জাঁকজমকে দুর্গোৎসব

আজ সপ্তমী। দুর্গোৎসবের দ্বিতীয় দিন। পুজোর রীতি আর উপচারে মিশে থাকা পুরাণ ইতিহাস আর লোকসংস্কৃতির বিশ্লেষণ আজকের প্রসৃতিতে। উৎসবের আঙ্গিক ফিরে দেখার আয়োজন জাগোবাংলার পাতায়। লেখাটির প্রথম প্রকাশ ১৩২২ বঙ্গাব্দে (ইং ১৯১৫ খ্রি:) ‍‘ নারায়ণ’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায়। ওই পত্রিকার সম্পাদক তখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। প্রবন্ধটির লেখক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়

Must read

বোধন কতকটা গোপনে, বিল্ববৃক্ষমূলে করিতে হয়; সপ্তমী হইতে নবমীপূজাটা বেজায় জাঁকের, প্রকাশ্যভাবে করিতে হয়। নানা বাদ্যভাণ্ডসহ পূজা করিতে হয়, পরন্তু বংশীরবসহ মায়ের পূজা করিতে নাই, রস বিপর্যয় ঘটে। যাঁহারা ভাল গৃহস্থ, যাঁহারা তন্ত্রের নির্দেশ মানিয়া দুর্গোৎসব করিয়া থাকেন, তাঁহারা তুরী ভেরীশঙ্খনাদ-সহ, কাড়া নাগড়া, ঢাকঢোল সহ পূজা করিবেন। কিন্তু কখনই পূজাগৃহে বংশীরব করিতে দিবেন না। মা আমার ষোড়শী ভুবনেশ্বরী, তিনি জগৎ প্রসূতি। জগৎপ্রসবিত্রী। তাঁহার সম্মুখে বংশীরব করিলে রসবিপর্যয় ঘটিবার সম্ভাবনা, তাই দুর্গোৎসবে বংশীরব নিষিদ্ধ। বিশেষতঃ দুর্গোৎসব সাময়িক পূজা রণচণ্ডীর পূজা— এ পূজায় সময় সময়োপযোগী বাদ্যভাণ্ড ব্যবহার করিতে হয়। দুর্গোৎসবের প্রথম ও প্রধান অঙ্গ স্নান; প্রথমে নবপত্রিকার স্নান, তাহার পর দেবীর স্নান। তাহাকে মহাস্নান বলে। সে স্নান তিন প্রস্থে তিনভাবে করিতে হয়। প্রথমে সর্বতীর্থের জলে স্নান করাইতে হয়— ‍‘আত্রেয়ী ভারতী গঙ্গা যমুনা চ সরস্বতী সরযুগত্তকী পুণ্যা শ্বেত গঙ্গা চ কৌশিকী। ভোগবতী চ পাতালে স্বর্গে মন্দাকিনী তথা সর্বাঃ যমুনসো ভূত্বা ভুঙ্গারৈ স্নাপয়ত্ত্ব তাঃ।’

আরও পড়ুন-উৎসবের জনজোয়ারে বাংলা, ষষ্ঠীতেই মণ্ডপে রেকর্ড ভিড়

এইভাবে মন্ত্র পড়িয়া ভারতবর্ষের যত নদ-নদী, হ্রদ, সাগর, তড়াগ, পর্বত, সর্বতীর্থের নাম করিয়া তৃঙ্গারে তাহাদের আবাহন করিতে হয়। তাহার পর বৃষ্টির জল, শিশির সঞ্চিত জল, উষ্ণ প্রস্রবণের জল, গঙ্গোদক, শঙ্খোদর, গঙ্গোদক এবং শুদ্ধ জলে দেবীর স্নান করাইতে হয়। স্নানের সময়ে ‘ওঁ অপো হিষ্ঠা’ মূলক বৈদিক মন্ত্র পাঠ করিতে হয়, ‘ওঁ অগ্নিমীলে পুরোহিতং’ মন্ত্রের ও আবৃত্তি করিতে হয়। শেষে সাগর জলে আসন শোধন করিয়া লইতে হয়। আজকাল আর মহাস্নানের ঠিকমত ব্যবস্থা হয় না, পুরোহিত মহাশয় প্রায়ই অনুকল্পে কাজ সারিয়া লন। পঞ্চ গব্যে বোধনটাও করিয়া হয় না। তাহার পর পঞ্চ শস্যের জলে, রজতের জলে, স্বর্ণোদকে, মুক্তার জলে, নারিকেল জলে, সবৌষধি ও মহৌষধির জলে, চন্দন জলে স্নান করাইতে হয়। পুরাণে দুর্গোৎসবের যে পদ্ধতির নির্দেশ আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে প্রচলিত হইয়াছে; দুর্গোৎসব কলিযুগে অশ্বমেধের অনুকল্পস্বরূপ। সুতরাং রাজা মহারাজা, ধনকুবের ছাড়া আর কেহ ঠিকমত দুর্গোৎসব করিতে পারে না। তবে তন্ত্রোক্ত শক্তির আরাধনা সাধক মাত্রেরই আয়ত্তের মধ্যে আছে। স্নানের পূর্বে গজদ্দন্ত মৃত্তিকায়, বরাহদন্ত মৃত্তিকায়, বৃষশৃঙ্গ মৃত্তিকায়, বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকায়, সাগরতল মৃত্তিকায়, গঙ্গার দুই কুলের মৃত্তিকায় দেবীপীঠ বা ঘটকে পবিত্র করিয়া লইতে হয়। যেদেশে স্বচ্ছন্দে বন্য বরাহ, মত্ত মাতঙ্গ, বন্য বৃষ বিচরণ করে না, যে দেশে অজগরের গর্তের মাটি পাওয়া যায় না, সে দেশে এই সকল শুদ্ধি মৃত্তিকা সংগ্রহ করাই কঠিন। অনন্তর অষ্টকলস জলে মহাস্নান শেষ করিতে হইবে; যে অষ্ট কলসে গঙ্গার জল, বৃষ্টির জল, সরস্বতী সলিল, সাগর জল, পদ্মরেণু সন্বিত জল, নির্ঝরজল, সর্বতীর্থ জল ও চন্দন জল-এই অষ্ট প্রকারের জলপূর্ণ থাকিবে। নবপত্রিকার এবং দেবীর যন্ত্রের স্নান ত করাইবেই, যে সাধক মায়ের বোধন করিয়াছেন, তাঁহার দেহঘটে ও বাহিরের ঘটে মাতৃশক্তির বিকাশ হইয়াছে, এই বিবেচনায় তাহাকেও স্নান করাইতে হইবে।

আরও পড়ুন-দীর্ঘ বৈঠক, রাজ্যের প্রস্তাব অনড় ডাক্তাররা

পূর্ণাঙ্গে তিন বার স্নান ও শুদ্ধি হইলে তবে মায়ের সপ্তমী হইতে নবমী পর্যন্ত পূজা চলিবে। স্নানের পর গন্ধানুলেপ-সেও এক অপূর্ব ব্যাপার। চন্দন, কুঙ্কুম, কস্তুরি প্রসাধন কলায় যাহা যাহা গন্ধদ্রব্য বলিয়া পরিচিত, সে সবই একটু একটু করিয়া ব্যবহার করিতে হয়। বাহিরে এইভাবে স্নান করাইয়া, সঙ্গে সঙ্গে মানস পূজায় মনে মনে সেই স্নানের অভিনয়টি করিতে হইবে। ভাবিতে হইবে মেয়েটি আমার চণ্ডীমণ্ডপের সম্মুখে আসিয়া বসিয়াছে, আমি স্বয়ং তাহার গাত্রমার্জন করিয়া, তৈলাদি লেপন করিয়া, তাহাকে স্নান করাইতেছি। পুরাণে যে ক্রম লেখা আছে, ঠিক সেই ক্রম অনুসারে তাঁহার স্নান করাইতে হইবে। চঞ্চলা চপলা মেয়ে মাঝে মাঝে পিঁড়ি হইতে উঠিয়া পলাইতে চাহিবে, তুমি তাহাকে ধরিয়া আদর করিয়া যেন বসাইবে, তোমার আদর যত্ন শুনিয়া মা হাসিতে হাসিতে আবার আসিয়া বসিবেন, তুমি মহাস্নান কার্য্য নিরাপদে শেষ করিবে। তাহার পর মেয়েটিকে কাপড় পরাইয়া দিবে, গন্ধদ্রব্যের দ্বারা তাঁহার দেহের অঙ্গরাগ বর্ধিত করিবে, শেষে নানা মণিমুক্তার মহামূল্যবান্ অলঙ্কার পরাইয়া মেয়েটিকে রাজরাজেশ্বরীরূপে সাজাইয়া বেদীর উপর বসাইবে। বেদীর উপর বসাইবার সময়ে মনে হইবে, তোমার সদ্যজাতা কন্যা উমা সিংহবাহিনী প্রতিমার সঙ্গে যেন এক হইয়া গেলেন। ইহাই মানস পূজার প্রাণ প্রতিষ্ঠা। এইটুকু না হইলে চণ্ডীমণ্ডপে দেবভাবপূর্ণ হয় না।
স্নানের পর ভূতশুদ্ধি এবং ভূতাপসরণ মন্ত্র পাঠ করিয়া সকল দিক্ পবিত্র ও সকল বাধাবিঘ্ন দূর করিয়া লইতে হয়। তাহার পর মাকে কিসের জন্য ডাকিতেছি, তাহা মন খুলিয়া বলিতে হয়।
আবাহয়ামি দেবি ত্বাং মৃন্ময়ে শ্রীফলেহপি চ।
কৈলাসশিখরাদ্দেবি বিন্ধ্যাদ্রেহিমপর্বতা?।
অগত্য বিল্বশাখায়াং চণ্ডিকে কুরু সন্নিধিম্।।’

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

এইভাবে নবপত্রিকার পূজা, ঘটে ও মন্ত্রে মায়ের বোধন শেষে, মহিষাসুরাদি প্রতিমাস্থ দেবতার সামান্য অর্চনা করিতে হয়। তাহার পর বাসুদেব, নীলকণ্ঠ, দশাবতার, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, চতুর্বেদ প্রভৃতি সকল দেব-দেবীর রীতিমত অর্চনা করিতে হয়। শেষে অস্ত্রসকলের পূজা করিতে হয়। প্রতিমার দশ হস্তে যে সকল অস্ত্র থাকে, সে সকলের পূজা করিতে হয়। পূজা অর্চনা পরিসমাপ্ত করিলে হোম করিতে হয়, যন্ত্র অঙ্কিত করিয়া হোম করিতে হয়। এই হোমে বৈদিক এবং তান্ত্রিক দুই প্রকারের মন্ত্র এবং পদ্ধতি নির্দিষ্ট আছে। নিয়মিত আদ্যাশক্তির বৈদিক হোম করিতে হইলে বহু অর্থ ব্যয় করিতে হয়। এখন ব্যাপার তেমন জোগাড় হয় না, পুরোহিতগণ সে হোম ঠিকমত করিতে পারেন না। তাই হোম অনুকল্পে সাধিত হয়। অথচ হোমই হইল আসল পূজা। স্নান, অভিষেক, পূজা— এসকলই বহিরঙ্গ, ভাবপুষ্টির এবং ভাবেন্মেষের একটা উপায় মাত্র; হোমই হইল যজ্ঞ, হোমই হইল কর্ম। বাহ্যিক হোম করিয়া মানস হোম করিতে হয়; মানসহোমের বর্ণনা তন্ত্রে সবিস্তার লিখিত আছে। প্রবাদ আছে, নাটোরের রাজা রামকৃষ্ণ এবং কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র জীবনের মধ্যে চারি পাঁচ বার পূর্ণাঙ্গে দুর্গোৎসবের হোম করিতে পারিয়াছিলেন। এখন বুঝা গেল যে, দুর্গোৎসবের তিনটি প্রধান অঙ্গ— প্রথম বিশ্বমূলে বোধন, দ্বিতীয় বিল্বশাখা ও কদলীবৃক্ষ-সহ দেহস্থ কুণ্ডলিনীর অনুকল্পে কুণ্ডলিনীর প্রতিষ্ঠা, তৃতীয় হোম। এই তিন অঙ্গ বাহ্যিক ভাবে ফুটাইতে হইবে, আবার মানস ক্ষেত্রে ভাবের বিকাশ করিয়া মনে মনে তাহার অনুবৃত্তি করিতে হইবে। ইহাই ভদ্রকালীর আরাধনা; বাকী যাহা কিছু তাহা উৎসবের অঙ্গ। এইভাবে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পূজা করিতে হয়, মহাষ্টমী ও মহানবমীতে মন্ত্রের বচনের একটু পার্থক্য আছে, তাহার জন্য মূল পূজা পদ্ধতির কোনও ব্যতিক্রম ঘটে না। সন্ধিপূজায় একটু মজা আছে। বোধনের পর জাগরিতা কুণ্ডলিনীর উপচয় ঘটে, মা জাগিয়া উঠিয়া হৃদয় জুড়িয়া এবং দালান জুড়িয়া বসিয়া থাকেন, সন্ধিপূজার সময় হইতে সে বিকশিত শক্তির অপচয় আরম্ভ হয়। সন্ধিপূজার পর হইতে বিজয়ার সূত্রপাত হয়। তাই সন্ধিপূজা মজার পূজা, উহা বাহ্যিকও বটে, মানসও বটে। বাহিরে যেমন একশত আটটা দীপ জ্বালিয়া পূজা ও আরতি করিতে হয়, চিন্ময়ী দেবীকে তেমনি ষড়রিপু, একাদশ আসক্তি, চতুঃষষ্টি রস এবং সাতাইশটা ভাব জ্বালিয়া হৃদয় মন্দিরকে সাজাইতে হয় এবং গমনোদ্যতা দেবীকে পূজা অর্চনা এবং আরতি করিতে হয়। বিজয়ার কথাটা এখন বলিতে নাই বলিয়া বলিব না; দুর্গোৎসবে যেমন বাহ্যিক ধূমধাম আছে, তেমনই প্রগাঢ় আধ্যাত্মিকতা আছে, আর পুরাণের হিসাবে ভাব ও রস আছে। দুর্গোৎসবের সঙ্গে বাঙ্গালীত্ব-বাঙ্গালার মানুষের বিশিষ্টতা যেন জড়ান মাখান আছে।
(সম্পাদিত ও সংক্ষেপিত)
— ছবিটি বেলেঘাটা ৩৩ পল্লীর মাতৃ মূর্তি

Latest article