বিজয়া

আজ বিজয়া দশমী। দুর্গোৎসবের অন্তিম দিবস। আলিঙ্গন আর আনন্দ যাপনে উদ্বেলিত হওয়ার তিথি। এই দিনটাকে কীভাবে দেখত সেদিনের বাঙালি বিদ্বজ্জন? উঠে এল জাগোবাংলার পাতায়। প্রবন্ধটির প্রথম প্রকাশ ১৩২৫ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যার 'নারায়ণ' পত্রিকায়। লেখক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

Must read

আজ বিজয়া, প্রতিমা দালান হইতে উঠানে নামিয়াছেন। আজ আর পুরোহিত নাই; বাজে লোক নাই; শুদ্ধ বাড়ীর মেয়েছেলে ও নিতান্ত আত্মীয়স্বজনের মেয়েছেলে। পুরুষেরা উঠান ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। গিন্নী নূতন কাপড় পরিয়া বরণডালা মাথায়, উপস্থিত হইলেন; সঙ্গে মেয়ে, বৌ, বাড়ীর আর আর মেয়েছেলে। সকলে আসিয়া মাকে নমস্কার করিলেন। অধিবাসের যত জিনিস ছিল, গিন্নী সকলগুলিই এক এক করিয়া মায়ের মাথায় ছোঁয়াইয়া বরণডালায় রাখিতেছেন; এক একবার ছোঁয়াইতেছেন আর তাঁহার চোখ ফাটিয়া জল পড়িতেছে। ক্রমে সব মেয়েদেরই চোখে জল আসিল। পুরুষেরাও আর থাকিতে পারিলেন না, কাঁদিয়া ফেলিলেন। অন্য সময় এ দুর্বলতাটুকু যাঁহারা দেখাইতে চান না, এখন তাঁহাদের সে ভাব রহিল না। কারণ, এ শোকে লজ্জা নাই। বরণ আরম্ভ হইল। বিশ-ত্রিশজন স্ত্রীলোক মহামায়াকে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলেন, একবার, দুইবার, তিনবার, ক্রমে সাতবার প্রদক্ষিণ হইল। তাহার পর সকলে গলায় বস্ত্র দিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া নমস্কার করিলেন। পরে কর্তা এক পূর্ণপাত্র আনিয়া প্রতিমার সম্মুখ হইতে— গৃহিণী প্রতিমার পিছনে দাঁড়াইয়াছিলেন— তাঁহার অঞ্চলে ঢালিয়া দিলেন। গৃহিণী এই ‘কনকাঞ্জলি’ লইয়া সংবৎসর মায়ের শোক নিবারণ করিবেন।

আরও পড়ুন-সুবর্ণজয়ন্তীর প্রস্তুতি শুরু এখনই, চিত্তরঞ্জন পার্ক মেলা গ্রাউন্ডের দুর্গোৎসব

এইসব তো হইয়া গেল। তাহার পর কিছু মিষ্টান্ন আসিল। গৃহিণী একটি মিষ্টান্ন লইয়া মায়ের মুখে দিলেন আর একটি মায়ের হাতে দিলেন। এইরূপে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, গণেশ সকলকেই মিষ্টান্ন খাওয়ান হইল ও পথের সম্বলস্বরূপ কিছু হাতেও দেওয়া হইল। ইহার পর বিসর্জনের বাজনা বাজিয়া উঠিল।
এই দুর্গোৎসবের ব্যাপারটা কি? হৈমবতী বিবাহের পর মহাদেবের সঙ্গে কৈলাস চলিয়া গিয়াছেন। মেনকা ক্রমাগত গিরিরাজকে মেয়ে আনিবার জন্য জিদ করিতেছেন। শেষে, গিরিরাজ কৈলাসে লোক পাঠাইলেন, অনেক কষ্টে মহাদেব পার্বতীকে তিন দিনের জন্য ছাড়িয়া দিবেন, স্বীকার করিলেন। যে তিন দিন হৈমবতী গিরিরাজের বাড়ীতে ছিলেন, সেই তিন দিন গিরিরাজপুরে মহামহোৎসব হইল। তাহার পর দশমীর দিন হৈমবতী পুনরায় কৈলাসে গেলেন। এখন বুঝিলেন, দুর্গোৎসবের ব্যাপারটি মেয়ে আনা ও মেয়ে-বিদায়ের ব্যাপার। কর্তা স্বয়ং গিরিরাজ, গৃহিণী স্বয়ং মেনকা, আর মহামায়া তাঁহাদের কন্যা। মেয়ে-বিদায়ের ব্যাপার যে দেখিয়াছে, যে ভুগিয়াছে, সেই ‘বিজয়া’র অর্থ গ্রহণ করিতে পারে। ভক্তরা বলেন, বিজয়ার সময় মহামায়ারও চোখের কোণে জল দেখা যায়। ভালবাসা তো শুধু বাপ-মায়ের নয়, মেয়েরও ত ভালোবাসা আছে। যখন বাড়ীশুদ্ধ সকলেই কাঁদিয়া আকুল, মহামায়া কি তা দেখিয়া চুপ করিয়া থাকিতে পারেন? তাঁহার চোখ ফাটিয়া জল বাহির হয়।

আরও পড়ুন-বিজয়ার পরও নবমীনিশির মায়াবী সুর মণ্ডপগুলিতে

নদীতে হউক, পুষ্করিণীতে হউক, হ্রদে হউক, বিলে হউক, মা-এর বিসর্জন হইয়া গেল। জগৎকারণ যে মাটি, সেই মাটি হইতেই মহামায়ার মূর্তি গড়া হইয়াছিল, মাটিরই সাজ-সজ্জায় তাঁহাকে সাজান হইয়াছিল। যিনিই মাটি সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তিনিই মাটির মূর্তিতে আসিয়া অধিষ্ঠান করিয়াছিলেন, তাহাকে সজীব করিয়াছিলেন, তাহাকে ‘পরাশক্তি’ করিয়াছিলেন, তাহাকে সকলের চেয়ে বড় করিয়াছিলেন— এখন তিনি আর নাই— যে মাটি সে আবার মাটিই হইয়া গেল, জলে মিশিয়া গেল। যত লোক দেখিতে আসিয়াছিল, এ-ব্যাপার সকলেই স্বচক্ষে দেখিল। শোকে, ক্ষোভে, দুঃখে আপন আপন ঘরে ফিরিল। যাহার দালানে দুর্গা আসিয়াছিলেন, তাহার কথা তো দূরে হউক, দেশশুদ্ধ লোক দেখিতে লাগিল— সব শূন্য! সবাই শূন্য মনে বাড়ি ফিরিল। তাহারা এতক্ষণ যে এক অমানুষ শক্তির সম্মুখে দাঁড়াইয়া আপনাদিগকে কৃতার্থ মনে করিতেছিল, সে শক্তির আজ অন্তর্ধান হইয়াছে; তাই তাহাদের আবার আত্মীয়স্বজন মনে পড়িয়াছে— মনে পড়িয়াছে এ শক্তি ক্ষণকাল আমাদের নিকটে আসিলেও আমরা এ শক্তি হইতে ভিন্ন, এ শক্তির অনেক নীচে, এখন আমাদের যাহা আছে, যাহা লইয়া আমাদের ঘর করিতে হইবে, যাহা লইয়া আমাদের চিরদিন থাকিতে হইবে, তাহাদের সম্মান, সম্ভাষণ, পূজা করাই আমাদের আবশ্যক। তাই ছেলে আসিয়া বাপের পায়ে গড়াইয়া পড়িল, বাপ তাকে কোলে লইয়া গাঢ় আলিঙ্গন করিলেন, তাহার মস্তকের ঘ্রাণ লইতে লাগিলেন। ছোট ভাই বড় ভাইয়ের পায়ে লুটাইয়া পড়িল, বড় ভাই তাঁহাকে কোল দিলেন। যাহার সহিত যেরূপ সম্পর্ক, সকলেই পরস্পর সম্মান ও সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন। যিনি সকল সম্পর্কের অতীত, তিনি যতদিন উপস্থিত ছিলেন, ততদিন এ সকল পার্থিব সম্পর্ক তাহারা ভুলিয়া গিয়াছিল। এখন আবার সে সম্পর্ক জাগিয়া নূতন হইয়া উঠিল। গৃহিণী শূন্য দালানে আসিয়া সব শূন্যময় দেখিলেন, তিনি একেবারে বসিয়া পড়িলেন, কাঁদিয়া তো আকুল। কর্ত্তারও অবস্থা তাই। তবে তিনি পুরুষ, তিনি গৃহিণীকে প্রবোধ দিলেন। বলিলেন, “ভয় কি? মা আবার এক বৎসর পরে আসিবেন।” সেই আশায় বুক বাঁধিয়া, সকলে আবার সংসার-ধর্মে মন দিল।

Latest article