম্বল ভক্তিরস

আজি এই দুর্ভিক্ষপীড়িত শব বিস্তীর্ণ শ্মশান প্রাঙ্গণে মাকে আমাদের কিরূপে অভ্যর্থনা করিব? শেফালির মুক্ত হাসিতে, টগরের সরস স্মিত আননে চাহিয়া মাকে ভাবিতে যে আজি সংশয় জাগে, শব দাহ গন্ধ-কুঞ্চিত নাসিকায় চন্দন ঘ্রাণ যে আজি প্রবেশ করিতে পারে না, উদরান্নের তীব্র অভাব নিষ্পেষণে আমাদের শেষ দুর্ব্বাটি পর্য্যন্ত নিঃশেষিত হইয়াছে— শেষ কড়িটি পর্যন্ত ব্যয়িত হইয়াছে, বরণডালা আমাদের সাজাইব কি করিয়া; দানবের বিকট আস্ফালনে বধিরপ্রায় শ্রবণে মায়ের ললিত রাগিণীর দীর্ঘ উচ্ছাস যে আর পশিতে পায় না, ভেদজ্ঞানের কঠোর ব্যবধানে আজ আর বাহিরের কোলাকুলি ভিতরে মিশিতে চায় না— আমরা আজ কি? আজ আমাদের স্থান কোথায়?
সংযোগ ও বিয়োগের সফল দ্বন্দ্ব নিরসন করিয়া বরাভয়করা মা আমাদের চিরাধিকৃত তোমার চরণে স্থান দাও; তোমার জলন্ত ত্রিনয়নের প্রভাবময়ী দৃষ্টি আততায়ী সমস্ত অত্যাচারে দারুণ পরাভব আঁকিয়া দিয়া আমাদিগকে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করুক, কর্ম্মে ও জ্ঞানে আমরা আবার সেই স্বাতন্ত্র্য প্রাপ্ত হই— যাহা আমাদের নিজস্ব, যাহা জগতের শত উদ্ধত স্বর্ণমুকুট অপেক্ষাও গরীয়ান্ বজ্র নির্ঘোষে আবার একবার শুনাও মা সেই দৈত্য নিপীড়িত ধরণীর অভয়োদ্ধার বাণী—
ইন্মং যদা যদা বাধা দান বোত্থা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবতীর্য্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্।।
—পূর্ণকাল; পূর্ণব্রহ্মময়ী মা আমাদের আসিবে না কি?
— ছবিটি পাতিপুকুর আদি সার্বজনীন
দুর্গাপুজো কমিটি, উত্তর ২৪ পরগনার মাতৃমূর্তি

Latest article