২০১৫ সালের ১১ মে ‘উইমেন অব আলজিয়ার্স’ নামক একটি ছবি বিশ্বের সবচেয়ে দামি শিল্পকর্মে পরিণত হয়েছিল, এই চিত্রকর্মটি ১৭ কোটি ৯৩ লাখ ৬৫ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছিল। আর এই শিল্পকর্মটি যার তাঁর নাম পাবলো পিকাসো। ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর দক্ষিণ স্পেনের মালাগা শহরে মারিয়া পিকাসো লোপেজ ও হোসে রুইজ ব্লাসকোর ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন পাবলো পিকাসো। পিকাসোর বাবা ছিলেন চিত্রাংকনের শিক্ষক এবং স্থানীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক। ছোট থেকেই রং তুলির ওপর আকর্ষণ জন্মায় পিকাসোর। বাবার কাছেই ছোটবেলায় তিনি ছবি আঁকার তালিম নিয়েছিলেন। ৭ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে তৈলচিত্রের হাতেখড়ি নিয়ে মাত্র নয় বছর বয়সে একটি সম্পূর্ণ তৈলচিত্র এঁকে ফেলেন।
১৮৯৫ সালে তাঁদের গোটা পরিবার চলে যান বার্সেলোনায়। সেখানে গিয়ে একটি আর্ট স্কুলে পিকাসো তাঁর শিল্পশিক্ষা শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে মাদ্রিদের সান ফার্নান্দো রয়্যাল অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন তিনি। সেই সময় থেকে বিভিন্ন ধরনের মানুষের ছবি আঁকতে শুরু করেন তিনি। এরপর এক বন্ধুর সঙ্গে তিনি প্যারিসে চলে যান। জীবনের অনেকটা সময় সেখানেই কাটিয়ে দেন।
আরও পড়ুন-ঘরের মাঠে শুরু হল পাওয়ার-প্লে, মহারাষ্ট্রের ভোটে সম্মানরক্ষার লড়াই
কালজয়ী এই শিল্পীর জীবনে প্রেম ছিল প্রবাহমান। নদীর স্রোতের মতোই প্রেমিকাদের আসা-যাওয়া লেগেই থাকত তার জীবনে। ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও তাঁর প্রেমিকাদের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন পিকাসো । আর তাঁর প্রত্যেক প্রেমিকার হাত ধরেই নতুন নতুন শিল্প সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। মনে করা হয় এক- একজন নারীর এক-এক রকম বৈশিষ্ট্যর জন্য পিকাসোর চিত্রকর্মে ও নানা ধরনের বৈচিত্র দেখা গেছে। শোনা যায় এই কালজয়ী শিল্পী যখন প্রথম কথা বলেছিলেন তখন তাঁর মুখ দিয়ে বাবা-মা নয়, প্রথম যে শব্দটি বার হয়েছিল সেটি হল লাপিয, স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ হচ্ছে পেন্সিল। কিন্তু পরবর্তীতে নারীঘটিত সম্পর্কগুলোকে কেন্দ্র করে তাঁর মধ্যে বিশাল পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। ১৯৪৩ সালে পিকাসো তাঁর রক্ষিতা ফ্রাসোয়া গিলতকে বলেছিলেন, ‘‘নারীরা যন্ত্রণা সৃষ্টির যন্ত্র।’’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘আমার জীবনে নারীরা কেবল দুই রূপে স্থান পায়, দেবী অথবা পাপোষ।’’
পিকাসোর জীবনে আসা বহু নারীর মধ্যে সাতজন নারী ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। এই সাতজন নারীর মধ্যে দু’জন আত্মহত্যা করেছিলেন এবং দু’জন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন।
১৯০৪ থেকে ১৯১১, পিকাসোর জীবনের সঙ্গে যাঁর জীবন জড়িয়ে ছিল তাঁর নাম ছিল ফার্নান্দে অলিভিয়ার। তিনি একজন মডেল ছিলেন। এই অলিভিয়ারের সাথেই সবথেকে দীর্ঘদিন প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন পাবলো পিকাসো। অলিভিয়ার ছোটবেলার দুঃসহ স্মৃতি এবং কৈশোরে ভুল মানুষকে বিয়ে করার যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্যারিসের বোহেমিয়ান জীবন যাপন শুরু করেছিলেন। আর এখানেই তাঁর সাথে পিকাসোর পরিচয় হয়। এরপরে তাঁরা প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ হন। অলিভিয়ার এর সঙ্গে সম্পর্কের থাকাকালীন পিকাসো তাঁর অসংখ্য ছবি আঁকেন। ১৯১১ থেকে ১৯১৫, পিকাসোর জীবনে প্রবেশ ঘটে ইভা গোয়েলের। শৈশবে ইভার নাম ছিল মার্সেলে হামবার্ড, কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি ইভা গোয়েল নামেই পরিচিতি লাভ করেছিলেন। অলিভিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পরেই ইভার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন পিকাসো। এই ইভা ছিলেন ক্ষণজন্মা। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর পিকাসো খুবই ভেঙে পড়েছিলেন, আর তখন তার ক্যানভাসে জন্ম নিয়েছিল ‘আই লাভ ইভা’ এই চিত্রকর্মটি। আর এই চিত্রশিল্পটির মধ্যে ইভার প্রতি পিকাসোর ভালবাসা জনসম্মুখে উঠে আসে।
আরও পড়ুন-ভুয়ো বোমার হুমকি নিয়ে কেন্দ্রের সতর্কতা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিকে
১৯১৭ থেকে ১৯৩৫, পাবলো পিকাসোর জীবন জুড়ে ছিল ইউক্রেনিয়ার নৃত্যশিল্পী ওলগা খোখলোভা। ওলগা ছিলেন একজন ব্যালে শিল্পী। তিনি যখন রোমে ব্যালে প্যারেড ডিজাইন করছিলেন সেই সময় তাঁর সাথে পিকাসোর আলাপ হয়। আর সেই আলাপ প্রেমে পরিণত হয়। এরপর ১৯১৮ সালে তাঁরা বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হন। আর ওলগা ছিলেন পিকাসোর প্রথম স্ত্রী, তার প্রথম সন্তান পাউলোর জননী। ১৯৩৫ সালে তাঁরা একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যান। ওলগার সাথে থাকাকালীনই মারি ওয়াল্টারের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন পিকাসো। সালটা ছিল ১৯২৭। পিকাসোদের ফ্ল্যাটের খুব কাছেই থাকতেন মারি। আর্ট গ্যালারির বাইরে পিকাসোর সঙ্গে পরিচয় ঘটে এই স্বর্ণকেশীর। এবং তাঁরা ধীরে ধীরে একে অপরের খুব কাছে চলে আসেন। প্রথম দিকে ওলগা মারির কথা কিছুই জানতে পারেননি, কিন্তু যখন মারি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন তখন ওলগার কানে সবকিছু পৌঁছে যায়। প্রায় আট বছর মারির সঙ্গে সম্পর্কের কথা পিকাসো লুকিয়ে রেখেছিলেন। মারি আর পিকাসোর কন্যা সন্তান হচ্ছে মায়া। মায়ার বয়স যখন এক বছর তখন আবার পিকাসো দোরে মার নামে একজন যুগোস্লাভিয়ান আলোকচিত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। আর এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেন না মারি, তিনি তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
১৯৩৬ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত পিকাসোর সবসময়ের সঙ্গী ছিলেন দোরে মার। দোরে মার একধারে যেমন আলোকচিত্রী ছিলেন অন্যদিকে তিনি চিত্রশিল্পী এবং কবিও ছিলেন। ১৯৪৩ সালে শিল্পকলার ছাত্রী ফ্রাসোয়া গিলতের প্রেমে পড়েন পিকাসো। আর তারপরে ১৯৪৪ সালে দোরে মারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয় তাঁর। পিকাসোর পরবর্তী প্রেমিকা ফ্রাসোয়া গিলত ১৯৪৪ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পিকাসোর সঙ্গে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। আসলে গিলাত ছিলেন আইনের ছাত্রী, পরিবারের চাপে আইন নিয়ে ভর্তি হলেও তাঁর ভালবাসার বিষয় ছিল শিল্পকলা। তাই তিনি সুযোগ পেয়েই শিল্পকলায় ভর্তি হন। আর তখনই তাঁর জীবনে আসে পিকাসো। এরা কোনওদিন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি, তবে এদের ঘর আলো করে দুই সন্তান ক্লদ ও পালোমার জন্ম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পিকাসোর আঁকা শান্তির পায়রা অনুযায়ী এই দুই সন্তানের নামকরণ করা হয়েছিল। পিকাসোর সঙ্গে গিলতের সম্পর্ক ছিল নয় বছর। আর এই নয় বছরই পিকাসোর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে ধরা হয়। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৩ পিকাসোর প্রেমিক জীবনে প্রবেশ ঘটে জ্যাকলিন রোকের। ভ্যালারিসের মাদুরা পটারি স্টুডিওতে সিরামিকসের কাজগুলো করতেন পিকাসো। আর এই স্টুডিওতেই সহকারী বিক্রেতা ছিলেন জ্যাকলিন। সেই সময় পিকাসো নিঃসঙ্গ আর হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আর সেই নিঃসঙ্গ জীবনে প্রবেশ ঘটে ২৭ বছর বয়সী জ্যাকলিনের। ১৯৬১ সালে জ্যাকলিনকে বিয়ে করেন ৭৯ বছরের পিকাসো। অন্যান্য প্রেমিকাদের তুলনায় জ্যাকলিনকে নিয়ে সব থেকে বেশি চিত্রকর্ম রয়েছে পিকাসোর। তাকে নিয়ে ৪০০টি পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন-পূর্ব লাদাখ থেকে সেনা সরানো শুরু করে দিল ভারত ও চিন
বিশ্বখ্যাত এই প্রেমিক পুরুষ একাধিক নারীর সঙ্গে প্রণয় সম্পর্কে লিপ্ত থাকলেও তাঁর জীবনের একটা অজানা দিক নিয়ে ২০০৯ সালে মার্ক হাডসন একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ‘পিকাসো-চ্যালেঞ্জিং দ্য পাস্ট’ এই শিরোনামে ন্যাশনাল গ্যালারিতে একটি চিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়। সেখানে পিকাসোর সঙ্গে নারীদের কমপ্লিকেটেড রিলেশনশিপ বা জটিল সম্পর্কের দিকগুলো তুলে ধরা হয়।
১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল, ৯১ বছর বয়সে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত, কিউবিজমের জনক এই মহান শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন।