সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়: কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী। ধন্য ত্রয়োদশী। তার থেকে ধনত্রয়োদশী। চলতি কথায় ধনতেরাস। দীপাবলি বা দেওয়ালির দু’দিন আগের পর্ব। কালীপুজোর আগে তাই সোনার দোকানে দোকানে ভিড়। সেই ভিড়ে বাঙালির সংখ্যা কম নয়।
এখন প্রশ্ন হল : এতদিন বঙ্গবাসী ধনতেরাসে মাথা না ঘামালেও এখন এই ভিড়ে বাঙালি এত উৎসাহী কেন?
এর প্রধান কারণ, বঙ্গজরা মূলত কৃষিজীবী। ধান্যে বসতে লক্ষ্মী। এটাই ছিল বাঙালির বিশ্বাস। গোলা ভরা ধানেই সম্পদের দেবীর অধিষ্ঠান দেখেছে। ক্ষেত্ভরা ফসলে সংসারে শ্রী চিনেছে। ফলে, এ দেশে নবান্ন বা ফসল কেন্দ্রিক পার্বণ বা উৎসব যত আছে, ধাতব সম্পদ ঘিরে উদ্দীপনা তার এক তৃতীয়াংশও ছিল না। বাংলায় সম্পন্ন কৃষক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল সমধিক, বিত্তবান ব্যবসায়ী হওয়ার বাসনা সেভাবে ছিল না। ঘরের পাশের ক্ষেতে লাঙল চালিয়েই বাঙালি খুশি ছিল, দূরদেশে বণিক হতে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা দুর্বৃত্তের উপদ্রবের মোকাবিলা করতে ততটা বাগ্রতা ছিল না তাদের।
আরও পড়ুন-প্রকৃতি সংরক্ষণে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার পিছনে ভারত, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মুখ পুড়ল কেন্দ্রের
দ্বিতীয় কারণ, ছোঁয়াছুঁয়ি জাতপাত বর্ণাশ্রম প্রথা। বল্লাল সেনের আমল থেকে সম্প্রদায় হিসেবে বাংলার সামাজিক অবস্থানে মোটেই উঁচু জায়গায় ছিল না। ব্রাহ্মণের চিত্ত তাই সোনার বেনের বিত্তের থেকে বাঙালির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খানিকটা এই কারণেই এই বাংলায় দ্বারকানাথ ঠাকুর যত আলোচিত, বা প্রণম্য, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মান্যতা তাঁর পৌত্র রবীন্দ্রনাথের। এই কারণেই সরস্বতী পুজো বাংলায় ধনতেরাসের চেয়ে অনেক অনেক বেশি উদযাপিত হয়।
আর একটি কারণ, ভারতবর্ষের বাকি অংশ, বিশেষত হিন্দি-হিন্দুত্বের কেন্দ্র দিল্লির থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার ঐতিহাসিক প্রবণতা। অষ্টম শতাব্দীতে যখন সারা ভারতবর্ষ বৌদ্ধ ধর্মকে পরিত্যাগ করে আদি শঙ্করাচার্যের ডাকে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের জয়জয়কার করছে, ঠিক তখনই পাল রাজাদের মতো এক বৌদ্ধ বংশীয়দের বাংলা সিংহাসনে বসাল তিনশো বছরের জন্যে। তাও আবার প্রাথমিক ভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। গোপালের সিংহাসনের প্রসঙ্গটি স্মরণীয়। আবার ত্রয়োদশ শতাব্দী যখন দিল্লির দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুলতানদের কুরনিশ করতে ব্যস্ত, বাংলায় শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এক পৃথক স্বাধীন বঙ্গরাজ্য ঘোষণা করলেন। প্রায় নির্দ্বিধ চিত্তে। মোদি-শাহর জমানায় কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্বের কথা নাহয় বাদই দেওয়া গেল। বাঙালি দীপাবলির সময় ধুমধাম করে লক্ষ্মীর আরাধনা না করে দুর্গাপুজোর সাত দিন পর খুব শান্তভাবে প্রায় গোপনে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো করে। দীপাবলির বা দেওয়ালির সময় অন্যরা যখন সহস্র আলো জ্বালিয়ে গৌরবর্ণা দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করে শ্রী-সম্পদ চায়, তখন বাঙালি অমাবস্যার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঘোর কৃষ্ণবর্ণা দেবী কালীর পুজো করে শক্তি চায়। দেওয়ালিতে অন্য ভারতীয়রা সম্পূর্ণ নিরামিষ খায়, আর মাংস এবং রক্তবর্ণ জবাফুল ছাড়া বাঙালির কালীপুজো হয় না।
আরও পড়ুন-দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে গুগলের হার, ২৪০ কোটি পাউন্ড জরিমানা
অধিকাংশ ভারতীয়ের কাছে দেওয়ালির পিছনে আছে কৃষ্ণের নরকাসুর বধের কাহিনি, বাঙালির কালীপুজো এসেছে স্কন্দপুরাণে দেবী চণ্ডীর রক্তবীজ নিধনের সূত্র ধরে। রক্তবীজের প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে অসুরের জন্ম হয়ে চলেছিল, শেষে চণ্ডী ভয়ঙ্করী কালীমূর্তি ধরে সমস্ত রক্ত পান করলে দানবকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছিল। এক কথায়, আধ্যাত্মিক পরিসর থেকে রাজনৈতিক উঠোন, সবেতেই বাঙালির বিপ্রতীপ গমন। তাই ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে দেওয়ালির উৎসব যখন শুরু হয় ধনতেরস দিয়ে, তার পর চলে ছোটি দেওয়ালি, বড়ি দেওয়ালি, গোবর্ধন পুজো আর শেষ হয় ভাই দুজে, বাঙালি তখন ভূতচতুর্দশীতে চোদ্দো শাক খায়, রাত জেগে কালী পুজো করে, ভাই ফোঁটায় ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে যমের দুয়ারে কাঁটা দেওয়ার বাসনা জানায়।
এই সব কারণেই, অবাঙালিদের ধনতেরস নিয়ে মাতামাতির অংশীদার এতদিন বাঙালি সেভাবে হয়নি। কিন্তু সর্বভারতীয় লক্ষণ বাঙালি বিশ্বায়নের পর থেকেই আয়ত্ত করছে। বিয়েতে ‘সঙ্গীত’-এর চল হয়েছে। তেমনই ধনতেরাসে সোনা-রুপো কেনার ধুম বেড়েছে। চিত্তে উন্নত হওয়ার সমান্তরালে বিত্তে সমৃদ্ধিশালী হওয়ার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যাঁরা বিপ্লবটিপ্লব নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতেন, তাঁদের ও-সবের জন্যে আর সময় নেই। অতএব ধনতেরাসে নিয়ম মেনে একটু সম্পদ বাড়ালেও বা ক্ষতি কী?
ধর্ম যার যার, উৎসব তো সবার। তাই ধনতেরসে বাঙালি-অবাঙালি ভেদরেখা ক্রমশ মুছে যাচ্ছে।