সাত এবং আটের দশক। দূরদর্শনের সাদাকালো যুগ। অন্যান্য অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাংলা সংবাদ ছিল দারুণ আকর্ষণীয়, জনপ্রিয়। সেইসময় খবর পড়তেন দেবরাজ রায়। সৌম্যকান্তি চেহারা। গম্ভীর কণ্ঠস্বর। অল্প দিনের মধ্যেই হয়ে উঠেছিলেন অনেকের হার্টথ্রব। তাঁর খবর পড়া শুনতে বহু মানুষ অধীর আগ্রহে বসে থাকতেন। দূরদর্শনের পর্দায় অভিনয়ও করেছেন দেবরাজ। নাটকে এবং ধারাবাহিকে। আসলে অভিনয় ছিল রক্তে। তাঁর বাবা তরুণ রায় ছিলেন নাট্যকার ও পরিচালক। লিখতেন ধনঞ্জয় বৈরাগী ছদ্মনামে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, মহেন্দ্র গুপ্তর সমসাময়িক ছিলেন। উৎপল দত্তের সহপাঠী। দেবরাজের মা ছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রী, দীপান্বিতা রায়। তিনিও অভিনয় করেছেন বহু নাটকে।
বাবার থিয়েটার গোষ্ঠী ‘মুখোশ’-এর সঙ্গে কাঁচা বয়সেই জড়িয়ে পড়েন দেবরাজ। অভিনেতা হিসেবে। বহু মঞ্চ সফল নাটকে তাঁর অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন আবৃত্তি ও শ্রুতি নাটকেও। স্ত্রী অনুরাধা রায়-সহ বহু অভিনেত্রীর সঙ্গে শ্রুতি নাটকে অংশ নিয়েছেন। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার, দীনেন গুপ্ত-সহ বহু বরেণ্য পরিচালকের ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘গণদেবতা’, ‘মর্জিনা আবদাল্লা’ তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি। এ ছাড়াও অসংখ্য বাণিজ্যিক বাংলা ছবিতে থেকে গেছে তাঁর প্রাণবন্ত অভিনয়।
দূরদর্শনের পাশাপাশি আকাশবাণীর সঙ্গেও ছিল তাঁর দীর্ঘ সম্পর্ক। বেশকিছু বেতার নাটকেও তিনি সুনামের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। জন্ম ১৯৫৫-র ৯ ডিসেম্বর। ১৭ অক্টোবর চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। ৭০ ছুঁই-ছুঁই বয়সে। দেবরাজ রায়ের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ বাংলা। শোকবার্তা দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-আজ আইএসএল ডার্বিতে মুখোমুখি মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল
কলকাতা দূরদর্শনে দেবরাজের দীর্ঘদিনের সহকর্মী ছিলেন বাচিক-শিল্পী প্রণতি ঠাকুর। তিনিও শোকে মূহ্যমান। জানালেন, দেবরাজ আমাদের বহুদিনের বন্ধু, সহকর্মী। প্রখ্যাত অভিনেতা, অসাধারণ কণ্ঠস্বরের অধিকারী। স্মৃতি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বহু বহু বছর আগে। দেবরাজকে প্রথম দেখি ওদের ভবানীপুরের বাড়িতে। বাড়ির নাম ছিল থিয়েটার সেন্টার। দেবরাজের বাবা-মা বাড়ির মধ্যেই একটা মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। সেখানে রীতিমতো নাটক হত। ওঁদের নিজেদের প্রোডাকশনের একটি নাটকেই আমি প্রথম দেখি দেবরাজকে। তারপরে দেখা দূরদর্শনের পর্দায়। সাদাকালো টেলিভিশনে। মুগ্ধ করত ব্যারিটোন ভয়েস। ছবিতেও ওর অভিনয় দেখেছি। কাছাকাছি আসা বা বন্ধুত্বের জায়গা তৈরি হয়েছে কবে? প্রণতি জানালেন, যখন আমি দূরদর্শনে সংবাদ বিভাগে জয়েন করি, তখন ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। বহু বহু বছর আগের ঘটনা। তিনি আরও বলেন, দেবরাজের সঙ্গে আমি প্রচুর শ্রুতি নাটকের অভিনয় করেছি। অনুষ্ঠান করতে গেছি বাংলার বিভিন্ন জেলায়। অভিনেতা হিসেবে ছিল অসাধারণ। আমাদের জুটির শেষ অনুষ্ঠান ছিল আসানসোল রবীন্দ্রভবনে। ওর মতো ভদ্র মানুষ সংস্কৃতি জগতে বিরল। ছিল মুখচোরা স্বভাবের। খুব বেশি কথা বলত না। বছর দেড়েক আগে, কলকাতা দূরদর্শনের সংবাদ বিভাগ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমরা যারা খবর পড়তাম, তাদের নিয়ে। সেই অনুষ্ঠানে দেবরাজ এসেছিল। তার আগে থেকেই বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মাঝেমধ্যে মেসেঞ্জারে শুভেচ্ছা জানাত। নববর্ষ, বিজয়া ইত্যাদির শুভেচ্ছা। যে কোনও মানুষের চলে যাওয়াটা কষ্টের। তবে চলে যাওয়াই তো শেষ কথা। আমরা যে কোনও মৃত্যুর কাছে বড় অসহায়। দেবরাজের মতো ভাল মানুষের চলে যাওয়ায় মনটা ভারাক্রান্ত।
আরও পড়ুন-৬০ জন নিরাপত্তা-রক্ষীর ঘেরাটোপে শুটিং মেগাস্টারের
দূরদর্শন-ব্যক্তিত্ব, বাচিক শিল্পী কৃষ্ণপদ দাস ডুব দিলেন স্মৃতিচারণায়। বললেন, ‘একটা সময় দেবরাজদার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতাম। তিনি ছিলেন নায়ক। পরবর্তী সময়ে আকাশবাণী নাটকের আমি দেবরাজদার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছি। শোভনলাল মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়। দূরদর্শনের সাংবাদ বিভাগে কাজ করতে গিয়েও পেয়েছি দেবরাজদার দেখা, স্নেহ। মার্জিত স্বভাব। খুব কম কথা বলতেন। নিজের কাজটুকু করেই চলে যেতেন। জীবনযাপন ছিল আড়ম্বরহীন, খুব সাধারণ। অসাধারণ কণ্ঠস্বরের অধিকারী। যখনই কিছু উচ্চারণ করতেন স্টুডিও গমগম করে উঠত। তবে সংবাদ পরিবেশন করতেন আবেগ-বর্জিত কণ্ঠে।’
দেবরাজ রায়ের অভিনয় দক্ষতা, সংবাদ পাঠ, বাচনিক শিল্পীরূপে আকাশবাণী কলকাতার নাটকে অভিনয় মুগ্ধ করত দূরদর্শন-ব্যক্তিত্ব তথা বাচিকশিল্পী অরুময় বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। স্মৃতিচারণ করলেন তিনি। বললেন, ‘দেবরাজদা ছিলেন নিপাট ভাল মানুষ। সুভদ্র, সুন্দর। দূরদর্শনের পর্দায় সংবাদ পাঠক রূপে যখনই তাঁকে দেখতাম, তাঁর অপূর্ব কণ্ঠস্বর, পরিশীলিত শুদ্ধ উচ্চারণ এবং সংবাদ পাঠের মনন আমাদের বিস্মিত করত।’ তিনি আরও জানান, খুব কম বয়সেই তাঁর সঙ্গে আকাশবাণীর নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছি। যখন দূরদর্শনে কর্মরত অবস্থায় ছিলাম, ক্যান্টিনের ছাদে অথবা চায়ের টেবিলে বহু সময় তাঁর সঙ্গে কাটিয়েছি। আড্ডার ছলে শিখতে চাইতাম কণ্ঠের ব্যবহার, উচ্চারণ মাধুর্য, প্রকাশভঙ্গি। তিনিও এতটাই সৌজন্যশীল ছিলেন যে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে এতটুকু বিচলিত বা শ্রান্ত হতেন না। ওঁর বাবা তরুণ রায় ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগের প্রধান, আমার শিক্ষক। সেই কারণেই হয়তো দেবরাজদা আমাকে একটু বেশিই স্নেহ করতেন। বিভিন্ন সময় বহু মঞ্চে একসঙ্গে অনুষ্ঠান করেছি। স্ত্রী অনুরাধা রায়ের সঙ্গে তিনি দ্বৈতভাবে শ্রুতি নাটক পরিবেশন করতেন।
সবমিলিয়ে দেবরাজ রায় ছিলেন নিপুণ সংবাদ পাঠক, পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। দুই ক্ষেত্রেই পেয়েছিলেন আশ্চর্য সাফল্য। তাঁর চিরবিদায় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সৃষ্টি করল অসীম শূন্যতা। এই ক্ষতি অপূরণীয়।