‘শিখাময়ী’ মিস মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবেল। তিনিই স্বামী বিবেকানন্দের মানসকন্যা ভগিনী নিবেদিতা (Sister Nivedita)।
আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছিলেন নিজেকে লোকসেবায় নিবেদনের জন্য। এসেছিলেন ভারতের মেয়ে হয়ে। মার্গারেট যখন মাতৃগর্ভে, তখনই তাঁর মা ইজ়াবেল প্রার্থনা করেছিলেন যে, তাঁর সন্তান নিরাপদে ভূমিষ্ঠ হলে ঈশ্বরের কাজেই তাকে উৎসর্গ করবেন। সেই প্রার্থনা পূরণ হল ভারতে আগমনের সুবাদে।
১৮৬৭-র ২৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। ছোট থেকেই ধর্মজীবন ও মানুষের পাশে থাকার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতেন। তাঁর এই সুপ্ত শক্তিকেই জাগিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এক জন তরুণীর মূল্যবোধ বিকাশের পাশাপাশি তাঁকে স্বাবলম্বী করে তোলারও প্রশিক্ষণ দেন তিনি।
নিবেদিতার সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন শিক্ষয়িত্রী।
গিরিবালা ঘোষ ছিলেন বছর বাইশ-তেইশের এক বিধবা। বালিকা কন্যাকে নিয়ে মামার বাড়ির আশ্রিতা। গিরিবালার খুব ইচ্ছে ‘নিবেদিতার স্কুল’-এ পড়ার। কিন্তু সে কী করে সম্ভব? মেমসাহেবের স্কুল। হিন্দু বিধবার ম্লেচ্ছ সংসর্গ পরিত্যাজ্য। গিরিবালার দিদিমা গঙ্গায় স্নান করতে যান রোজ, নিবেদিতার স্কুলের পাশ দিয়ে। এক দিন শুনতে পেলেন সমবেত ভাবে মেয়েরা স্তবগান করছে। দিদিমার তরফে আপত্তি কিছুটা কমল। নিবেদিতার কানে গেল সে-কথা। তিনি সোজা চলে গেলেন গিরিবালার মামার কাছে। তাঁকে বললেন, মেয়েরা গঙ্গাস্নানে তো যায়, কালীঘাটে তো যায়! তা-ই না-হয় মনে করুন তিনি। ১১টা থেকে ৪টে তাঁকে দিন মেয়েটিকে। বলতে বলতে হাঁটু ভেঙে পায়ের কাছে বসে পড়লেন তিনি। সন্ত্রস্ত, বিব্রত মামা তাড়াতাড়ি অন্তঃপুর থেকে ভাগনিকে নিয়ে এসে নিবেদিতার হাতে সমর্পণ করলেন।
বাগবাজারের পল্লির গোঁড়ামিকে অস্বীকার করেননি নিবেদিতা (Sister Nivedita)। তাকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েই জ্ঞানের আলো জ্বালার চেষ্টা করলেন ঘরে ঘরে। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেই গুরুর দীক্ষায় ভারতবর্ষের জন্য নিবেদিত হয়েছেন। প্রখর বাস্তবজ্ঞানে বুঝে নিয়েছেন কোন শিক্ষা প্রয়োজন উত্তর কলকাতার পল্লির মেয়েদের জন্য। কালীপুজোর সন্ধ্যায় শ্রীশ্রীমা সারদা উদ্বোধন করলেন বিদ্যালয়ের। ফিতে কেটে ইউরোপীয় কায়দায় দ্বারোদ্ঘাটন নয়, রীতিমতো পূজার্চনা করে। প্রতি দিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সমবেত স্তবগান হত। ভাগ্যিস! তাই তো গিরিবালারা স্কুলে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছিলেন। পড়ানো হত বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস। ভূগোল-ইতিহাসের ক্লাসে জড়িয়ে থাকত ‘স্বদেশ’, ভারতবর্ষ। প্রসঙ্গত উঠে আসত পুরাণের নারী প্রসঙ্গ— সীতা, সাবিত্রী, সতী; উঠে আসত বীরাঙ্গনা কাহিনি— রানি ভবানী, রানি লক্ষ্মীবাই। নিবেদিতাই প্রথম মানবীবিদ্যা চর্চা শুরু করেছিলেন এ-দেশে। বাইরের শিক্ষাকে অন্তঃপুরে ঢোকানোর চেষ্টা করেননি, যেমনটি উনিশ শতকে হচ্ছিল কোথাও কোথাও। বরং অন্তঃপুরকে প্রসারিত করেছিলেন বাইরের দিকে।
আরও পড়ুন- নক্ষত্রপতন
তেঁতুলবিচি দিয়ে যোগ-বিয়োগ শিখত মেয়েরা, শিখত জোড়-বিজোড়ের অঙ্ক। মেয়েদের শরীরচর্চার দিকে তাঁর নজর ছিল। স্কিপিং করানোর জন্য নিজের গাউনের দড়ি পর্যন্ত খুলে দিতেন। নিজে ব্যায়াম শেখাতেন। কেউ কুঁজো হয়ে বসলে ধরে সোজা করে দিতেন। সেই যুগে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে রক্তের ফোঁটার মধ্যে জীবাণু চেনাতেন তিনি। আর একাদশীর দিন বিশেষ যত্ন নিতেন বিধবা ছাত্রীদের।
কেবল আধ্যাত্মিক পথে নয়, সমাজকর্মের পথটি ছাড়া যে সমাজের কল্যাণের উপায় নেই, স্বামী বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতা দুই জনেই নিজেদের জীবনের মধ্য দিয়ে সেই বার্তা দিয়ে গিয়েছেন। আরও একটি ভাবার বিষয় আছে। কেবল আধ্যাত্মিকতা ও সমাজকর্মও নয়। নিবেদিতা ভারতের বিজ্ঞানসাধনার গুরুত্বও বিশেষ রকম অনুধাবন করতেন। বাস্তবিক, আধ্যাত্মিক ও বিজ্ঞানসাধনা, এই দুই জীবনের মধ্যে যে দূরত্ব নেই, বরং সঙ্গতিই আছে, নিবেদিতা একাই এই বিরাট সত্যের স্মারক।
জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর মিত্রতার কথা বহুজ্ঞাত। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রেই হয়তো নিবেদিতা স্পষ্ট দেখতে পান, বিজ্ঞানচর্চা ছাড়া ভারতীয় সমাজের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ পাওয়া সম্ভব নয়। পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানচর্চার মূল্য বিরাট, বুঝেছিলেন নিবেদিতা। তাঁর মতো মানুষের কাছে জাতীয় গৌরব কোনও ফাঁপা রাজনীতির বুলি ছিল না। ঐতিহ্যের আধুনিকতায় জাতীয় বোধকে জারিয়ে নিতেন তিনি। তাই তাঁর বিরাট হৃদয়ে কেবল বিজ্ঞানীর জন্য আশ্রয় ছিল না, ছিল শিল্পকলাসাধকদের জন্যও। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু দুই শিল্পীই তাঁর সান্নিধ্যে এসে উৎসাহ পেতেন। অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “তাঁর কাছে গিয়ে কথা বললে মনে বল পাওয়া যেত।” বোস ইনস্টিটিউটে নিবেদিতার মর্মরমূর্তিটি নন্দলাল বসুর আঁকা ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ ছবি অনুসারেই নির্মিত। সে-মূর্তি যেন আজও একাকী আলোকবর্তিকার মতো আগ্রহী কর্মসাধকের পথপ্রত্যাশী।
১৯০২ সালের ৪ জুলাই। শুক্রবার। বেলুড় মঠে সন্ধ্যায় মন্দিরের প্রার্থনার সময় স্বামীজি তাঁর নিজের ঘরে ধ্যানাসনে বসে রাত ৯টায় শান্তভাবে মহাসমাধি লাভ করেন। স্বামী সারদানন্দ নিবেদিতাকে লিখে পাঠালেন, ‘দি এন্ড হ্যাজ কাম, স্বামীজি হ্যাজ স্লেপ্ট লাস্ট নাইট অ্যাট নাইন ও’ক্লক। নেভার টু রাইজ এগেন’। বেলুড় মঠে পৌঁছেই নিবেদিতা সোজা উঠে গেলেন দোতলায় স্বামীজির ঘরের দিকে। ঘরে তখন বেশি লোকজন নেই। স্বামীজির দেহটি মেঝেতে শায়িত হলুদ রঙের ফুলমালা আচ্ছাদিত হয়ে। মানসকন্যা স্বামীজির শিয়রের কাছে বসে পড়েন। নয়নে অবিরল অশ্রুধারা, মুখে কোনও কথা নেই। আবেগ-আকুল কম্পিত হাতে তুলে নেন গতপ্রাণ স্বামীজির মাথাটি। শেষকৃত্য সমাপনের নির্দিষ্ট স্থান বিবেকানন্দ নিজেই চিহ্নিত করেছিলেন মহাপ্রয়াণের কিছু দিন আগে, তাঁর প্রিয় বেলগাছের কাছে অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গায়। চিতাগ্নি প্রজ্বলিত হল। জি.সি’ অর্থাৎ নাট্যকার ও মহাকবি গিরিশচন্দ্রের বিলাপ, “নরেন, তুমি তো ঠাকুরের ছেলে, ঠাকুরের কোলে গিয়ে উঠলে। আর আমি বুড়ো মানুষ, কোথায় তোমার আগে যাব, তা না হয়ে আজ আমাকে দেখতে হচ্ছে তোমার এই দৃশ্য !” এ কথা শোনামাত্র নিবেদিতা (Sister Nivedita) শোক চেপে রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে উঠে স্বামীজির প্রজ্বলিত চিতাগ্নির পাশে প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন।
এরপর নিবেদিতার বাকি জীবন যেন অগ্নিশিখাই। মানবসেবার পুণ্যব্রতে। ভগিনী নিবেদিতা বলতেন, ‘প্রেমের জন্যেই প্রেম, কর্মের জন্যেই কর্ম…’। ভারতের সেবাব্রতে তাঁর দুর্নিবার আত্মত্যাগ এই অনুভবকে সত্য করে তুলেছিল।