বিভেদবিহীন দেবী কালিকা

ছোট থেকে বড়, নানা আকারে কালী মূর্তির পুজো হয় রাজ্যের নানা জায়গায়। সেসব পুজোয় জড়িয়ে আছে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত চেতনার কথা। লিখছেন আকসা আসিফ

Must read

কয়েক বছর আগে জানুয়ারি মাসের কথা। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনী। নাম ‘তন্ত্রঃ এনলাইটেনমেন্ট টু রেভোলিউশন’। অর্থাৎ, তন্ত্র ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবের জ্ঞানদা শক্তি। সেই প্রদর্শনীতে যাঁরা গিয়েছিলেন তাঁরা ভালমতোই টের পেয়েছিলেন, তন্ত্র এবং তন্ত্রের মূল শক্তি কালী পাশ্চাত্য সমাজের কাছে কতটা অজ্ঞেয় বা দুর্জ্ঞেয় বিষয়। যাঁরা তন্ত্রকে মধ্যযুগে শরীরী বিদ্যার উপকরণের বাইরে আর কিছু ভাবতে পারেন না, তাঁর আসলে যেটা জানেন না বা বুঝতে চান না, তন্ত্রের ব্যুৎপত্তিগত অর্থের মূলে আছে ‘তন’ যার অর্থ ‘বয়ন’। তন্ত্র তাই দেব ও দেবীর মধ্যে সংলাপ, কথার বয়ন। কালী হলেন তান্ত্রিক সাধকদের কাছে যুগপৎ মাতৃশক্তি ও মাতৃবাৎসল্যের প্রতীকস্বরূপা।

আরও পড়ুন-আনোয়ার শাহ রোডের বস্তিতে আগুন, আহত এক

উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে তন্ত্রে পূজ্য সেই কালিকা মৃত্যু ও কালের দেবী হিসেবে একযোগে রক্ষাকর্ত্রী ও ধ্বংসকারিকা রূপে ধরা দিয়েছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের চোখে। কিন্তু ইংরেজ শাসক ও মিশনারির দল সে কথা বুঝল অন্যভাবে। মিশনারিরা ভাবল, নগ্নিকা রূপের কারণে দেবী আসলে অসভ্য অনুন্নত বর্বরদের পূজনীয়া। ওই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত একটি মাটির কালীমূর্তি সেই হিসেবেই ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে উপহার দিয়েছিলেন জনৈক মিশনারি ১৮৯৪ সালে।
ওখানে প্রদর্শিত একটি মুদ্রিত ছবি। মুদ্রণকাল ১৮৮৫। দেবী নৃমুণ্ডমালিনী। ইংরেজ অফিসাররা ভেবেছিল ওগুলো বুঝি ওঁদেরই কাটা মুন্ডু। তাই ওই ছবি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। ভাবাটা খুব একটা অযৌক্তিক ছিল না। কারণ, বিপ্লবীদের প্রচারপত্রে কালীর ছবি থাকত আর ব্রিটিশদের উল্লেখ থাকত সাদা ছাগল হিসেবে যেগুলোকে মায়ের বলির জন্য হাড়িকাঠে চড়াতে হবে। বিশ শতকের গোড়ায় তাই কালী আর বিপ্লব সমার্থক হয়ে গেল ব্রিটিশ রাজশক্তির চোখে। ১৯০৭-এ কের তাঁর ‘পলিটিক্যাল ট্রাবল ইন ইন্ডিয়া’ রিপোর্টের শুরুতেই লাগিয়ে দিলেন কালীর ছবি।
লাগাবেন তো বটেই। আসলে কালী যে নানাভাবে বাংলার নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছেন।

আরও পড়ুন-ছয় কেন্দ্রে রবিবাসরীয় প্রচারে ঝড় তৃণমূলের

নেই কোনও থিমের জাঁকজমক, নেই বিশেষ প্যান্ডেল সজ্জা। তবুও হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ভিড় করেন বীরভূমের পুরন্দপুরের বান্ধব সমিতির কালীপুজোয়। কারণ, এখানকার কালীর উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। এই ক্লাবেরই কয়েক সদস্য দুর্গাপুজোর নবপত্রিকা স্নান করানোর সময় হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন, তাঁদের ক্লাবের কালীপুজোর প্রতি মানুষের বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রাজ্যের সবচেয়ে বড় প্রতিমা তৈরি করবেন। আর যেমন ভাবনা তেমন কাজ। শুরু হয় বিশালাকার কালীর পুজো। সেটা ১৯৪০ সালের কথা। এরপর ক্লাবের ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ৭৫ ফুটের কালী তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সদস্যরা। কিন্তু তার বাস্তবায়ন সম্ভব না হওয়ায় সেই বছর ৭১ ফুটের প্রতিমা তৈরি করেছিলেন তাঁরা।
নবদ্বীপে আবার অন্য কাহিনি।
কৃতী পণ্ডিত মহেশ্বর গৌড়াচার্যের দুই সন্তান। কৃষ্ণানন্দ ও মাধবনানন্দ। জ্যেষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণানন্দ ভট্টাচার্যের আবির্ভাব ষোড়শ শতকের শেষ ভাগে। বাংলার তন্ত্রচর্চার মূলত দুই ধারা। আগম ও নিগম। আগম পদ্ধতিতে তন্ত্রসাধকরা আগম নবদ্বীপের বাগীশ উপাধি পেতেন। কৃষ্ণানন্দ আগমপদ্ধতিতে তন্ত্রসাধনা করার ফলে তিনি কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। বলা হয় বাংলার ঘরে যে কালীমূর্তির পুজো-আচ্চা, প্রচার-প্রসার তার সূত্রপাত নবদ্বীপের তন্ত্রবিশারদ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাত ধরেই। এনিয়ে লোককাহিনি প্রচলিত আছে। সারারাত মা-কালীকে আকুল হয়ে ডেকেও সাড়া পাননি কৃষ্ণানন্দ। ভোরবেলায় কৃষ্ণানন্দ চলেছেন গঙ্গাস্নানে। পথিমধ্যে এক গরিব প্রায় অর্ধ-উলঙ্গিনী গোয়ালিনী ঘুঁটে দিচ্ছিলেন। কাকভোরে সাধারণত পথে কেউ বেরোন না। তাই সে সময়ে গোয়ালিনী আসতেন ঘুঁটে দিতে। হঠাৎ সামনে আগমবাগীশকে দেখে তিনি লজ্জায় জিভ কেটে ফেলেন। একটি কাঠের পাঠাতনের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই গোয়ালিনী। কালো সেই নারীর রূপ দেখে বিমোহিত হয়ে গেলেন কৃষ্ণানন্দ। রূপদান করলেন মাতৃমূর্তির। কাঠের পাঠাতনের কল্পিত রূপ শিব। কৃষ্ণানন্দ তখন মাতৃরূপে বিভোর। তিনি ঠিক করলেই সামনের অমাবস্যাতেই তিনি মায়ের পুজো করবেন কিন্তু এই রমণীকে দেখার পর অমাবস্যা হতে আর একদিন বাকি ছিল। রাতারাতি কালীমূর্তি তৈরি করে তাতে রং করে চক্ষুদান করে পুজো করেন তিনি। গোটা প্রক্রিয়াটাই হয়েছিল একদিনে। সেই থেকেই এই রীতি প্রচলিত হয়ে আসছে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের জন্মস্থান নবদ্বীপের ভিটেতে। নবদ্বীপের আগমেশ্বরী পাড়ায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের সাধনস্থলে এখনও এই মূর্তি পুজো হয়।

আরও পড়ুন-গঙ্গাসাগরে সমবায় সমিতির নির্বাচনে বিপুল জয় তৃণমূলের

বাম ঊর্ধ্ব হস্তে খড়্গ ও অধোহস্তে অসুর মুণ্ড ধারণ যে মূর্তি আমরা দেখি তাঁর সাথে গ্রামবাংলার গোয়ালিনীর রূপের কোনও মিল নেই। বাংলায় সর্ববহৎ এবং সুপরিচিত বৃহৎ তন্ত্রসার কৃষ্ণানন্দ রচিত হলেও, কৃষ্ণানন্দের বহু পূর্বে রচিত বিশ্বসার তন্ত্র নিরুত্তর তন্ত্র ও কালীতন্ত্রে দক্ষিণা কালীর মূর্তির বর্ণনা আছে। তিনি কালীতন্ত্র হতে বচন উদ্ধৃত করে তন্ত্রসারে কালীমূর্তির পূর্বতন বর্ণনাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন মাত্র, এমনটাই মনে করেন পণ্ডিতরা।
কালীঘাটের মন্দির সংক্রান্ত ইতিকথার সামনে বাঙালির হিন্দু বনাম মুসলমান দ্বৈরথের অর্বাচীন প্রকল্প দাঁড়াতে পারবে না। ১৮৯১ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হিন্দু কলেজের সহপাঠী গৌরদাস বসাক আবার লন্ডন, বস্টন ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য ক্যালকাটা রিভিউ-তে জানাচ্ছেন, কালীঘাটই কালীক্ষেত্র। নবাব মহব্বত খান দেবীর সেবার জন্য কলকাতা গ্রামের কিছু জমি দান করেন। সেখান থেকেই শহরের নাম। তাই ১৮৪১ সালের বেঙ্গল অ্যান্ড আগরা গেজ়েটিয়ার-এও দেবী কালীকে উৎসর্গীকৃত গ্রামের নাম কলকাতা। এখানে পাশাপাশি দু’টি বেদি, একটি মা ষষ্ঠীর, অন্যটি মনসার। দু’টিই নাকি বৈদান্তিক দশনামী সম্প্রদায়ের দুই সন্ন্যাসীর সমাধিবেদি। একটি চৌরঙ্গি গিরির, অন্যটি জঙ্গল গিরির। গৌরদাস বসাক জানাচ্ছেন, চৌরঙ্গি গিরি কালীপ্রতিমা আবিষ্কার করে শিষ্য জঙ্গল গিরির হাতে সেবার দায়িত্ব দিয়ে গঙ্গাসাগর চলে যান। তাঁর নামেই আজকের চৌরঙ্গি এলাকা।
কলকাতার জন্মকাহিনিতে কালীক্ষেত্র কালীঘাটের মহিমা ব্রিটিশরা মানবেন কেন? তাঁরা যখন তাঁদের প্রিয় বাণিজ্যনগরী নিয়ে লিখতে বসলেন, সেই সব লেখায় শুধুই জোব চার্নকের স্তুতি। তার আগে কলকাতা নাকি জনমানবহীন অস্বাস্থ্যকর জলাজমি ছিল, কোনও মন্দিরের উল্লেখও তাঁদের লেখায় নেই। ইংরেজি-শিক্ষিত গৌরদাস বসাক, অতুলকৃষ্ণ রায়, প্রাণকৃষ্ণ দত্তরা তখনই কালীঘাট-মাহাত্ম্য লিখতে শুরু করলেন। চার্নক ও ইংরেজের অবদান তাঁরা অস্বীকার করলেন না, কিন্তু কালীঘাট যে ঢের আগে থেকে পুণ্যক্ষেত্র, সেটিই তাঁদের প্রতিপাদ্য। ইংরেজি-শিক্ষিত নব্য ভদ্রলোকেরা মন্দিরকে প্রাধান্য দিলেন ঠিকই, কিন্তু অতুলকৃষ্ণ রায় ও প্রাণকৃষ্ণ দত্তের কালীকাহিনি শুরু হল কলকাতার ভূতাত্ত্বিক গড়ন দিয়ে। নেটিভ শহরের প্রান্তে অবস্থিত মন্দির, অথচ সবাই লিখছেন, কালীক্ষেত্রকে কেন্দ্র করেই শহর।

আরও পড়ুন-কর্মীরাই দলের সম্পদ, বীরভূমের একাধিক বিজয়ামঞ্চে মন্তব্য মন্ত্রীর

সূর্যকুমার হালদার তাঁর পূর্বপুরুষদের কথা বলতে গিয়ে ‘কালীক্ষেত্র-দীপিকা’য় লিখছেন, নবাব আলিবর্দি খান সেনাবাহিনীর হিন্দু হাবিলদারদের ‘হালদার’ পদবিতে ভূষিত করে কালীঘাটে জমিজিরেত দিতেন। তাঁরাই আজকের হালদার সেবায়তদের পূর্বসূরি। হিন্দু মন্দির-কেন্দ্রিক নব্য জাতীয়তাও সেদিন হিন্দু-মুসলমানে বিভেদ করেনি। কোন কাহিনির কতখানি প্রামাণ্য, কতটা নয়, সে অন্য তর্ক। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার। কালীঘাটের মজ্জায় হরেক বিভেদকে তুচ্ছ করে দেওয়ার ঐতিহ্য অন্তঃসলিলা হয়ে আছে। জরুরি ঐতিহ্য।

Latest article