শত অপপ্রচারেও অদমিত বাংলার উৎসবপ্রাণতা

দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে বিরাম ছিল না মিথ্যে প্রচারের, বিভ্রান্তিকর ফেক নিউজ ছড়ানোয়। তবু বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসবেই ছিল বাংলার মানুষ। আপন অনুভবের কথা, জনমানসের অন্তস্তল থেকে জাগ্রত সত্যটি তুলে ধরছেন রাজ্যের মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী

Must read

কমিউনিস্টরা ধর্মবিরোধী। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সাম্যবাদ গড়ে তোলা ছিল কমিউনিস্টদের লক্ষ্য। মার্কসবাদীরা বুঝেছিল, যারা ক্ষমতাবান তারা সহজে ক্ষমতা ছাড়বে না, ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে। এর জন্য অস্ত্র হাতে জনগণকে বিপ্লবে শামিল করা প্রয়োজন। কিন্তু সে-যুগে বাধা হয়ে দাঁড়াল ধর্ম। কারণ পৃথিবীতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠার আগে ধর্মকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছে। ধর্ম থেকে মানুষ জীবন ধারণের মানসিক চালিকা শক্তি পেয়েছে। কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, ধর্ম দিয়েছে তার নির্দেশিকা। এখন প্রতিটি ধর্মেরই মূল কথা, “পরকালে শান্তি পেতে হলে ইহকালে ত্যাগ করতে হবে’’। কার্ল মার্কস বুঝেছিলেন, সাধারণ মানুষকে “পরকালে শান্তির মোহ’’ থেকে সরাতে না পারলে তারা কখন‌ওই ইহকালের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য অস্ত্র হাতে বিপ্লবে শামিল হবে না। তাই তিনি বললেন, জীবন একটাই। যা কিছু পাওয়ার আছে নিপীড়িত মানুষের জন্য সেটা এই জীবনেই পেতে হবে। তাই বিপ্লবের জন্য সাধারণ মানুষের মন থেকে ধর্মীয় আচ্ছন্নতা কাটাতে হবে। মার্কস বললেন, ধর্ম নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, ধর্ম হৃদয়হীন সমাজের হৃদয়, ধর্ম জনসাধারণের আফিম। এই আফিমের নেশা কাটাতেই রাশিয়ায় মন্দির-মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল কমিউনিস্টরা। তাই এদেশে সিপিএম যারা করে তারা ধর্মবিরোধী। ওরা ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করে না, অঞ্জলি দেয় না, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মানে না। তাই শারদোৎসবের মূল্য ওদের কাছে কোনও কালেই ছিল না। ওরা পুজো প্যান্ডেল-এর পাশে গণশক্তির স্টল করে বই বিক্রি করে। ওরা উৎসবে কোনও কালেই ছিল না। তাই ওদেরই মস্তিষ্ক প্রসূতি ‘উৎসবে ফিরছি না’।

আরও পড়ুন-এসএসকেএমে দুষ্কৃতী তাণ্ডব দ্রুত হস্তক্ষেপ করল পুলিশ

শারদ উৎসব বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। যে-উৎসবের জন্য আপামর বাঙালি সারা বছর নানা ভাবনা, নানা পরিকল্পনা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে, সে তো শারদ উৎসব। মানে বাঙালির দুর্গাপুজো। এক সময় এই দুর্গাপুজো ছিল জমিদার বাড়ির পুজো। পারিবারিক পুজোর আদলে কবে এই দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল তা গবেষকেরা বলতে পারবেন। কিন্তু ১৭৯০ সালে হুগলি জেলার বলাগড় ব্লকের গুপ্তিপাড়ার ১২ জন ব্রাহ্মণ মিলে বারোয়ারি দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। তার পর থেকেই বারোয়ারি পুজো কিংবা সার্বজনীন দুর্গাপুজোর জনপ্রিয়তা ও ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। যত বেশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে দুর্গাপুজোগুলিতে, যত হয়ে ওঠে এই পুজো সাধারণ মানুষের ততই দুর্গাপুজো রূপান্তরিত হয় দুর্গোৎসবে। হয়ে ওঠে বাঙালির উৎসব। যে-উৎসবে আপামর বাঙালি, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে। ধর্ম যার যার, এ-উৎসব হয়ে ওঠে সবার। কালক্রমে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে শারদোৎসব বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের স্থান দখল করে নেয়। চারিদিকে কাশফুল আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় মহালয়ার সকালে দেবী পক্ষের আহ্বান, আজানের সুরে ঘুম ভাঙা যে বাঙালিকে আজও আবেগঘন করে তোলে সেই বাঙালি শারদোৎসবে ফিরবে এটাই তো স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন-ঘাটে ঘাটে কড়া নিরাপত্তা, সতর্ক পুলিশ ও পুরসভা

রেজিস্ট্রিকৃত, সমস্ত সরকারি নিয়মকানুন মেনে পুজো করে এরকম প্রায় বিয়াল্লিশ হাজার পুজো কমিটিকে রাজ্য সরকার এবার ৮৫০০০ টাকা করে সরকারি অনুদান দিয়েছে। এই তথ্য থেকে বোঝা যায় এই বাংলায় গ্রামগঞ্জ, শহর জুড়ে হাজার হাজার বারোয়ারি দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় এবং সেইসব পুজোগুলিকে কেন্দ্র করে বাঙালি মেতে ওঠে উৎসবে। দুর্গাপুজো এখন আর শুধুমাত্র কোনও ধর্মীয় আচার-উপাচার পালনের মাধ্যম কিংবা শুধুমাত্র আনন্দ করার ক্ষেত্র— একথা বলা যায় না। এই শারদোৎসব লক্ষ-কোটি মানুষের রুটি-রোজগারের মাধ্যম বটে। যিনি প্যান্ডেল করেন, যিনি লাইট দেন কিংবা প্রতিমা তৈরি করেন, প্রতিমার সাজসজ্জা তৈরি করেন সারা বছর, পুজো প্যান্ডেলের সামনে খাবারের কিংবা হস্তশিল্পের স্টল দেওয়া লোকটি অপেক্ষা করে সারা বছর দুর্গাপুজোর জন্য। এরকম কতশত মানুষের সারা বছরের রোজগারের মাধ্যম এই শারদোৎসব। গত বছরই প্রায় আশি হাজার কোটি টাকার আর্থিক লেনদেন হয়েছিল এই উৎসবকে কেন্দ্র করে এই রাজ্যে। মা শুধু দুষ্টের দমনই করেন না শিষ্টের পালনও করেন। তাই দেবী দুর্গাকে নিয়ে উৎসবে মেতেছে বাংলার সর্বস্তরের মানুষ।

আরও পড়ুন-বাংলা ও কেন্দ্রের সরকারের পার্থক্যটা একবার দেখুন

‘উৎসবে ফিরছি না’কে মঞ্চের বাইরে থেকে প্রম্ট করে মঞ্চস্থ করতে সাহায্য করছে যে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁরা তো কোনওদিনই এই উৎসবে ছিলেন না। তাঁরা কোনওদিনই উৎসবে ছিলেন না, ধর্মে ছিলেন না, আচার-উপাচার— কোত্থাও ছিলেন না। ফলে ‘উৎসবে ফিরছি না’ এই দাম্ভিক ঘোষণা ওরা তো করবেই।
আরজি করের নারকীয় ঘটনার পর সারা বাংলার মানুষ যেমন দোষীদের চরম শাস্তি চেয়েছে তেমনি বাংলার মানবিক মুখ্যমন্ত্রীও এই ঘটনায় দোষীর চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড‌ও চেয়েছেন। তাঁর উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিল পাশ করানো হয়েছে, যে ধর্ষণ করে খুনিদের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড সুপ্রিম কোর্টের তত্বাবধানে আরজি করের ঘটনার বিচার চলছে। সিবিআইয়ের হাতে তদন্তের ভার। এক্ষেত্রে এই বিচার- প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় নেই, এটা যে কোনও মানুষই বোঝেন। কিন্তু যাঁরা এই ঘটনাকে সামনে রেখে দম্ভের সঙ্গে বলেন, ‘উৎসবে ফিরছি না’ তাঁরা হয় আপামর বাঙালি কী চায় সেটা বোঝেন না কিংবা সব বুঝেও শুধুমাত্র অরাজকতা তৈরি করে বিভ্রান্তির বীজ বাংলার মাটিতে বপন করতে চান। মূলত কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক একটি অংশের মানুষ এই উৎসব- বিরোধিতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতিতে মদত ছাড়াও গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক প্রচার এঁদেরই মস্তিষ্কপ্রসূত।
ছবি: পূর্ব বর্ধমানের রাম গোপালপুরে আঢ্য পরিবারের মাতৃমূর্তি

Latest article