সুইডিশ রসায়নবিদ, ইঞ্জিনিয়ার এবং শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেলের সদিচ্ছায় ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ঘোষিত হয় নোবেল পুরস্কার প্রদানের অঙ্গীকার, এবং ২৯ জুন ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় নোবেল ফাউন্ডেশন এবং পরের বছর ১০ ডিসেম্বর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর পক্ষ থেকে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিদ্যা, ও অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের উপর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে সাহিত্যে এবং নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে শান্তি স্থাপনে কৃতিত্বের জন্য নোবেল সম্মাননা প্রদান করা হয়। এছাড়াও নোবেল অ্যাসেম্বলি অ্যাট দ্য কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট-এর তরফে শারীরবিদ্যা বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। মাইক্রো-আরএনএ আবিষ্কার ও বহুকোষীয় জীবদেহে জিনের অভিব্যক্তি ঘটিয়ে তাদের বেড়ে ওঠা এবং বেঁচে থাকায় মাইক্রো-আরএনএ-র অনবদ্য ভূমিকার কথা স্বীকার করে চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এবছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন-ওরা সহজে রান দেয়নি : হরমন
পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার
গত ৮ অক্টোবর দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর পক্ষ থেকে মানবকল্যাণে অনবদ্য কৃতিত্ব স্থাপনের ক্ষেত্রে পদার্থ বিজ্ঞানে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে বিজ্ঞানী জন জে হপফিল্ড এবং জিওফ্রে ই হিন্টনকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হবে বলে জানিয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের বিল্ডিং ব্লকস্ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিংকে মানবদেহের মস্তিষ্কের স্নায়বিক জাল বিন্যাসের মতোই সমৃদ্ধ করে তুলতে তাঁদের বৈজ্ঞানিক কসরতের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার।
বিজ্ঞানী জিওফ্রে এভারেস্ট হিন্টন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন; বর্তমানে তিনি একজন ব্রিটিশ-কানাডিয়ান কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট, কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট, ও একজন সাইকোলজিস্ট; এছাড়াও তিনি কানাডার টরোন্টো ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক বা কৃত্রিম স্নায়বিক জাল বিন্যাসের উপর তাঁর অনবদ্য গবেষণার জন্য বিজ্ঞানের জগতে তিনি ‘গডফাদার অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ নামে খ্যাত। বিজ্ঞানী জন জোসেফ হপফিল্ড ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই আমেরিকার শিকাগো শহরে জন্মগ্রহণ করেন; তিনি একজন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী এবং বর্তমানে আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি অ্যাসোসিয়েটিভ নিউরাল নেটওয়ার্ক বা সহযোগী স্নায়বিক জাল বিন্যাসের উপর গবেষণা করে রেকারেন্ট নিউরাল নেটওয়ার্ক বা পুনরাবৃত্ত স্নায়বিক জাল বিন্যাসের একটি অ্যাসোসিয়েটিভ মেমরি নেটওয়ার্ক বা সহযোগী স্মৃতি-জালবিন্যাস গঠন করেন, যা হপফিল্ড নেটওয়ার্ক নামে পরিচিত। এই গবেষণায় প্রথম তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতি লাভ করেন।
মানব মস্তিষ্কের মধ্যে রয়েছে অগণিত স্নায়ু সংযোগ-বিন্যাস, যাকে বলা হয় নিউরাল নেটওয়ার্ক। ওই দু’জন বিজ্ঞানী আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে কোনও স্মার্ট যন্ত্রের মধ্যে মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির সহায়তায় মানব মস্তিষ্কের অনুরূপ নিউরাল নেটওয়ার্ক প্রতিস্থাপনের ভিত্তি তৈরি করার স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় একে ডিপ লার্নিং টেকনোলজিও বলা হয়, এইভাবে একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পৃক্ত কম্পিউটার আমাদের ব্রেনের মতো করেই ডেটা প্রসেস করতে সক্ষম হয়। তাঁরা মনে করতেন যন্ত্র কখনও হয়তো মানব মস্তিষ্কের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারবে না; কিন্তু সে ধারণা আজ ভুল প্রমাণিত হচ্ছে বলেই তাঁদের মত। তাঁরা জানিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছরেরও কম সময়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন নিউরাল কানেকশন তৈরি করে ফেলবে, সংখ্যাটি প্রায় হিউম্যান ব্রেনের মধ্যে উপস্থিত নিউরাল নেটওয়ার্কের মতোই!
আরও পড়ুন-ফের পিছোল আনোয়ারের শুনানি, ডার্বির প্রস্তুতি শুরু করল মোহনবাগান
রসায়ন বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার
গত ৯ অক্টোবর দ্য রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর পক্ষ থেকে মানবদেহ তথা পৃথিবীর বুকে জীবন্ত প্রাণ সৃষ্টির চির-রহস্যময়ী প্রোটিনের সম্ভাব্য গঠন এবং নতুন নতুন প্রোটিন তৈরির দিশা দেখানোর জন্য যথাক্রমে বিজ্ঞানী ডেমিস হাসাবিস ও বিজ্ঞানী জন এম জাম্পার এবং বিজ্ঞানী ডেভিড বেকারকে অর্ধেক করে নোবেল পুরস্কার প্রদান করেছে।
স্যার ডেমিস হাসাবিসের জন্ম ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই, তিনি একজন ব্রিটিশ কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষক। তিনি গুগল ডিপমাইন্ড ও আইসো-মরফিক ল্যাবস্ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে জন্ম জন মাইকেল জাম্পার ডিপমাইন্ডের একজন আমেরিকান ডিরেক্টর। তাঁরা দু’জন এবং তাঁদের অন্যান্য সহযোগীরা মিলে ‘আলফা ফোল্ড’ নামে একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মডেল তৈরি করেন; যার সাহায্যে তাঁরা এযাবৎ এই পৃথিবীর বুকে আবিষ্কৃত প্রায় ২০০ মিলিয়ন প্রোটিনের গঠন অনুমান করতে সক্ষম হয়েছেন। মানবদেহ গঠনের অন্যতম রাসায়নিক উপাদান প্রোটিনের জটিল কাঠামো অনুধাবন করার যে প্রচেষ্টা কয়েক দশক ধরে চলছিল, তার একপ্রকার নিরসন হল বলা যায়। একপ্রকার ব্যাকটেরিয়াজাত উৎসেচক আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে, এই প্রযুক্তির সাহায্যে প্রোটিনের গঠন সম্পর্কে ধারণা পেলে এই প্রতিরোধের হাত থেকে রেহাই মিলবে।
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর জন্ম আমেরিকান জৈব রসায়নবিদ এবং কম্পিউটেশনাল জীব বিশারদ ড. ডেভিড বাকের; বর্তমানে তিনি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন এবং হোয়ার্ট হিউগস্ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটে গবেষণায় রত। তিনি নতুন নতুন প্রোটিন তৈরির ক্ষেত্রে অগ্রণী দিশা দেখিয়েছেন, তিনিই প্রথম প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক কাঠামোর ধারণা দেন। তাঁর ল্যাবরেটরি থেকে নতুন প্রোটিন তৈরির মতো প্রায় অসম্ভব কার্যসিদ্ধি হচ্ছে, নতুন ন্যানোমেটিরিয়ালের সঙ্গে সৃষ্ট প্রায় ১২০টি প্রোটিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
পৃথিবীর সৃষ্টির পর থেকেই এই পৃথিবীতে লিভিং অর্গানিজম তৈরির মূল উপাদান নানারকম প্রোটিন নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের নিবিড় কৌতূহল। রাসায়নিক প্রোটিনের সম্ভাব্য গঠন এবং ডেভিড বাকেরের নতুন প্রোটিন তৈরির কৌশল বিজ্ঞানী মহলে তুমুল আলোড়ন তুলেছে। প্রোটিনের গঠন এবং নতুন প্রোটিন তৈরির সম্ভাবনা-বিজ্ঞানের অসম্ভব ধনাত্মক প্রভাব রয়েছে মানবকল্যাণে। এই অভিনব রসায়ন বিদ্যা উন্নততর ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নতুন নতুন ন্যানোমেটিরিয়ালস তৈরি করতে সাহায্য করবে, নতুন নতুন প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন তৈরির জন্য উপযোগী, মিনিমাল সেন্সর এবং উন্নয়নশীল গ্রিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ তৈরির ক্ষেত্রে যথেষ্ট উপকারী। এছাড়াও আরও নানা উপায়ে এই যুগান্তকারী আবিষ্কার জনজীবনকে সমৃদ্ধ করবে।