মারাঠি গোডবোলে
নাম তাঁর রোহিণী গোডবোলে (Rohini Godbole)। ২৫ অক্টোবর শুক্রবার আমাদের ছেড়ে একেবারেই চলে গেলেন চিরন্তনের দেশে! হ্যাঁ নক্ষত্রপতনই বটে; সূর্য থেকে প্রায় ৬৫ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত উজ্জ্বলতম রোহিণী নক্ষত্রটি যেন আজ থেকে প্রায় ৭২ বছর আগে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছিল জ্ঞান, শক্তি ও সৃজনশীলতার আলো দিতে, আজ আবার চিরবিদায় নিয়ে মনে হয় সেই নিসর্গতটেই ফিরে গেল।
রোহিণী নক্ষত্র, তাও আবার গোডবোলে, মারাঠি ভাষায় যার অর্থ মিষ্টভাষী; নামের যথার্থই সার্থকতা— মিষ্টভাষী তারা। সত্যিই তিনি বৈজ্ঞানিক মহলে একজন উজ্জ্বল তারাই বটে— একজন বুদ্ধিদীপ্ত গবেষক, মাতৃময়ী শিক্ষিকা, সহযোগী সহমর্মী সহকর্মী, দার্শনিক নেত্রী, এবং নারীকল্যাণ চ্যাম্পিয়ন। তাঁর প্রয়াণে সমগ্র বৈজ্ঞানিক সমাজ শোকসন্তপ্ত। সকলের ঐকান্তিক প্রার্থনা, অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না; এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো…
আগমনি
কালের দুর্বার স্রোত যখন সব কিছু খড়কুটোর মতো বয়ে নিয়ে যায়, ঠিক তখনই এমন একটি দিন আসে যেদিন ধরাতলে জন্ম নেয় একটি নক্ষত্র, হয়তো আগামী দিনে কোনও রেনেসাঁস বয়ে আনবে বলে। সেদিন ১২ নভেম্বর, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ, মহারাষ্ট্রের পুনেতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রোহিণী গোডবোলে (Rohini Godbole)। দুর্ভাগ্যজনক যে এ-বছর আগামী ১২ নভেম্বর তাঁর আর ৭২তম জন্মদিনটি উদযাপন করা হল না! তার আগেই ২৫ অক্টোবর শুক্রবার, ২০২৪ তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্যার পরশুরামভাও মহাবিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও পরিসংখ্যানবিদ্যা নিয়ে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, মুম্বই থেকে মাস্টার ডিগ্রি এবং ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার স্টোনি ব্রুকের দ্যা স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক থেকে থিওরেটিক্যাল পার্টিকল ফিজিক্স বা তাত্ত্বিক কণা পদার্থবিজ্ঞানের উপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর তিনি মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ প্রতিষ্ঠানে একজন ভিজিটিং ফেলো বা বহিরাগত গবেষক হিসেবে কাজে যোগ দেন।
কর্মযজ্ঞ
মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউটের গবেষণা শেষে তিনি (Rohini Godbole) তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনে প্রথম তিনি ১৯৮২–১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে একজন লেকচারার এবং রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের অন্তর্ভুক্ত দ্য সেন্টার ফর হাই এনার্জি ফিজিক্স প্রতিষ্ঠানে একজন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজে যোগদান করেন; ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস নাগাদ তিনি পূর্ণ অধ্যাপক হিসেবে পরিগণিত হন। ওই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ২৫ বছরের কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘটে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই; কিন্তু তিনি প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে আসেননি, তাঁর কাজের প্রতি এতটাই প্রগাঢ় ভালবাসা যে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অবৈতনিক অধ্যাপক হিসেবে ওইখানে কর্মরত ছিলেন।
আরও পড়ুন-বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভই তুরুপের তাস জয়প্রকাশের
গবেষণা
তাঁর শিক্ষা এবং শিক্ষকতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল কণা পদার্থবিদ্যা; এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তাঁর গবেষণার অনুদান অপরিমেয়; এই বিষয়ে নিবিড় গবেষণার জন্য তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা, এবং লক্ষ্য স্থির রেখে একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার দৃঢ়তা বহুসংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষক উভয়কেই সমান উদ্দীপিত করেছে। কণা পদার্থবিদ্যা, যাকে ইংরেজিতে বলে পার্টিকল ফিজিক্স বা হাই এনার্জি ফিজিক্স, যা হল বস্তু এবং বিকিরণ তৈরি হতে যে মৌলিক কণা বা ফান্ডামেন্টাল পার্টিকল এবং বল বা ফোর্স-এর প্রয়োজন হয় সে বিষয়ে পড়াশোনা। পার্টিকল ফিজিক্সে ফান্ডামেন্টাল বা এলিমেন্টারি পার্টিকলস বা মৌলিক কণার প্রোটন ও নিউট্রনের স্কেল পর্যন্ত সমন্বয় বা কম্বিনেশন নিয়ে আলোচনা হয়; আর নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয় বা কম্বিনেশন নিয়ে আলোচনা হয়।
একটি বস্তু বা পদার্থ অসংখ্য মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি হয়, যে কণাগুলোকে আর ভাঙা যায় না। মৌলিক কণা অণু, পরমাণু, আয়ন, ইলেক্ট্রন কিংবা প্রোটন যে কোনও একটি হতে পারে; কিন্তু পরমাণু প্রোটন, নিউটন এবং ইলেক্ট্রনের সহযোগে তৈরি একটি সিঙ্গেল নিউট্রাল পার্টিকল। ড. রোহিণী গোডবোলে (Rohini Godbole) তাঁর গবেষণা পরিসরে স্ট্যান্ডার্ড মডেল অব পার্টিকল ফিজিক্স এবং তৎসংশ্লিষ্ট আরও গভীর পদার্থবিজ্ঞানের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি এই ব্রহ্মাণ্ডের চারটি মৌলিক বলের মধ্যে গ্রাভিটিকে বাদে বাকি তিনটি (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক, উইক এবং স্ট্রং ইন্টার-অ্যাকশন ফোর্স) এবং পরিচিত সমস্ত মৌলিক কণার বর্ণনা এবং তাদের গঠন, বৈশিষ্ট্য, আচরণ প্রভৃতি নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন।
পার্টিকলসের স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত ১৭টি পৃথক মৌলিক কণার সন্ধান পাওয়া গেছে, যার মধ্যে বস্তু কণা বা ফার্মিয়ন ১২টি এবং বল কণা বা বোসন ৫টি। বিজ্ঞানের এই শাখার উপর তাঁর প্রায় তিন দশকের মেহনত তাঁকে আন্তর্জাতিক স্তরে একজন প্রতিষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞানীর স্বীকৃতি দিয়েছে। বোসন কণার উপর গবেষণা তাঁকে ইউরোপীয় ল্যাবরেটরি সার্নের ইন্টারন্যাশনাল লিনিয়ার কোলাইডারের জন্য দ্যা ইন্টারন্যাশনাল ডিটেক্টর অ্যাডভাইসারি কমিটির সভ্য করা হয়েছিল। তিনি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কোলাইডারের জন্য নতুন কণার খোঁজ করেছিলেন; তিনি প্রোটন, ফোটন এবং নিউট্রনের গঠনগত কার্যকারিতা অনুধাবনের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য কণার ফেনোমেনোলজিও পাঠ করার চেষ্টা করেন। কণা পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি তিনি ইলেক্ট্রোউইক ফিজিক্স এবং সুপার-সিমেট্রির উপরও কাজ করেন। বিজ্ঞানের এই শাখার উপর তাঁর প্রায় ১৫০টিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
প্রাপ্তি
তবে তিনি শুধু পড়াশোনার গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি; শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়; তিনি এ-বিষয়ে অত্যন্ত সরব হয়ে মেয়েদের অবস্থান শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নয়, বাকি সবক্ষেত্রেই সমান করার লক্ষ্যে রীতিমতো লড়াই করেছেন। তিনিই প্রথম ‘ইনসা রিপোর্ট : অ্যাকসেস অব ইন্ডিয়ান উইমেন টু ক্যারিয়ারস ইন সায়েন্স’ প্রকাশ করেন। গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একজন নারীকল্যাণকর্মী হিসেবে পরিচিত হন। তিনি সহকর্মী ড. রাম রামাস্বামীর সঙ্গে একত্রে একশত ভারতীয় নারীবিজ্ঞানীর জীবনীসমৃদ্ধ ‘‘লীলাবতি’স ডটার’’ নামে বইটি সম্পাদনা করেন।
‘ওয়ার্ক আন্ডার’ নয়, সবসময় তিনি ‘ওয়ার্ক উইথ’ সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করতেন। তাঁর নিবিড় গবেষণা ও নারী কল্যাণে তাঁর ভূমিকা তাঁকে নানাভাবে সম্মানিত করেছে। তিনি ভারতীয় সায়েন্স অ্যাকাডেমি ফেলোশিপের সঙ্গে সঙ্গে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার পান এবং ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সরকার তাঁকে ন্যাশনাল মেরিট অর্ডার পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গ্রুপের পক্ষ থেকে তাঁকে দেবী পুরস্কার প্রদান করা হয়। তাঁর প্রয়াণে সমগ্র ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের বৈজ্ঞানিক মহল গভীরভাবে শোকাহত— এ এক অপূরণীয় ক্ষতি!