হস্তিকন্যা

বুনোহাতি (Wild Elephant) ধরতে পুরুষ মাহুতদের টেক্কা দেন অহরহ। বয়স ষাট পেরিয়ে সত্তরের দিকে ছুটছে। এখনও নিয়মিত হাতির সঙ্গে সখ্য তাঁর। ভারতের প্রথম মহিলা মাহুত হিসেবে যুগান্তকারী অবদানের জন্য পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মান। তিনি হস্তিকন্যা পার্বতী বড়ুয়া। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

গৌরীপুরের রাজকন্যা
মেয়ে হয়েও পুতুল খেলায় আগ্রহ ছিল না তাঁর। সেই ছোট্ট থেকেই বনের জীবজন্তু, তাদের জীবনযাত্রার প্রতি অদ্যম আকর্ষণ। জলে-জঙ্গলে ভরা বিপদসঙ্কুল অরণ্যভূমি তাঁকে টানত।
ছোটবেলা থেকেই তাই ওই ভয়ঙ্কর সুন্দর, বিশালাকৃতির প্রতি তাঁর টান। যে টান বা আকর্ষণের অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর বাবাও। হস্তিবিশারদ হিসেবে বাবা তখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। ছোট থেকেই সেই বাবাকে দেখেছিলেন জীবজন্তুদের সঙ্গে বিশেষত হাতির সঙ্গে খেলতে। গদাধর নদীর ধারে বিশাল বাড়িতে থাকতেন প্রকৃতিশচন্দ্র বড়ুয়া বা লালজি। অসমের গৌরীপুর রাজপরিবারের ছেলে এই লালজি। তিনি ছিলেন সেই রাজ পরিবারের সর্বশেষ শাসক। পশুশিকারে গিয়ে বাড়ি নিয়ে আসতেন শাবকদের। সেই লালজির মেয়ে পার্বতী বড়ুয়া। ভারতের প্রথম মহিলা হাতি-মাহুত, গৌরীপুরের রাজকন্যা পার্বতী পরে জনপ্রিয় হন ‘হস্তিকন্যা’ নামে।

আরও পড়ুন-কবে জুড়বে শিয়ালদহ-এসপ্ল্যানেড, বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ, ফের জটিলতা ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রােয়

পিতা-পুত্রীর জুটি
ছোটবেলা থেকেই খেলনা নয়— জীবজন্তুদের সঙ্গে খেলেছেন পার্বতী। স্বর্গত প্রকৃতিশচন্দ্র বড়ুয়ার ন’টি সন্তানের অন্যতম হলেন ভারতের প্রথম মহিলা হাতি-মাহুত পার্বতী বড়ুয়া। বাবার কাছেই যাঁর হাতি চেনার হাতেখড়ি। বাবাই তাঁর প্রথম গুরু। ছোটবেলায় তাঁর খেলার সঙ্গী ছিল বাচ্চা হাতি, বাঘের ছানা, হরিণ শিশু। তাদের দেখেই বড় হয়ে ওঠা। পার্বতী তাঁর হস্তী-বিশারদ বাবার থেকে শিখেছিলেন হাতিকে বশ করার সবরকম কৌশল। হয়ে উঠেছিলেন সুদক্ষ। পার্বতীর বাবা শিকারি লালজির ঝুলিতে তখন ৩৪১টি বাঘ, একশোরও বেশি লেপার্ড। কিন্তু তিনি মিথ হয়ে আছেন হাতি শিকারে। ১০০০-এর বেশি বুনো হাতি পোষ মেনেছে তাঁর হাতে। সেই লালজির প্রশিক্ষণে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন পার্বতী।
কুইন অব দ্য এলিফ্যান্ট
পার্বতী যেমন ভারতের প্রথম মহিলা মাহুত, আবার তেমনই প্রথম ফান্দিও। ফান্দি হল যাঁরা হাতি ধরেন ফাঁদ পেতে। পার্বতী বড়ুয়া গোটা বিশ্বে ফাঁদ দিয়ে হাতি ধরেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম মহিলা-শিকারি। ফাঁদ দিয়ে হাতি ধরা যাকে বলা হয় মেলা শিকার, এই দেশে তিনি ছাড়া মহিলা আর কেউ নেই। ক্লান্তিহীন ভাবে পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি তাঁর জীবন সঁপে দিয়েছেন হাতিদের কাছেই। ওয়াইল্ড লাইফ ফোরামের ‘কুইন অব এলিফ্যান্ট’ নামে পরিচিত এই হস্তিকন্যা পার্বতী বড়ুয়া ২০২৪-এর ৭৫তম প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতের প্রথম মহিলা-মাহুত হিসেবে তাঁর যুগান্তকারী অবদানের জন্য পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মান।

আরও পড়ুন-পূর্ণিমার কোটালের জলোচ্ছ্বাসে ভাসল দিঘার সৈকত

জীবজন্তুরাই খেলার সঙ্গী
১৯৫৩-র ১৪ মার্চ, শিলং-এ তাঁর জন্ম হয়। পরে তিনি গৌরীপুরে আসেন। মাত্র এক মাস সতেরো দিন বয়স তখন। শিলং থেকে গৌরীপুরের বাড়িতে আনা হচ্ছে ছোট্ট পার্বতীকে, পথে দামরায় এসে দাঁড়াল তাঁদের গাড়ি। সেখানে তখন হাতি শিকারের ক্যাম্প চলছে। সেই থেকেই হাতির সঙ্গে সম্পর্কের শুরু, যে সম্পর্ক আজও অটুট। হাতির সঙ্গে বেড়ে ওঠা তাঁর। বাড়ির পিলখানায় তখন থাকত ৪০টির বেশি হাতি। পার্বতীর বাবা শিকারে গিয়ে মৃত বাঘ, লেপার্ড, হরিণ, শজারুর ছোট বাচ্চাদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। একটু বড় করে তাদের পাঠানো হত চিড়িয়াখানায় বা জঙ্গলে। ছোটবেলায় এরাই ছিল পার্বতীর খেলার সঙ্গী। প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিন কুলদেবী মহামায়ার পুজো সেরে শিকারে বেরোতেন লালজি। বাবার সঙ্গী হতেন পার্বতী-সহ অন্যেরা। স্কুল বলতে শুধু পরীক্ষাটুকু দেওয়ার জন্যই ছিল তাঁর যাওয়া, তারপরেই ছুটতেন জঙ্গলে। এই কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে এমএ পড়তে গিয়ে মাঝপথেই ইতি টানেন পড়াশুনোয়। হাতির জন্য নানাধরনের রশি লাগে। কোনওটা পা বাঁধার, কোনওটা গলায় ঝোলানোর— যাকে বলে দুলসি। এই দুলসির ওপর পা রেখে মাহুত সাপোর্ট নেয়। এই সবকিছু পার্বতী করতেন নিজের হাতে। বাবা হাতে ধরে যত্ন করে শিখিয়েছিলেন তাঁকে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রথম হাতি শিকার করেন পার্বতী। কচুগাঁও ফরেস্টে মহাল শুরু হল। সেখানেই প্রথম ফাঁদ পেতে একদল বুনো হাতির মাঝে হাতি ধরেছিলেন পার্বতী। ক্যাম্পে ফেরার পর বাবা চাপড়ে দিয়েছিলেন মেয়ের পিঠ।

আরও পড়ুন-বাম আমলে আরজি করে ডাক্তারি ছাত্র খুনের ঘটনা, সুবর্ণর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন সৌমিত্র বিশ্বাসের মা

সাহসী পার্বতী
ধৈর্য, সাহস, পরিশ্রম, অধ্যবসায়কে পুঁজি করে এগিয়ে গেছেন পার্বতী। লালজির দেওয়া শিক্ষাকে পরমনিষ্ঠায় বহমান রেখেছিলেন। গভীর জঙ্গলে শিকারে গেলে একটানা বেশ কয়েকটা দিন এবং রাত সেখানে থেকে যেতে হত। মেন ক্যাম্প থেকে যেটা অনেকটাই দূরবর্তী। আশ্রয় বলতে শুধু বড় বড় গাছের তলাগুলো। রোদ, জল, ঝড়ের দাপট সহ্য করতে হত এক-এক সময় টানা। রাত নামলে চারদিকে আগুন জ্বেলে অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই আর সঙ্গে অস্ত্র। ‘মিট দা’ হাতি শিকারের এই অস্ত্র নিজের হাতে বানিয়েছিলেন কাঠের খাপে যা গোঁজা থাকে কোমরে। জঙ্গলের একটা আইন আছে, জন্তুরা তা মেনে চলে। বন্দুকের ব্যবহার সেখানে নিষিদ্ধ। দিনের পর দিন পড়ে থাকার সময় নিজের খাবার নিজেকেই বানিয়ে নিতে হয়। এত কষ্টের পর বুনো হাতি ধরা পড়লে তাকে নিয়ে চলে প্রশিক্ষণ পর্ব।
তিনকন্যার জননী
বুনো হাতিদের নিজ হাতে প্রশিক্ষিত করেন পার্বতী। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে পার্বতী আছেন হাতির সঙ্গে। হাতিই তাঁর নিজের সন্তানের মতো। পার্বতীর তিন কন্যা লক্ষ্মীমালা, অলোকা, কাঞ্চনমালা। লক্ষ্মীমালা নামের হাতিটি রয়েছে মানস অভয়ারণ্যে। এই লক্ষ্মীমালাকে তিনি পেয়েছিলেন বক্সার নিমতি ফরেস্টে ১৯৭৫ সালে তখন লক্ষ্মীর বয়স পাঁচবছর। সেই থেকে লক্ষ্মীমালা পার্বতীর কন্যাসমা। ১৯৭৮-এ হাতি ধরা নিষিদ্ধ হয়। এখন সরকারি নির্দেশ ছাড়া মহাল হয় না। শেষবার মহালে অংশ নিয়েছিলেন পার্বতী ১৯৮০-তে উত্তরপ্রদেশের বামনপোখরিতে।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

পেয়েছেন সম্মান
এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাক পড়ে হাতি খেদানো বা মাহুত প্রশিক্ষণের কাজে। নিজের রাজ্য অসম তো আছেই, পশ্চিমবঙ্গেও আসেন মাঝেমাঝেই। বর্তমানে পার্বতীর তত্ত্বাবধানে মোট ৬০০-র বেশি হাতি রয়েছে, যাদের তিনি প্রশিক্ষণ দেন, দেখভাল করেন৷ বছরের পর বছর ধরে কোনও ট্রাঙ্কুলাইজার বন্দুকের ব্যবহার ছাড়াই মেলা শিকারের মতো অনন্য ঐতিহ্যবাহী কৌশল ব্যবহারে হাতি ধরেছেন পার্বতী। ২০০৩ সালে অসম সরকার তাঁর এই কাজের জন্য লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট ‘অনারারি চিফ এলিফ্যান্ট ওয়ার্ডেন অফ অসম’ পুরস্কারে সম্মানিত করে৷ এছাড়াও ১৯৮৯ সালে পার্বতীকে ‘গ্লোবাল ৫০০ রোল অফ ওনার’ অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করে ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগাম৷
ব্রিটিশ লেখক মার্ক শান্ড প্রথমবার বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করান অসমের পার্বতী বড়ুয়ার৷ ১৯৯৫ সালে উত্তরবঙ্গে হাতিদের ক্যাম্পে মার্ক শান্ডের পরিচয় হয়েছিল পার্বতীর৷ তাঁর কাজ দেখে মুগ্ধ হন মার্ক৷ এরপর পার্বতীকে নিয়ে তিনি একটি বই লেখেন, যার নাম ছিল ‘কুইন অফ দ্য এলিফ্যান্টস’৷ সেই থেকে বিশ্বদরবারে পার্বতী বড়ুয়া পরিচিত হন৷

Latest article