তিনটি বিতর্কিত কৃষি বিল প্রত্যাহৃত। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু ভুলস্বীকার করেননি। তাই ভবিষ্যতে এর চেয়েও খারাপ আইন প্রণীত হওয়ার ভয়টা থেকেই যাচ্ছে। লিখছেন অর্থনীতিবিদ দেবনারায়ণ সরকার
বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকে আন্তেনিও বসানিয়োকে বলেছিল, শয়তান আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মগ্রন্থের বাণী উচ্চারণ করতে পারে (The devil can cite scripture for his purpose)।
প্রসঙ্গটা এখানে উত্থাপনের প্রয়োজন হল এই কারণে যে, ২০২০-র ২৭ সেপ্টেম্বর বিতর্কিত তিনটি কৃষি বিল আইনে পরিণত হওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে কৃষকদের বিক্ষোভ-আন্দোলন চলল। আর তারও পর নভেম্বর ১৯, ২০২১-এ সকাল ন’টায় জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে দেশের প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘‘দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে সৎ মন ও পবিত্র হৃদয়ে বলতে চাই যে, হয়তো আমার তপস্যায় কোনও খামতি রয়ে গিয়েছিল, যে কারণে প্রদীপের আলোর মতো সত্য কিছু কৃষক ভাইকে বোঝাতে পারিনি।… তাই আমরা কৃষি আইন বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
আরও পড়ুন-Tripura Municipal Election: ঠেলার নাম বাবাজি, তৃণমূল কংগ্রেসের চাপে কাল বুথে মোতায়েন আধাসেনা
এই বক্তব্যে বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা করা হল, এজন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমাও চাওয়া হল, কিন্তু কোথাও প্রধানমন্ত্রী বললেন না যে তিনি ভূল করেছিলেন। অর্থাৎ ভুল স্বীকার তো তিনি করেননি, বরং কৃষক-বিরোধী আইনগুলোকে প্রদীপের আলোর মতো সত্য বলে বর্ণনা করেছেন। ক্ষমা চাইছেন এজন্য যে তিনি কৃষকদের বোঝাতে পারেননি।
আসলে উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের মতো রাজ্যগুলিতে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। সেখানে তাঁর দলের জয় সম্পর্কে অশনিসংকেত পেয়ে শুধুমাত্র ড্যামেজ কন্ট্রোল করার জন্য তিনি কার্যত সাময়িকভাবে কৃষি আইন বাতিলের পথে হাঁটলেন। শয়তান যেমন স্বার্থোদ্ধারের জন্য ধর্মের বুলি আওড়ায়, ঠিক তেমনই প্রধানমন্ত্রীও স্বার্থ পুনরুদ্ধারের প্রণোদনায় ভুল স্বীকার না করেও ক্ষমা চাওয়ার পথে হেঁটেছেন।
আরও পড়ুন-বাংলার কৃষকদের ফের বঞ্চনা
আর ভয়টা এখানেই। উল্লিখিত বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে এবং পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে আবার জিতে আসতে পারলে এই প্রধানমন্ত্রী যে স্বৈরাচারী-তৎপরতায় আরও বেশি কৃষক-বিরোধী কৃষি আইন বলবৎ করার চেষ্টা করবেন, সে-ইঙ্গিত কিন্তু স্পষ্ট।
গত বছর ডিসেম্বরে এক কৃষি মহাসম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘ আমরা যে কাজ করেছি (বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন প্রণয়ন) তা ২৫-৩০ বছর আগে করা উচিত ছিল। এই কৃষি সংস্কার রাতারাতি হয়নি। এ-দেশের প্রতিটি সরকার গত ২০-২২ বছর ধরে রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে এ-ব্যাপারে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চালিয়েছে।’’
আরও পড়ুন-Panchayat Election: পঞ্চায়েত ভোটে দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলের দিকে সমর্থনের ঢল
এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে গত দুই-আড়াই দশক ধরে বিভিন্ন রঙের কেন্দ্রীয় সরকার ধাপে ধাপে কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের চেষ্টা চলিয়েছে। সারের উপর ভর্তুকি হ্রাস তেমনই একটি পদক্ষেপ। স্বাধীনতার সাত দশক পরেও দেশের ৭০ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ব্যাঙ্কের ঋণের আওতার বাইরে থেকে গিয়েছেন। ফলে, বাধ্য হয়ে তাঁরা মহাজনের কাছ থেকে অতি-উচ্চ সুদে ঋণ নেন। ৯০-এর দশক থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় তিন লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে।
৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ একটু একটু করে কমেছে। কৃষি ফসল আমদানির ওপর বাধানিষেধ খানিকটা হলেও তুলে নেওয়া হয়েছে। ভোজ্য তেলের অর্ধেক এখন বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বীজের বাজার থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে ক্রমশ হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ২০২০-তে মোদি সরকারের বিদ্যুৎ বিলের সৌজন্যে কৃষিতে ভর্তুকি লোপ পেয়েছে। সঙ্কুচিত হয়েছে গণবণ্টন-ব্যবস্থা। এগুলো চলছিলই, কিন্তু মোদি সরকার যেটা করল সেটা হল বৃহৎ উল্লম্ফনের মাধ্যমে রাতারাতি ব্যাপক ভোলবদল।
আরও পড়ুন-দমদম বিমানবন্দরের রানওয়েতে কুকুর, নামার মুখে ফের আকাশে উঠল ব্রাত্য, কুণাল, সায়নীদের বিমান
গত ফেব্রুয়ারিতেই এই প্রধানমন্ত্রী সজোরে ঘোষণা করেছিলেন, কর্পোরেটরাজই দেশের অর্থনীতি ও শিল্পক্ষেত্র শাসন করবে, সরকার নয়। মোদির তাঁবেদার দুই গুজরাতি পুঁজিপতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত কৃষকদের সমালোচনা সহ্য করতে না পেরেই তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে অন্যত্র এই প্রধানমন্ত্রীই বলেছিলেন, তাঁদের আনা কৃষি বিল মার্কিন বিনিয়োগকারীদের কাছে, বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কাছে, প্রচুর মুনাফা অর্জনের দরজা খুলে দিয়েছে।
‘ভারত এবার প্রকৃতই আত্ননির্ভর হয়ে উঠবে’।
এ-জন্যই পুঁজিপুতিরা উদ্বাহু হয়ে বাতিল তিনটি কৃষি আইন সমর্থন করেছিল। কৃষকদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল নন বলেই প্রধানমন্ত্রী লখিমপুরে কৃষক হত্যাকারীর পিতার সঙ্গে একই মঞ্চে বসতে দ্বিধা করেন না। আন্দোলনকারী কৃষকদের প্রতি তিনি অসংবেদনশীল বলেই তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার কিংবা নিহত প্রায় ৭০০ কৃষকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দানের প্রশ্নে তিনি নিশ্চুপ।
আরও পড়ুন-বন্ধু পেইনের পাশে থাকবেন না বেইলি
‘পেরিক্লিস, প্রিন্স অব টায়ার’ নাটকে শেক্সপিয়র লিখেছিলেন, ‘‘It is time to fear when tyrants seem to kiss.’’
অত্যাচারী যখন চুম্বন করতে চায়, সেটাই ভয়ের সময়।
এহেন প্রধানমন্ত্রী যখন ক্ষমা চাওয়ার নাটক করেন, তখন সেজন্যই ভয় লাগে।
বুঝতে পারি, ফের ক্ষমতাসীন হলে আরও স্বৈরাচারী আইন তৈরির পথে হাঁটবেন তিনি।