এঁদের কেউ অনায়াসে ডাক্তার হতে পারতেন, কেউ-বা ইঞ্জিনিয়ার। কেউ-বা বেসরকারি সংস্থায় উচ্চপদে নিজেকে নিযুক্ত করতে পারতেন। এঁদের চোখের সামনে ছিল বিলাসবহুল স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্ন দেখার এই ফাঁদে তাঁরা পা দেননি। বরং নিজেরা তৈরি করেছেন স্বপ্ন দেখানোর পরিসর। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম ভারত জুড়ে প্রায় সব জায়গাতেই এঁরা হয়ে উঠেছেন সংবাদের উপেক্ষিত অণুচ্ছেদ।
প্রণব মালাকার
ভারতের কচ্ছপ-মানুষ
আসামের প্রণব মালাকার। প্রকৃতি তাঁর ভালবাসার লীলাভূমি। কচ্ছপের প্রতি মালাকারের রয়েছে মুগ্ধতা ছোটবেলা থেকেই। তিনি তাঁর বাড়ির কাছে ছোটবেলায় একটি পুকুরে খেলতে যেতেন, কচ্ছপদের দেখতেন এবং তার আচরণ সম্পর্কে শিখতেন। কখনও কখনও ছেলেবেলার সেই কৌতূহলী মন নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন কচ্ছপদের সাঁতার কাঁটা দেখতে। কীভাবে দিনের পর দিন কচ্ছপরা রোদে পুড়ত, তা দেখে তিনি ভাবতেন। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কচ্ছপদের সম্পর্কে সমব্যথী হয়ে ওঠেন। অনুভব করেন কচ্ছপদের বিপদগুলো সম্পর্কে। সঙ্কল্প নেন যেভাবেই হোক এই দুর্লভ প্রজাতির কচ্ছপদের সংরক্ষণে তিনি জীবন উৎসর্গ করবেন।
ভারতের প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ তাঁকে ‘কচ্ছপ-মানুষ’ হিসেবেই চেনেন। কেউ কেউ বলেন তাঁকে ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ। হাজো, অসম, ভারতের হাইগ্রীব মাধবমন্দির এবং তার আশপাশের পুকুরগুলো দেখভাল করার দায়িত্বে ছিলেন প্রণব। এই পুকুরেই ঘুরে বেড়ায় কালো সফট সেল কচ্ছপ। এছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপের বিচরণের জলাভূমি হয়ে ওঠে এই পুকুরগুলো। এই কচ্ছপগুলোকে বিলুপ্ত-প্রায় হিসাবে ঘোষণা করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (IUCN)।
পরিবেশের ভারসাম্য রাখার ক্ষেত্রে কচ্ছপের ভূমিকা অপরিসীম। কচ্ছপ যে শুধুমাত্র জলের পোকামাকড় এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে জলকে পরিষ্কার, স্বচ্ছ এবং স্বাস্থ্যকর রাখতে সাহায্য করে তা নয় কুমির এবং সাপের মতো বড় বড় শিকারিদের জন্য কচ্ছপ নিজেরাই খাদ্য হয়ে ওঠে। আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংস্কৃতিক ভাবে কচ্ছপের গুরুত্ব রয়েছে। হিন্দু ধর্মে কচ্ছপকে সম্মান প্রদান করা হয়। মাঝে মাঝে ধর্মীয় শিল্পী এবং সাহিত্যেও তাদের দেখা মেলে। অসমিয়া ঐতিহ্যবাহী ওষুধ নির্মাণের ক্ষেত্রেও এই কচ্ছপকে ব্যবহার করা হয়। বছরের পর বছর ধরে মালাকার একা লড়াই করে চলেছেন এই কচ্ছপদের রক্ষা করার জন্য। এই লড়াইয়ে বিভিন্ন সময়ে তাঁকে হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছে। কচ্ছপ সংরক্ষণে মালাকারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভারতের প্রকৃতি এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে।
কী না করেছেন তিনি কচ্ছপ বাঁচানোর জন্য। ২০০৫ সালে হায়াগ্রীব মাধব মন্দিরের পুকুরে কালো কচ্ছপ পুষতে শুরু করেন। তৈরি করেন একটি কৃত্রিম ইনকিউবেশন সেন্টার। সেখানে ডিম ও বাচ্চাদের বড় করে বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই এলাকার মানুষের মধ্যে তিনি কচ্ছপ সংরক্ষণের কথা বোঝানোর চেষ্টা করেন। সম্পূর্ণ একার প্রচেষ্টায় ১০ হাজারেরও বেশি কালো সফট সেল কচ্ছপ পালন করেন। টারটেল সারভাইভাল অ্যালায়ন্স ২০১৭ সালে টার্টেল হিরো আওয়ার্ড দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করেছে। ভারত সরকারের পদ্মশ্রী সম্মান জুটেছে তাঁর মুকুটে। মালাকারের জীবনে এসব প্রাপ্তির থেকে কচ্ছপের প্রতি ভালবাসাই অনেকটা শান্তি এনে দেয়।
আরও পড়ুন-ভাইয়ের কপালে…
দেবাদিত্য সিনহা
ফোকাস মির্জাপুর
এবার মির্জাপুরের আর এক নায়কের গল্প। কলকাতায় বেড়ে ওঠেন। দেবাদিত্য সিনহা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক হন এবং বারাণসীর বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি (বিএইচইউ) থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানের উচ্চপাঠ নেন। এই সময়েই তিনি মির্জাপুরের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করেন প্রথম ইকো ক্লাব ‘ইকো ওয়ান’ ২০১১-তে ‘এনভায়রনমেন্ট ইক্যুইটি অ্যান্ড জাস্টিস পার্টনারশিপ’ ফেলোশিপ, গবেষণার কাজ করেন। পরের বছর তৈরি করেন বিন্ধিয়ান ইকোলজি অ্যান্ড ন্যাচারাল হিস্ট্রি ফাউন্ডেশন।
সিনহা মির্জাপুরের জলপ্রপাতগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সফল হয়েছেন। যার জন্য তিনি ‘দ্য সিটি আই ওয়ান্ট’ ক্যাম্পেইনের অধীনে ‘ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ’ দ্বারা ‘সেরা গল্পের পুরস্কার’ পেয়েছিলেন। ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ট্রপিক্যাল ফরেস্ট রিস্টোরেশনেও তাঁর দক্ষতাকেও কাজে লাগানো হয়েছে। EKO-এনার্জি নেটওয়ার্কের একজন সক্রিয় সদস্য হয়েও উত্তরাখণ্ডর গঙ্গা টুডে-এর ট্রাস্টি হয়েছেন। কাজ করেছেন ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া, আর্থ ম্যাটারস ফাউন্ডেশন এবং দুলীপ মাথাই নেচার কনজারভেশন ট্রাস্টের মতো সংস্থাগুলিতে।
মির্জাপুর জেলায় প্রস্তাবিত একটি ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা-ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত ছাড়পত্রের বিষয়ে তাঁর চ্যালেঞ্জের ফলে জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনাল ছাড়পত্র প্রত্যাহার করে নেয় এবং বন পুনরুদ্ধারের আদেশ দেয়। একই সঙ্গে তিনি গঙ্গা নদী, কাইমুর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ইএসজেড এবং বর্তমানে নিষ্পত্তি করা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির নির্গমণ মান সম্পর্কে মামলা করেন। এছাড়া একজন সহানুভূতিশীল পরিবেশবাদী হিসাবে তিনি উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডে বাঁধ, কয়লা এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পর জন্য বিভিন্ন পরিবেশ বাঁচানোর মামলাগুলির জন্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি করতে অন্য কর্মীদের উৎসাহিত করেছেন।
এখন সিনহার ফোকাস মির্জাপুরের বনরক্ষা এবং ওই অঞ্চলে একটি ভাল্লুক সংরক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করা। তিনি প্রকৃতিকেই তাঁর প্রেম বলে মনে করেছেন, তাই পরিবেশ আর প্রকৃতি বাঁচানোর লড়াইয়ে জীবনের চিত্রনাট্যটা বদলে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন-ঐতিহ্যের কালী-দৌড়ে মালদহে দেখা গেল সম্প্রীতির ছবি
বিচিত্রানন্দ বিস্বাল
অলিভ রিডলের পরিত্রাতা
একেকজন মানুষের শখ একেকরকম। কেউ কেউ ভালবাসেন প্রাণীদের নিয়ে বেঁচে থাকতে। কেউ কেউ বিভিন্ন প্রাণীদের সঙ্গে একসাথে দিন কাটান বলেও শোনা যায়। গুন্ডালাবা গ্রামের সাঁইত্রিশ বছরের বিচিত্রানন্দ বিস্বাল-এর গল্পও ঠিক তেমনই।
ওড়িশার এই গ্রামটি বঙ্গোপসাগরে তীরে অবস্থিত। খুব কম লোকই এতদিন সেই গ্রামের কথা জানত। কিন্তু বিচিত্রানন্দের কাণ্ডকারখানায় বিখ্যাত হল তাঁর গ্রাম। অলিভ রিডলে নামের একধরনের বিরল প্রজাতির কচ্ছপ সংগ্রহ করেন তিনি। মাত্র দুশো মিটারের মধ্যে সমুদ্রের তীর হওয়ায়, ছোট থেকেই বিচিত্রানন্দ স্কুল থেকে সেখানে চলে যেতেন। সেখান থেকেই এই প্রজাতির কচ্ছপের সাথে তার প্রেম শুরু। কিন্তু একদিন কয়েক হাজার অলিভ রিডল টার্টেলকে মৃত অবস্থায় দেখে তিনি এদের সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এই অঞ্চল এ ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদের প্রাচুর্য দেখা যায়। ১৯৯৯ সালের সাইক্লোনে ওড়িশার এই গ্রামটির অধিকাংশ জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজের হাতে গ্রামকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করেন তিনি। নিজে কচ্ছপ সংরক্ষণ করার পাশাপাশি তিনি গ্রামবাসীদেরও প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে উদ্ধুদ্ধ করেন। ফলে গ্রামে কমে সামুদ্রিক প্রাণীদের হত্যার ঘটনা।
বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবী ক্রমশ ধ্বংসের মুখে এগিয়ে চলেছে। জল থেকে স্থল সব জায়গার প্রাণীদের বেঁচে থাকা ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ওড়িশার ঐতিহ্য তার সমুদ্র ও বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী। তাই সেখানকার এই বিরল প্রজাতির কচ্ছপ সংগ্রহ করে তিনি আগামী প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে চান।
শশাঙ্ক দলভি
পাখিদের গুরুদেব
মাত্র চার বছর বয়সে দাদার কাছ থেকে একটি বই উপহার পেয়েছিলেন। বিষয় ছিল স্তন্যপায়ী প্রাণী। ৭ বছর বয়সে স্কুল টিচার যখন সব চেয়ে প্রিয় প্রাণী সম্পর্কে লিখতে বলেছিলেন তখন সেই ছোট্ট ছেলেটি লিখেছিল এশিয়ান হাতির কথা। ক্লাসের বাকি সবাই লিখেছিল কুকুর এবং বেড়ালের কথা। পাখি ভালবাসতে শুরু করেন সেদিন যেদিন তার দাদি প্রথম খাঁচায় পাখি নিয়ে এসছিলেন। পরে সেলিম আলি এবং লায়েক ফুটহালির লেখা ‘কমন বার্ডস’ বইটি পড়ার পর শশাঙ্ক বুঝতে পারেন ওটা ছিল বুলবুল। খাঁচায় পাখি দেখে খুশি না হয়ে ছুটির দিনগুলোতে শশাঙ্ক বেরিয়ে পড়তেন সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্ক এবং অন্যান্য পাখিরালয়ে। এই শশাঙ্ক ডলবি তৈরি করেছেন অভয়ারণ্য প্রকৃতি ফাউন্ডেশন। ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির সঙ্গে শশাঙ্কের সম্পর্ক ২০১০ সাল থেকে। নিবিড় বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ সারা বিশ্বে বন্যপ্রাণী, জীববিজ্ঞানী এবং সংরক্ষণবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শিখেছেন সেই সময় থেকে। তিনি শিখেছেন ড. কৃতী কারান্থ এবং ড. উরলাশ কারান্থ-এর কাছে। কর্নাটকের পশ্চিম ঘাটের ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে কফি, রাবার এবং কৃষি বন সংরক্ষণ করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই উত্তর-পূর্ব ভারত ছিল শশাঙ্কের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু হয় যখন তিনি ইগলনেস্ট বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে কাজ করেন। সেটাই ছিল উত্তর-পূর্বের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সূচনা। তারপর অরুণাচলপ্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয় এবং আসামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন সংস্থা এবং বিজ্ঞানীর সঙ্গে কাজ করেছেন শশাঙ্ক। ২০১৪-র জুলাই মাসে পশ্চিম ঘাটে একটি জীব বৈচিত্র্যর সমীক্ষা করার সময় শশাঙ্ক তাঁর জীবনের আসল উৎসাহ খুঁজে পান। শশাঙ্ক তৈরি করেন ভিএনএনওয়াইএ (VNNYA) নামের নতুন পাখির অ্যাপ শুরু করেন। এই ভিএনএনওয়াইএ (VNNYA) এমন একটা ইন্টারফেস যেখানে পুরোনো এবং নতুন পাখি সম্পর্কে জানা যায়। জানা যায় পাখির দুনিয়ার স্টেজ হোল্ডারদের খবরাখবর। আসলে এই অ্যাপটি প্রকৃতি সংরক্ষণের সুবিধার জন্যে ব্যবহার করা হয়। শশাঙ্ক ডালভি প্রকৃতিকে ভালবাসার একজন মানুষ। ২০১৭-র অভয়ারণ্য ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিস আওয়ার্ড তার জীবনের দিক পাল্টে দেয়। ব্যক্তিগত ভাবে শশাঙ্ক ১১৯০টির মতো এভিএন প্রজাতিকে দেখেছেন তাঁদের নথিভুক্ত করেছেন। শশাঙ্কের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় কেটেছে নাগাল্যান্ডের ডোয়াং-এ। ডোয়াং জলাধারের চারপাশে বড় ধরনের পাখি শিকার নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। তিন সঙ্গী বানু হারালু, রামকি শ্রীনিবাস এবং রোকোহেবি কুওৎসু। এদের নিয়ে তদন্তে নেমেছিলেন শশাঙ্ক। তদন্তে নেমে তাঁরা হতবাক। দেখেন হাজার হাজার আমুর ফ্যালকনের গণহত্যা। হত্যাকারী শিকারদের কাছে পৌঁছে যায় শশাঙ্করা। এটা ছিল শশাঙ্কের লড়াইয়ের সবচেয়ে কঠিন পর্ব।
ড. পূর্ণিমা দেবী বর্মন
হারগিলা আর্মির স্রষ্টা
ড. পূর্ণিমা দেবী বর্মন তৈরি করেছেন হারগিলা আর্মি। পেয়েছেন জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পরিবেশ সম্মান। তিনি পাখি উদ্ধার ও সংরক্ষণে নিবেদিত ১০ হাজার মহিলাদের নিয়ে হারগিলা আর্মি প্রতিষ্ঠা করেছেন। পূর্ণিমা দেবী বর্মনের জীবনের গল্প অনেকটা সেলুলয়েডের মতো। একজন বন্যপ্রাণী সংরক্ষক হয়ে তিনি মানুষকে প্রাকৃতিক স্ক্যাভেঞ্জার হিসাবে পাখির মূল্য বোঝানোর চেষ্টা করছেন। তার বিশ্বাস— একজন সংরক্ষণবাদী হওয়ার জন্য কোনও ডিগ্রির প্রয়োজন নেই।
পাঁচ বছর বয়সে, বর্মনকে ভারতের অসম রাজ্যের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে তাঁর দাদির সাথে বসবাসের জন্য পাঠানো হয়েছিল। তাঁর বাবা-মা এবং ভাইবোনদের থেকে বিচ্ছিন্ন, মেয়েটি অসহায় হয়ে ওঠে। তাঁকে বিভ্রান্ত করার জন্য, বর্মনের দাদি, একজন কৃষক, তাকে পাখিদের সম্পর্কে শেখানোর জন্য তাঁকে কাছাকাছি ধানখেত এবং জলাভূমিতে নিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন।
“আমি সারস এবং অন্যান্য অনেক প্রজাতি দেখেছি। সে আমাকে পাখির গান শিখিয়েছে। সে আমাকে ইগ্রেটস এবং স্টর্কসের জন্য গান গাইতে বলেছিল। আমি পাখিদের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম,” বলেছেন বর্মন, একজন বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানী যিনি তাঁর কর্মজীবনের অনেকটাই বিপন্ন বৃহত্তর অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক, বিশ্বের দ্বিতীয় বিরল সারস প্রজাতিকে বাঁচাতে উৎসর্গ করেছেন৷
প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর, বর্মন বৃহত্তর অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্কের উপর পিএইচডি শুরু করেন। কিন্তু, তিনি যে পাখিদের সাথে বড় হয়েছিলেন তাদের অনেকগুলি আর নেই দেখে, তিনি প্রজাতিটিকে বাঁচিয়ে রাখার দিকে মনোনিবেশ করার জন্য তাঁর থিসিস বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ২০০৭ সালে সারস রক্ষার জন্য তার প্রচারাভিযান শুরু করেছিলেন, আসামের কামরূপ জেলার গ্রামগুলিতে ফোকাস করে যেখানে পাখিগুলি সবচেয়ে বেশি ছিল এখানে, সারসকে মৃতদেহের উপর ময়লা ফেলার জন্য, তাদের বাসা বাঁধার গাছে হাড় এবং মৃত প্রাণী আনার জন্য নিন্দিত করা হয়, যার মধ্যে অনেকগুলি মানুষের বাগানে জন্মায় এবং দুর্গন্ধযুক্ত বিষ্ঠা জমা করে। প্রাণীগুলি প্রায় ৫ ফুট (১.৫ মিটার) লম্বা হয় যার ডানা ৪ ফুট (২.৪ মিটার) পর্যন্ত লম্বা হয় এবং গ্রামবাসীরা প্রায়শই তাদের মধ্যে সারস বাসা বাঁধার চেয়ে তাদের বাড়ির উঠোনে গাছ কাটতে পছন্দ করে। “পাখিটিকে সম্পূর্ণ ভুল বোঝানো হয়েছিল। তাদের একটি অশুভ লক্ষণ, দুর্ভাগ্য বা রোগের বাহক হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল,” বর্মন বলেছিলেন, যিনি বাসা বাঁধার উপনিবেশগুলিকে বাঁচানোর চেষ্টা করার জন্য নিজেকে উপহাস করেছিলেন।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড এবং ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি)-এর ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বন্যপ্রাণী প্রজাতির জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি। এই দ্বন্দ্ব বাস্তুতন্ত্রের উপর অপরিবর্তনীয় প্রভাব ফেলতে পারে যা পৃথিবীর সমস্ত জীবনকে সমর্থন করে। ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের উপর জাতিসংঘের দশক মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্ক পুনঃভারসাম্য করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে একত্রিত করার একটি সুযোগ দেয়।
সারসকে রক্ষা করার জন্য, বর্মন জানতেন যে তাঁকে পাখি সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করতে হবে, যা স্থানীয়ভাবে অসমিয়া ভাষায় ‘হারগিলা’ নামে পরিচিত (অর্থাৎ ‘হাড় গিলে ফেলা’) এবং তাকে সাহায্য করার জন্য গ্রামের মহিলাদের একটি দলকে একত্রিত করেছিল।
বর্মন মহিলাদের তাঁত ও সুতা সরবরাহ করতেও সাহায্য করেছেন যাতে তারা হারগিলার মোটিফ দিয়ে সজ্জিত বস্ত্র তৈরি এবং বিক্রি করতে পারে। এই উদ্যোক্তা শুধুমাত্র পাখি সম্পর্কে সচেতনতাই ছড়ায় না, এটি মহিলাদের আর্থিক স্বাধীনতা, তাদের জীবিকা বৃদ্ধিতে এবং সারসকে বাঁচাতে তাদের কাজে গর্ব ও মালিকানার অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে অবদান রাখে।
বর্মন তাঁর সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে, কামরূপ জেলার দাদারা, পাচারিয়া এবং সিঙ্গিমারি গ্রামে বাসার সংখ্যা ২৮ থেকে বেড়ে ২৫০-এরও বেশি হয়েছে, যা এটিকে বিশ্বের বৃহত্তর অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্কের সবচেয়ে বড় প্রজনন উপনিবেশে পরিণত করেছে। ২০১৭ সালে, বর্মন বিপন্ন পাখিদের ডিম ফুটানোর জন্য লম্বা বাঁশের বাসা তৈরি করতে শুরু করে। তার প্রচেষ্টাগুলি কয়েক বছর পরে পুরস্কৃত হয়েছিল যখন এই পরীক্ষামূলক প্ল্যাটফর্মগুলিতে প্রথম বৃহত্তর অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক ছানাগুলি বের করা হয়েছিল।
বর্মনের জন্য, অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ককে রক্ষা করার অর্থ হল তাদের আবাসস্থল রক্ষা করা এবং পুনরুদ্ধার করা।
হারগিলা আর্মি সম্প্রদায়গুলিকে সারস বাসা বাঁধার গাছ এবং জলাভূমি এলাকায় ৪৫ হাজার চারা রোপণ করতে সাহায্য করেছে এই আশায় যে তারা ভবিষ্যতে সারস জনসংখ্যাকে সমর্থন করবে। আগামী বছর আরও ৬০ হাজার চারা রোপণের পরিকল্পনা রয়েছে। মহিলারা নদীর তীরে এবং জলাভূমিতে জল থেকে প্লাস্টিক অপসারণ এবং দূষণ কমাতে পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালায়।
“পূর্ণিমা দেবী বর্মনের অগ্রণী সংরক্ষণ কাজ হাজার হাজার নারীকে ক্ষমতায়ন করেছে, উদ্যোক্তা তৈরি করেছে এবং জীবিকা উন্নত করেছে এবং বৃহত্তর অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ককে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে এনেছে,” বলেছেন ইউএনইপি-র নির্বাহী পরিচালক ইনগার অ্যান্ডারসেন। “ড. বর্মনের কাজ দেখিয়েছে যে মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব সবার উপকারে সমাধান করা যেতে পারে। জলাভূমির ক্ষতির ক্ষতিকারক প্রভাব তুলে ধরে যে প্রজাতিগুলি তাদের খাওয়ায় এবং প্রজনন করে, তিনি আমাদের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং পুনরুদ্ধারের গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দেন।’
বর্মন বলেছেন যে তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কারগুলির মধ্যে একটি হল গর্ববোধ যা হারগিলা সেনাবাহিনীতে তৈরি করা হয়েছে এবং তিনি আশা করেন তাঁদের সাফল্য পরবর্তী প্রজন্মের সংরক্ষণবাদীদের তাঁদের স্বপ্ন অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করবে। ‘পুরুষশাসিত সমাজে সংরক্ষণে কাজ করা একজন মহিলা হওয়া চ্যালেঞ্জিং কিন্তু হারগিলা আর্মি দেখিয়েছে কীভাবে নারীরা একটি পার্থক্য করতে পারে’— তিনি বলেন।
শৈশবে, পূর্ণিমা দেবী বর্মন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বেড়ে ওঠেন, তাঁর দাদির কাছে প্রকৃতির কাছ থেকে শিখেছিলেন। তাঁরা স্থানীয় পাখিদের সম্পর্কে ঐতিহ্যগত গান গাইতে উপভোগ করত এবং তার প্রিয় পাখি, সারস, তার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে।
প্রকৃতির প্রতি পূর্ণিমা দেবী বর্মনের প্রেম শুরু হয়েছিল তাঁর দাদি এবং কলেজের অধ্যাপকদের হাত ধরে। প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার পর তিনি আরণ্যক নামে একটি বন্যপ্রাণী এনজিওতে যোগ দেন। তাঁর স্বামী এ-কাজে তাকে সমর্থন করেছিলেন। দুই কন্যার জন্মের পর, তিনি তাঁর পিএইচডি করার জন্য একাডেমিয়ায় ফিরে আসেন। কিন্তু একটি গ্রাম থেকে দুর্দশার ডাক এলে মাঠে ফিরে আসেন।
একদিন এক গ্রামবাসী সারস বাসা-সহ একটি গাছ কেটে ফেলেছিল। সরসের বাচ্চারা বিপদে পড়েছিল। এই ঘটনাটি পূর্ণিমা বুঝতে পেরেছিল। সে তার অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার ছেড়ে বিপন্ন প্রজাতি রক্ষা করতে এবং পরিবেশের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সক্রিয়ভাবে কাজে নেমেছিল।
একজন সুশিক্ষিত নারী হিসেবে সংগ্রাম করছেন। পূর্ণিমা বুঝতে পেরেছিলেন গ্রামীণ নারীদের সমস্যাগুলো। তিনি তাঁদের সমাজ এবং পরিবেশে তাঁদের একত্রিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-কথা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, ৬ মাসে তৈরি চালসার রাস্তা
কৌস্তব শর্মা
তুষার চিতাবাঘের বন্ধু
যাঁরা নিজের জন্যে বাঁচেন না দেশের জন্যে তেমনই একজন আঞ্চলিক পরিবেশবিদ কৌস্তব শর্মা। সবচেয়ে কঠিন, দুর্গম, অঞ্চলে কাজ করেছেন কৌস্তব। তাঁর কাজ মূলত তুষার চিতাবাঘ নিয়ে। তিনি লক্ষ্মী রমণের সঙ্গে চিতাবাঘ নিয়ে কাজ করেছেন। তবে প্রথমে তাঁর আগ্রহে তুষার চিতাবাঘ ছিল না। ক্যারিয়ারের শুরুতে কৌস্তব এমন কিছু পরামর্শদাতা অভিভাবক পেয়েছিলেন যাঁরা তাঁকে ইঞ্জিনিয়ার হতে বাধ্য করেননি। তাঁর জীবনের দিশা বেঁধে দিয়েছিলেন ড. রঘু চুন্দাওয়াত। প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন কৌস্তবের সঙ্গে তুষার চিতাবাঘের। পান্না টাইগার রিজার্ভে তিনি যখন বাঘ নিয়ে পড়াশুনা করছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন কৌস্তব। তার লাদাখ, জিনজিয়াং (চিন) এবং সরিচাট (কিরঘিজস্তানের) থেকে গল্প এবং ছবি কৌস্তবকে মুগ্ধ করেছে। কৌস্তবকে অনুপ্রাণিত করেছে ড. আসাদ রাহমানি। চার শিংওয়ালা হরিণের গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁকে সাহায্য করেছে। মধ্যপ্রদেশের দুই বনকর্তা গিরিধার কিনহাল এবং মনোজ মিশ্র না থাকলে কৌস্তব সাতপুরা টাইগার রিজার্ভের স্বাদ জীবনে পেতেন না। তবে তাঁর প্রথম প্রকল্প ছিল তুষার চিতাবাঘ নিয়ে। তুষার চিতাবাঘের কলার ট্র্যাংকিং এবং ক্যামেরা ট্রাপিং-এর থেকে বিভিন্ন তথ্য পেয়েছেন। কৌস্তব কাজ করেছেন স্নো লেপার্ড ট্রাস্টেও। জীবনে চমৎকার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। এশিয়ার আদিম জায়গাগুলোতে তুষার চিতাবাঘ সম্পর্কে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁদের সঙ্গী হয়ে উঠেছেন। এখন কৌস্তবের কাজ গ্লোবাল স্নো লেপার্ড এবং ইকো সিস্টেম সুরক্ষা নিয়ে। তুষার চিতাবাঘ এবং পাহাড়ে তাঁদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন কৌস্তব।
২০০৬ সালে মঙ্গোলিয়ার একটি জারে (এক ধরনের তাঁবু) তোলা ছবিতে দেখা গেছে তুষার চিতাবাঘের চামড়াগুলো আলংকারিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এখন অবশ্য যেকোনও তুষার চিতাবাঘের কোনও অংশ কেনা বা বেচা অবৈধ। সম্প্রতি জলবায়ুর যে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে তার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই চিতাবাঘেরা। পাহাড়ের আঞ্চলিক লোকেরা তাদের গবাদি পশুর চারণভূমির সন্ধানে তুষার চিতাবাঘের বেড়ার কাছে চলে যাচ্ছে। ফলে সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়ছে। তাই এখন নীল ভেড়া ভারতে তুষার চিতাবাঘের খাদ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। স্পিতি এবং লাদাখে তুষার চিতাবাঘের সন্ধানের চেষ্টা চলছে। পাইটিস গ্রামেও সংরক্ষণের এই চেষ্টা চলছে। কৌস্তব এখন কাজ করছেন ১২টি চিতাবাঘের রেঞ্জের দেশগুলিকে একত্রিত করে। তাদের বাস্তুতন্ত্রই এখন সংরক্ষণের শত্রু হয়ে উঠেছে। তাই কৌস্তবের মতো পরিবেশপ্রেমীরা শুধু স্বপ্ন দেখে না, তুষার চিতাবাঘকে বাঁচিয়ে রাখার অঙ্গীকার নেয়।
এঁরা ভারতবর্ষকে শুধু স্বপ্ন দেখান না বরং তাঁদের জীবনই হয়ে ওঠে স্বপ্নের অনুরণন। তরুণ প্রজন্মকে ভাবতে শেখায় কীভাবে আমার দেশ আরও ভালও হবে, কীভাবে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে এসে পরিবেশের স্বার্থই প্রধান হয়ে উঠবে। ভাবতে শেখায় পরিবেশ বাঁচলে ভারত বাঁচবে, ভারত বাঁচলে পৃথিবী বাঁচবে। পৃথিবী বাঁচলে বাঁচবে নতুন প্রজন্ম। স্বপ্নের এই ফেরিওয়ালাদের স্যালুট। কুর্নিশ।