রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আবার উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র সুকুমার রায়েরও বন্ধু। যদিও এই বন্ধুত্বটি ছিল অসমবয়সি। তরুণ বন্ধুটিকে বিশেষ পছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ। করতেন স্নেহও। কারণ সুকুমার ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। যেমন পড়াশোনায়, তেমনই সৃজনশীল কাজে। প্রেসিডেন্সি কলেজের স্নাতক। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে। দুই বিষয়ে অনার্স-সহ স্নাতক হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে ডুব দিয়েছিলেন সাহিত্যচর্চায়। মূলত তাঁর বিচরণ ছিল শিশুসাহিত্যে। ভারতীয় সাহিত্যে ‘ননসেন্স ছড়া’র প্রবর্তন করেন। ছড়া-কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন রম্যরচনা, প্রবন্ধ, নাটক। সম্পাদনা করেছেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকা।
সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। ১৮৮৭-র ৩০ অক্টোবর, কলকাতার এক দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ বংশীয় ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁদের আদিনিবাস বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার কটিয়াদি উপজেলার মসূয়া গ্রামে। বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলা। মসূয়াতে বসবাসের আগে তাঁর পূর্বপুরুষের আদিনিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত চাকদহে। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় তাঁর দুই ভাই। তিন বোন— সুখলতা, পুণ্যলতা ও শান্তিলতা। সাহিত্যানুরাগী পারিবারিক পরিবেশ, যা তাঁর মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করেছিল। পিতা ছিলেন শিশুসাহিত্যিক, বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও রায় চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের।
আরও পড়ুন-মার্কিন আইটি কোম্পানিতে এক ধাক্কায় ১৩০০ জন ছাঁটাই
উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। দীর্ঘদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। নাম দেন ‘মেসার্স ইউ. রয় অ্যান্ড সন্স’। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন সুকুমার। তিনি মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান। সেখানে আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তি নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে ফিরে আসেন কলকাতায়। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় উপেন্দ্রকিশোরের।
পিতা জীবিত থাকতে সুকুমার খুব বেশি লেখালিখি করেননি। পিতার মৃত্যুর পর ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। সুকুমারের হাত ধরে শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। আট বছর তিনি ‘সন্দেশ’ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ছোট ভাই এই কাজে তাঁর সহায়ক ছিলেন। পরিবারের অনেক সদস্যই ‘সন্দেশ’-এ লিখতেন। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালীন সুকুমার লিখেছেন অজস্র রচনা। তাঁর লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে।
তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘আবোল তাবোল’ বইটি। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপত্র ছিল ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তাঁর ‘আবোল তাবোল’ ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মানডে ক্লাব নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন। মানডে ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। মজার ছড়ার আকারে এই সাপ্তাহিক সভার কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র রচনা করেছিলেন সুকুমার। সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মূলত উপস্থিতির অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষণা ইত্যাদি।
সুকুমারের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল অপরিসীম। ইংলান্ডে থাকাকালীন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানের বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তখনও রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাননি। সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কাজ ছাড়াও সুকুমার ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীর এক তরুণ নেতা। ‘অতীতের কথা’ নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসকে সরল ভাষায় প্রকাশ করে। কাব্যটি একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ওই সময়ের সবথেকে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম। তাঁর ব্রাহ্মসমাজের সভাপতিত্বের প্রস্তাবের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন সুকুমার। সুপ্রভা রায় ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী।
মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের জীবন। ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন সুকুমার রায়। সেই সময় এই রোগের কোনও চিকিৎসা ছিল না। মৃত্যুযন্ত্রণা স্পর্শ করতে পারেনি তাঁর আনন্দময় সত্তাকে। মৃত্যুর দোরগোড়ায় বসেই তিনি লিখেছিলেন ‘ছুটলে কথা থামায় কে/ আজকে ঠেকায় আমায় কে’। জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়েছিলেন তাঁর এই তরুণ বন্ধুর মৃত্যুকালীন প্রশান্তি দেখে।