কালী কলকাত্তাওয়ালি

প্রসিদ্ধ তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম কালী মূর্তি গড়ে কালীপুজোর প্রচলন করেছিলেন। তাঁর আগে কালী পূজিত হতেন শ্মশানে, পথে আর মন্দিরে। সেই থেকে আজ, পশ্চিমবঙ্গের কালীপুজোর মাহাত্ম্য লোকমুখে চর্চিত। বিশেষ করে কলকাতার বিখ্যাত ক্লাব এবং নামকরা মন্দিরগুলোর উদ্যোগে প্রতিবছর মহাসমারোহে পূজিত হন মা। লিখছেন কাকলি পাল বিশ্বাস

Must read

ফাটাকেষ্টর কালীপুজো
একটা সময়ে কলকাতার দাপুটে নাম ছিল ফাটাকেষ্ট। তাঁর আসল নাম কালীকৃষ্ণ। কিন্তু তিনি ফাটাকেষ্ট নামেই পরিচিত ছিলেন। উত্তর কলকাতার সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের একদিকে আমহার্স্ট স্ট্রিট, আর অন্যদিকে একটু এগোলেই কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া। এই সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের দশ ফুটিয়া গলিতেই সব থেকে বড় যে কালীপুজোটি হয় সেটাই ফাটাকেষ্টর পুজো বলে বিখ্যাত। যার পোশাকি নাম নবযুবক সংঘের কালীপুজো। দীর্ঘদিন ধরে এই পুজোটি হয়ে আসছে। এই ফাটাকেষ্টর পুজো সাতজন বন্ধুর মিলিত সহযোগিতায় শুরু হয়েছিল গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে। কিন্তু ফাটাকেষ্টর আমলে এই পুজোর রমরমা বাড়ে। এরপর এই পুজো সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়। তিনি জাঁকজমকে এই কালীপুজো শুরু করেছিলেন এবং তা এখনও ঠিক সেই ভাবেই হয়ে চলেছে। প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ ভিড় জমায় এই পুজোয়। এখানে উত্তম কুমার থেকে শুরু করে অমিতাভ বচ্চন, আর ডি বর্মন, আশা ভোঁসলে, বিনোদ খান্না প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তির পদধূলি পড়েছে। এমনও কথিত আছে যে, কুমারটুলি থেকে ফাটাকেষ্টর ঠাকুর না বেরোলে নাকি অন্য কোনও ঠাকুর মণ্ডপে যায় না। প্রথা অনুযায়ী আগের দিন কুমারটুলিতেই অলংকার পরিয়ে মোমবাতি দিয়ে মাকে আরতি করে তারপর পান হাতে দিয়ে আহ্বান করা হয়। পরের দিন সকালে বিশাল শোভাযাত্রা করে প্রতিমা মণ্ডপের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। শোভাযাত্রা সামনের দিকে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি থাকে। এছাড়াও সানাই বাদক, ব্যান্ড বাদক, শাঁখ হাতে স্থানীয় মহিলারা থাকেন। মায়ের যাত্রাপথ গঙ্গাজল এবং ফুল দিয়ে পরিশুদ্ধ করে আনা হয় প্রতিমা। আর এই প্রথা নাকি ফাটাকেষ্টর আমল থেকেই চালু হয়েছিল। এই মায়ের ভোগ রান্না করেন পুরোহিত নিজেই।

পাথুরিয়াঘাটা সর্বজনীন কালীপুজো
১৯২৮ সালে মহান বিপ্লবী বাঘা যতীনের হাত ধরে শুরু হয়েছিল পাথুরিয়াঘাটা সর্বজনীন কালীপুজোর। পাথুরিয়াঘাটার কালী মাকে বড়কালী মাও বলা হয়ে থাকে। এই কালীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ভূপেন বসু, মহারাজা শ্রীশচন্দ্র, মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্রের মতো মহান ব্যক্তিদের নাম। পাথুরিয়াঘাটা ব্যায়াম সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন। তাঁর পুজো প্রতিষ্ঠার দু’বছর পর অর্থাৎ ১৯৩০ সালে এই পুজোর সভাপতিত্ব করেন নেতাজি। কলকাতার সব থেকে পুরনো বারোয়ারি কালীপুজো হচ্ছে এটি। মায়ের হাতের যে রুপোর খাঁড়াটি আছে সেটি দান করেছিলেন নরেন পোদ্দার। আজও রীতিনীতি মেনে পুজোর দিন আড়াই ফুটের একটি রুপোর মঙ্গল ঘটে শোভাযাত্রা করে গঙ্গা থেকে গঙ্গা জল আনা হয়। এই শোভাযাত্রায় পুরুষ সদস্যরা ধুতি পাঞ্জাবি এবং মহিলা সদস্যরা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে খালি পায়ে অংশ গ্রহণ করেন। কালীপূজার পরের দিন এখানে অন্নকূট উৎসব পালন করা হয়। এখানকার মঙ্গলারতি দেখতে প্রচুর মানুষ আসেন। মার উদ্দেশ্যে এখানে ৫৬ ভোগ নিবেদন করা হয়।

আরও পড়ুন-এল ক্লাসিকোয় আজ ভিনি বনাম রাফিনহা

আমহার্স্ট স্ট্রিট সাধারণ
শ্রীশ্রী কালীপুজো কমিটি
আমহার্স্ট স্ট্রিট সাধারণ কৃষি কালীপুজোর পথচলা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। কিন্তু এই পুজোর রমরমা শুরু হয় আরও বছর কুড়ি পর থেকে। পরবর্তীতে এই পুজোর হাল ধরেছিলেন সোমেন মিত্র। সাত-আটের দশকের অস্থির সময়ে এই পুজোরই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফাটাকেষ্টর পুজো। জনশ্রুতি অনুযায়ী, একবার পুজোর বিসর্জনের ৪৬টা ব্যান্ড নামিয়েছিলেন কেষ্টদা আর তাঁকে টক্কর দিতে বাহান্নটা ব্যান্ড গয়না বন্ধক দিয়ে নামিয়েছিলেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের ছোড়দা তথা সোমেন মিত্র। এবছর তিরাশিতম বর্ষে পা দেবে এই সর্বজনীন পুজোটি।

জানবাজার সম্মিলিত
কালীপুজো সমিতি
১৯৬৯ সালে এই পুজোটির সূচনা হয়েছিল। এ বছর ৫৫ তম বর্ষে পদার্পণ করবে এই সর্বজনীন কালীপুজো। এই জানবাজার এলাকার কয়েকটি পূজো একত্রিত করেই শুরু হয়েছিল এই পুজোটি। দশ মহাশক্তি হচ্ছে কালী, তারা, ষোড়শী, মাতঙ্গী, ধূমাবতী, কমলা, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা এবং বগলা। মায়ের এই দশটি রূপ এখানে দেখতে পাওয়া যায়। মায়ের প্রতিটি মূর্তি পূজো হয় সমস্তরকম নিয়ম, আচার-অনুষ্ঠান মেনেই। এই পুজোটিতে দেখা যায় বহু বিশিষ্ট মানুষজনদের। এই পুজোর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে সমাজসেবা।

আরও পড়ুন-মণিপুরের সংকট, ত্রাতা হতে পারে কেবল সংবিধান

আমহার্স্ট স্ট্রিট বালক সংঘ
শ্রদ্ধানন্দ পার্কের পাশেই আমহার্স্ট স্ট্রিট বালক সংঘের পুজোটি হয়। এবার ৭১তম বর্ষে পদার্পণ করবে এই পুজোটি। এখানকার সাবেকি মাতৃমূর্তি দেখার জন্য জন্য প্রতি বছর বহু লোকসমাগম হয়ে থাকে। এখানকার কালী মাকে সাজানো হয় স্বর্ণালঙ্কারে। নিয়ম মেনে পুজোর পাশাপাশি আয়োজিত হয় বিভিন্ন রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়াও এখানে অন্নকূট হয়ে থাকে।

বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালী
অনেকদিন আগের কথা। সেই সময় ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত কুমারটুলি অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। আশেপাশে কোনও জনবসতি ছিল না। সেই সময় কালীবর তপস্বী নামে একজন সন্ন্যাসী গঙ্গাতীরে হোগলা পাতার ছাউনি করে তার নিচে কালী মূর্তি বসিয়ে পুজো করা শুরু করেন। কথিত আছে, ৫০০ বছর আগে তিনি নাকি হিমালয়ের এক গুহাতে উপাসনা করতেন। সেখানে তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পান। মা কালী তাঁর স্বপ্নে এসে বলেন যে গঙ্গার তীরে এক জঙ্গলে তিনি পড়ে রয়েছেন। মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে কালীবর চলে আসেন বাগবাজারের গঙ্গাপাড়ে অবস্থিত হোগলার বনে। এবং সেখানে হোগলা পাতার ছাউনির মধ্যে শুরু করেন মায়ের পুজো। আর সেই দেবীর নাম হয় সিদ্ধেশ্বরী কালী। কালীবর পুজো শুরু করলেও এরপর একজন কাপালিকের ওপর দেবীর পূজোর ভার বর্তায়। এরপর এই জঙ্গলে ঘেরা গঙ্গার পাশের হোগলা পাতার ছাউনির মন্দিরে পুজো শুরু করেন ডাকাতরাও। সেই সময় মায়ের আরাধনায় দেওয়া হত নরবলিও। তবে এই নরবলির ক্ষেত্রেও রয়েছে ভিন্ন একটি কাহিনি। বলা হয়ে থাকে, একদিন গঙ্গায় দু’জন বালক ভেসে আসে। ডাকাতরা তখন সেই দুই বালকের বলি দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু মায়ের আশীর্বাদে বালকদ্বয়কে নরবলি হওয়ার হাত থেকে সেই কাপালিক বাঁচিয়ে দেন। পরবর্তীকালে ওই বালকদের পরিবারের হাতেই পুজো পেতে শুরু করেন মা সিদ্ধেশ্বরী কালী। এরপর এই পুজো এদেরই আত্মীয় বলাগরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের হাতে যায়। আজও সেই মুখোপাধ্যায় পরিবারের হাতে বংশ-পরম্পরায় পূজিত হয়ে চলেছে বাগবাজারে সিদ্ধেশ্বরী কালীমা। শোনা যায় নটসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ এই মন্দিরের সিদ্ধেশ্বরী মাকে উত্তর কলকাতার গিন্নিমা বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। কালীপুজোর রাতে এখানে তন্ত্রমতেই দেবীর পূজা করা হয়। রাজা নবকৃষ্ণ দেবের আমল থেকে তাঁর নির্দেশ অনুসারে শোভাবাজারের বাজার থেকে ভোগের জন্য সবজি আসত, বর্তমানেও এই প্রথা অপরিবর্তিত রয়েছে।

আরও পড়ুন-আজ অস্কারের বেঞ্চে বসা নিয়ে জট, সমস্যার পাহাড় টপকে জয়ের খোঁজে ইস্টবেঙ্গল

ঠনঠনিয়া কালীমন্দির
আনুমানিক ১৭০৩ সাল। সেই সময় কলকাতার প্রায় অর্ধেক অঞ্চলই ছিল ঘন-জঙ্গলে ঢাকা। একদিন হঠাৎ করেই সেই জঙ্গল ঘেরা অঞ্চলে এক ভবঘুরে তন্ত্রসাধক এসে উপস্থিত হন তন্ত্রসাধনার উদ্দেশ্যে। সেই ভবঘুরে তন্ত্রসাধকের নাম ছিল উদয়নারায়ণ। তিনি সেই ঘন জঙ্গলের মধ্যে নিজের হাতে মাটি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী কালী মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা অর্চনা শুরু করেন। সেই সময় ওই অঞ্চলে লোক বসতি খুব কম ছিল। ফলে জায়গাটি ছিল ভীষণ নির্জন। আর সেই নির্জনতা ভেদ করে মাঝে মাঝেই শোনা যেত মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি ‘ঠনঠন ঠনঠন’। আর এই ঠনঠন শব্দ শোনা যেত বলেই তখন সেই এলাকার নাম হয় ঠনঠনিয়া। এই মায়ের মন্দিরের কথা ভক্তদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে বেশিদিন লাগেনি। আর ভক্তদের কাছে এই জাগ্রত কালীমন্দিরের নামও হয়ে যায় ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি। ১৮০৩ সালে শংকর ঘোষ নামে একজন ব্যবসায়ী মায়ের মন্দিরটি গড়ে দেন এবং তার সঙ্গে তিনি নিত্যপূজার দায়ভারও গ্রহণ করেন। এই শংকর ঘোষের বংশধররা এখনও এই মন্দিরের সেবায়েত। প্রতি বছর এই কার্তিক অমাবস্যা তিথিতে মহাসমারোহে পূজিত হন এই সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা। কথিত আছে, একদা মায়ের পুজোর সময় শ্মশান থেকে মড়া নিয়ে আসা হত এবং বামাচারী মতে শবসাধনা চলত। এই মন্দিরের দেবী মূর্তি মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রতি বছর নতুন করে তৈরি হয় বিগ্রহ। মায়ের গায়ে থাকে রুপোর গয়না। রামকৃষ্ণদেব যখন প্রথম জীবনে ঝামাপুকুরে বাস করতেন তখন নাকি মাঝে মাঝে এসেই মাকে গান শোনাতেন। একবার তাঁর শিষ্য কেশবচন্দ্র খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাঁর আরোগ্য কামনায় চিনি আর ডাব দিয়ে মা সিদ্ধেশ্বরীকে পুজো দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণদেব। আর এই পুজো দেওয়ার পরই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন কেশবচন্দ্র। আজও এই বিশ্বাসে এই মাকে ডাব ও চিনি দিয়ে পুজো দেন ভক্তগণ। তবে অমাবস্যায় নিরামিষ ভোগই দেওয়া হয় মা সিদ্ধেশ্বরীকে।

আরও পড়ুন-রাতের পর সকালেও তিনি সেই নবান্নেই

বউবাজারের ফিরিঙ্গি কালী
এই ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অ্যান্টনি কবিয়ালের নাম। এই কালীমন্দির ঘিরে রয়েছে নানান কাহিনি। কারও কারও মতে, এই মন্দিরটি নাকি কোনও এক নিচু জাতের ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এর দায়িত্ব পান শ্রীমন্ত পণ্ডিত নামে একজন ব্রাহ্মণ। আবার অন্য একটি মত অনুযায়ী এখানে নাকি আগে একটি শিবমন্দির ছিল। পরবর্তীকালে শ্রীমন্ত পণ্ডিত এখানে কালীমন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। এই শ্রীমন্ত পণ্ডিত নাকি বসন্ত রোগের চিকিৎসা করতেন। সেই সময় বউবাজারে প্রচুর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ফিরিঙ্গি থাকত। তারা এই শ্রীমন্ত পণ্ডিতের কাছে চিকিৎসা করাতে আসতেন। সুস্থ হয়ে গেলে তাঁরা শ্রীমন্ত পণ্ডিতের কালীমন্দিরে পুজো দিতে আসতেন। এই কালীবাড়ির নাম হয়েছে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি। আবার আরেকটি মতে, অ্যান্টনি কবিয়ালের মামা অ্যারাটুন সাহেব এই মন্দিরের পাশের গলিতে বসবাস করতেন। সেই সুবাদে অ্যান্টনি কবিয়াল প্রায়ই এই মন্দিরে আসতেন এবং গান গাইতেন। আবার কারওর মতে, অ্যান্টনি কবিয়াল নাকি মাটির কালী মূর্তি গড়ে এই মন্দিরে বসিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় পুরনো মূর্তি ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ১৯৮৭ সালে কংক্রিটের মূর্তি তৈরি করা হয়। কালীপুজোর দিন বহু ভক্ত আজও এই মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে আসেন।

Latest article