আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। তারপর থেকে জুনিয়র ডাক্তাররা লাগাতার কর্মবিরতি এবং এখন আমরণ অনশন করছেন। মাঝে দেখা যায়, দ্রোহের কার্নিভাল। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তাররা যতই আন্দোলন করুন না কেন, এখন তাঁদের নানা কার্যকলাপ নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খুলে টাকা তোলার অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
অনেকেই জুনিয়র ডাক্তারদের বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। ফলে, আন্দোলনের সমর্থক হয়েও ডাক্তারবাবুদের একাংশের বক্তব্য, তাঁদের আসল শক্তি রোগীরা। ডাক্তারি করা তাঁদের আবেগ। সুতরাং, সেটাই করা যাক আরও মন দিয়ে। সময় সব কিছু চেনায়।
আরও পড়ুন-৫৫টি ট্রেন দুর্ঘটনা ১২৬ দিনে, গর্জে উঠল তৃণমূল, মোদি ৩.০-র রেল এখন জাতীয় সঙ্কট
আন্দোলনরত ডাক্তারবাবুর দল আর তাঁদের মদত জুগিয়ে নিজেদের টিআরপি বাড়াতে মরিয়া কুমন বাবুরা বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী একবার আসতে পারলেন না?’’
বলি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ধরনামঞ্চে গিয়েছিলেন। জ্যোতিবাবুর মতো পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে তুলে দেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের বাড়িতে বৈঠক করেছেন, নবান্নেও। সুতরাং স্বাভাবিক প্রশ্ন, ডাক্তাররা যখন যেখানে ইচ্ছে বসবেন, আর মুখ্যমন্ত্রীকে ততবার সেখানে যেতে হবে?
তদন্তে সিবিআই, মামলা কোর্টে, পরিকাঠামো বাড়াতে তৎপর মা মাটি মানুষের সরকার। সেখানে অনশন যুক্তিসঙ্গত নয়। কিছু লোকের প্ররোচনায় রাজনৈতিক চিত্রনাট্যে কয়েকটি ছেলেমেয়ের শরীরে চাপ দিয়ে অরাজকতার চেষ্টা হচ্ছে।
আর এসবের ভেতরেই খবর আসছে। অন্য রকম খবর। আগামী একমাস বঙ্গ রাজনীতি আন্দোলিত হতে চলেছে ৬ বিধানসভা আসনের উপনির্বাচন ঘিরে।
আরও পড়ুন-রঘু ডাকাতের ‘সর্বমঙ্গলা’ আজ ‘সিদ্ধেশ্বরী’
এত কুৎসা, অপপ্রচার, সরকারের বদনামের পরও বিরোধীরা ভোট বাড়াতে পারবেন তো? নাকি অধিকাংশ আসনেই বিরোধীদের জামানত জব্দ হবে আবারও, বিশেষ করে হঠাৎ গা ঝাড়া দেওয়া বামেদের? আর গেরুয়া শক্তির তীরে এসে তরী ডুববে এবারেও? যেমনটা হয়েছে উনিশে, একুশে এবং গত ৪ জুনের লোকসভা ভোটের ফলে, অবিকল সেইরকম।
আসুন! উত্তরগুলো খুঁজে নিই, বুঝে নিই।
সিতাই আসনে প্রার্থী হয়েছেন সঙ্গীতা রায়, মাদারিহাটের তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী জয়প্রকাশ টোপ্পো। মেদিনীপুরে প্রার্থী হয়েছেন সুজয় হাজরা, তালডাংরা আসনে ঘাসফুল শিবিরের প্রার্থী হয়েছেন ফাল্গুনী সিং বাবু, হাড়োয়া থেকে ভোটে লড়ছেন শেখ রবিউল ইসলাম। নৈহাটি আসনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী করেছে সনৎ দে-কে।
লোকসভার ভোটের নিরিখে মেদিনীপুর, নৈহাটি, তালডাংরা, হাড়োয়া আসনগুলিতে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। মাদারিহাট আসন ছাড়া ঘাসফুল শিবির বাকিগুলিতেই ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেয়েছিল। রাজ্যের শেষ উপনির্বাচনে চার কেন্দ্রের চারটিই গিয়েছিল ঘাসফুল শিবিরের দখলে। সৎ, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি, মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারবেন এবং এলাকার মানুষের সার্বিক পরিষেবায় নিযুক্ত হতে পারবেন, এমন ব্যক্তিদেরই প্রার্থী করছে তৃণমূল কংগ্রেস। সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি কেন্দ্র থেকে এলাকাভিত্তিক রিপোর্ট নেওয়া হয়েছে। জেলা নেতৃত্বের কাছ থেকেও মতামত নিয়েছে শীর্ষ নেতৃত্ব। সেইসব রিপোর্টের ভিত্তিতেই প্রার্থী নির্বাচন।
আরও পড়ুন-এনআরএসে সদ্যোজাতর পেটে ভ্রূণ
তিলোত্তমা হোক বা অভয়া, আরজি কর-কাণ্ডে নির্যাতিতার বিচারের দাবি কানাগলিতে হারিয়ে গিয়েছে সেই কবেই। ধর্মতলার অনশন মঞ্চে গত দু’সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ দেখলে বেশ বোঝা যাচ্ছে, নির্যাতিতার বিচারকে ছাপিয়ে গিয়েছে জুনিয়র চিকিৎসকদের দশ দফা দাবি। তার অনেকটাই কিন্তু মেনে নিয়েছে কিংবা কার্যকর করার আশ্বাস দিয়েছে সরকার। কিন্তু সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস, ওষুধ ও ডায়াগনস্টিক কোম্পানির সঙ্গে সিন্ডিকেট বন্ধের কোনও দাবি সেখানে নেই কেন?
কোনও পরিকাঠামো নির্মাণ কি ২৪, ৪৮ কিংবা ৭২ ঘণ্টায় সম্ভব? কেন্দ্রীয় স্তরে রেফারাল ব্যবস্থা চালু করা, বেড খালির খতিয়ান, টানা ডিউটিতে ক্লান্ত ডাক্তারদের জন্য রেস্টরুম নির্মাণ, নিরাপত্তার স্বার্থে ক্যামেরা বাড়ানো, ডাক্তারদের জন্য আলাদা টয়লেট, নিরাপত্তা বৃদ্ধি, কাজের পরিবেশের উন্নয়ন সারাবছরই চলতে থাকে। এসবই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা যথারীতি আজও চলছে।
আরও পড়ুন-আন্দোলন মঞ্চে পন্থ-নন্দিনী, ফোনেই বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
আর থ্রেট কালচার? হুমকি সংস্কৃতি? আজ যাঁরা প্রতিবাদে মুখর তাঁদের অনেকেই বাম জমানায় ছিলেন ভয় দেখানো, হেনস্তা ও মারধরের প্রধান মুখ। আতঙ্কে কেউ মুখ খুলতে পারত না। স্বভাবতই রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে লাটে তুলে রাজপথে টানা অনশন কতটা যুক্তিসঙ্গত, সেই প্রশ্ন দিকে দিকে উঠছে।
ঘটনার ১০০ ঘণ্টার মধ্যেই তদন্তভার ন্যস্ত হয়েছে সিবিআইয়ের কাঁধে। সেই থেকে অভয়ার খুন ও ধর্ষণের তদন্ত ও বিচার রাজ্যের হাতে নেই। সিবিআই ও সুপ্রিম কোর্টের হাতে। একাধিক কর্তা, সিনিয়র আমলাকে বদলি করা হয়েছে। একমাত্র স্বাস্থ্যসচিব বাদে। কাকে কোন দায়িত্বে রাখা হবে, তা একটা নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে বিচারের কতটুকু সম্পর্ক। যদি না বাইরে থেকে কোনও উসকানি থাকে, বৃহৎ কোনও রাজনৈতিক এজেন্ডা কাজ করে থাকে তাহলে চিকিৎসকদের জীবন বাজি রেখে এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত?
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা। সর্বনাশ হচ্ছে গরিবের। আর ফুলে ফেঁপে উঠছে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম। তাদের গত দু’মাসের ব্যবসা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। তাই তাঁরা চাইছেন, এই অরাজকতা চলুক। কে না চায় এই মওকায় দৈনিক আয় দেড় থেকে দ্বিগুণ হোক।
আরও পড়ুন-খরস্রোতা নদীর পাশে তাঁবু, নিবু-নিবু আলোয় রাত্রিযাপন
সরকার বিরোধী কুৎসা পিছু ছাড়েনি বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোতেও। পুজোর রাতে মণ্ডপে ভিড় বেশি না ধর্মতলার অনশন মঞ্চে, তা নিয়েও চলেছে বিস্তর আলোচনা। বলা হয়েছে, মা দুর্গাকে দেখতে হলে ধর্মতলা যান। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আন্দোলনকারীরা বিচার চাইছেন না, চাইছেন ক্ষমতা বদল। আন্দোলনকারীদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকার মাটিতে সংগঠিত ‘দ্রোহ’ পর্বের পুনরাবৃত্তির অবাঞ্ছিত নেশা। সেই কারণেই সিবিআই তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া, সর্বোচ্চ আদালতের উপর আস্থা না রেখে রাজপথে দ্রোহের কার্নিভালের অবাঞ্ছিত অবতারণা।
এতকিছুর পরও রাজ্যের ৬টি আসনের মধ্যে ক’টায় লড়াই দেওয়ার মতো জায়গায় কুৎসাকারী বিরোধী শক্তি? ৫-১ বদলে এবার তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে ৬-০ ফল এখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। অভয়া আন্দোলন বিজেপির সিলেবাসের বাইরে। এটা মূলত বাম আর অতি বাম নকশালদের কিসসা। বুথ সংগঠন জেলায় জেলায় এখনও অত্যন্ত দুর্বল। তাই যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড, গড়িয়া, বাগুইআটি, ধর্মতলায় বিচারের দাবিতে ভিড় এখনও ইভিএম-এ প্রতিফলিত হওয়ার শক্তি-সামর্থ্য খুঁজে পায়নি। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের পরে রাজ্যে তিনটি বিধানসভার উপনির্বাচনে সিপিএম তথা বামেদের পরাস্ত করে জিতেছিল তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। সেই ইতিহাস মাথায় রেখে স্পষ্ট বলছি, বাংলার মানুষ এবারেও কিন্তু চক্রান্তের জাল কেটে ভোটযন্ত্রে ‘বিচার’ পেতে মরিয়া। সুতরাং শূন্যের শূন্যতা পুনর্বার নিশ্চিত।