ডার্ক অক্সিজেন

আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান হল বাতাস— আরও নিখুঁতভাবে বললে অক্সিজেন। জীবজগতের প্রায় প্রত্যেকটি প্রাণীর বা জীবের বেঁচে থাকার জন্য কমবেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই ‘ডার্ক অক্সিজেন’ আবার কী? এ কেমন অক্সিজেন? এই নিয়ে আলোচনায় প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

জীব-জগতে অক্সিজেন আসে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার দ্বারা। যারা নাকি পরিবেশের অক্সিজেনের একমাত্র সাপ্লায়ার। কিন্তু এই ‘ডার্ক অক্সিজেন’টা আবার কী ধরনের বস্তু? এ কেমন অক্সিজেন? আর তার চেয়েও বড় কথা অক্সিজেনের কি কোনও বর্ণ হয়? উত্তর হল না। আসলে ডার্ক অক্সিজেন হল আলোর অনুপস্থিতিতে জন্ম নেওয়া অক্সিজেন। যার আলোর প্রয়োজন পড়ে না।

আরও পড়ুন-ডেঙ্গি প্রবণ এলাকায় বিনামূল্যে মশারি দেবে রাজ্য!

ডার্ক অক্সিজেনের জন্ম
ডার্ক অক্সিজেন উৎপাদন (DOP) বলতে এমন এক প্রক্রিয়াকে বোঝায় যার মাধ্যমে আণবিক অক্সিজেন তৈরি হয় এবং যেটি কোনওভাবেই আলোক-নির্ভর সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতির সঙ্গে নিজেকে জড়ায় না। যদিও পৃথিবীর বেশিরভাগ অক্সিজেন উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতির দ্বারা বা সক্রিয় অণুজীব দ্বারা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে উত্পাদিত হয়, তবে এই ডার্ক অক্সিজেন কিন্তু বিভিন্ন অ্যাবায়োটিক এবং বায়োটিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে এবং অন্ধকার, অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে ঘটা অ্যারোবিক বিপাকে সাহায্য করতে পারে।
আগেই বলেছি যে এই ডার্ক অক্সিজেনের উৎপাদন দু-ভাবে ঘটতে পারে। এক, বায়োটিক আর অপরটি হল অ্যাবায়োটিক।
অ্যাবায়োটিক ডার্ক অক্সিজেনের উৎপাদন বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটতে পারে, যেমন—
ওয়াটার রেডিওলাইসিস
এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত অন্ধকার জিওলজিক্যাল ইকোসিস্টেমে সম্পন্ন হতে দেখা যায়, উদাহরণস্বরূপ অ্যাকুইফার-এর নাম করা যেতে পারে। যেখানে পার্শ্ববর্তী শিলায় তেজস্ক্রিয় উপাদানগুলির ক্ষয় জলের অণুগুলিকে ভাঙনের দিকে নিয়ে যায়, যার ফলে অক্সিজেন তৈরি হয়।
সারফেস-বাউন্ড র্যাডিকালের জারণ
কোয়ার্টজের মতো সিলিকন-বহনকারী খনিজগুলিতে, সারফেস-বাউন্ড র্যাডিকালগুলির ক্রমাগত অক্সিডেশন ঘটতে থাকে, যার ফলে অক্সিজেন উৎপাদিত হয়। আবার, সরাসরি অক্সিজেন গঠন ছাড়াও, এই প্রক্রিয়াগুলি প্রায়শই তীব্র বিক্রিয়ক অক্সিজেন (ROS), যেমন— হাইড্রক্সিল র্যাডিকেল (OH), সুপার অক্সাইড (O2-), এবং হাইড্রোজেন পারক্সাইড (H2O2) তৈরি করে। এই ROSগুলিকে অক্সিজেন এবং জলে রূপান্তরিত করা যেতে পারে জৈবিকভাবে, সুপার-অক্সাইড ডিসম্যুটেজ এবং ক্যাটালেসের মতো উৎসেচকের মাধ্যমে, অথবা লৌহঘটিত লোহা এবং অন্যান্য রিডিউসিং ধাতুগুলির সঙ্গে বিক্রিয়ার মাধ্যমে।
অ্যাবায়োটিক-এর মতো বায়োটিক ডার্ক অক্সিজেনের উৎপাদনও বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটতে পারে। এই পদ্ধতিটি অণুজীব দ্বারা স্বতন্ত্র মাইক্রোবিয়াল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে—
ক্লোরাইট বিভাজন
এতে ক্লোরাইট (ClO2-)-কে অক্সিজেন এবং ক্লোরাইড আয়নে বিভক্ত করা হয়।
নাইট্রিক অক্সাইড ডিসমিউটেশন
এর মধ্যে নাইট্রিক অক্সাইড (NO)-কে অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন গ্যাস (N2) বা নাইট্রাস অক্সাইড (N2O)-তে বিয়োজিত করা হয়।

মিথানোব্যাক্টিনের মাধ্যমে জলের লাইসিস বা ভাঙন
মেথানোব্যাকটেরিয়াগুলি অক্সিজেন তৈরি করার উদ্দেশ্যে জলের অণুগুলিকে ভাঙতে থাকে। এই প্রক্রিয়াগুলি পরিবেশে অক্সিজেনের অভাব থাকা সত্ত্বেও অণুজীব সম্প্রদায়কে বায়বীয় বিপাক বজায় রাখতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন-গঙ্গাকে রক্ষা করতেই হবে দূষণ রোধে বার্তা মেয়রের

সাম্প্রতিক অধ্যয়ন থেকে
উঠে আসা তথ্য
নেচার জিওসায়েন্সে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা, প্রশান্ত মহাসাগরের ক্লারিওন-ক্লিপারটন জোন (সিসিজেড) সমুদ্রতলের সমুদ্র পৃষ্ঠের নিচে ৪,০০০ মিটার (প্রায় ১৩,০০০ ফুট) খনিজ জমা থেকে অক্সিজেন নির্গত হওয়ার প্রমাণ দিয়েছে। স্কটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর মেরিন সায়েন্স (SAMS)-এর অধ্যাপক এবং প্রতিষ্ঠানের সিফ্লোর ইকোলজি এবং বায়োজিওকেমিস্ট্রি রিসার্চ গ্রুপের টিম লিড অ্যান্ড্রু সুইটম্যানের গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যায় যে সালোকসংশ্লেষণ থেকে উৎপন্ন অক্সিজেন ছাড়াও অপর একটি অতিরিক্ত অক্সিজেনের উৎস রয়েছে। সাধারণত প্রশান্ত মহাসাগরে ৪.৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার (১.৭ মিলিয়ন বর্গমাইল) বিস্তৃত ক্লারিওন-ক্লিপারটন জোনে (CCZ), পলিমেটালিক নোডুলস নামে কয়লার মতো খনিজ শিলা রয়েছে, যা সাধারণত ম্যাঙ্গানিজ এবং লোহা ধারণ করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে এই নোডুলগুলি সালোকসংশ্লেষণের প্রক্রিয়া ছাড়াই অক্সিজেন তৈরি করে৷ সমুদ্রতলের অন্ধকারে অক্সিজেন তৈরি করে এমন খনিজগুলি সম্ভবত পৃথিবীতে কীভাবে জীবন শুরু হয়েছিল সে-সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারে৷ ডার্ক অক্সিজেনের উত্স খুঁজে পাওয়ার ১০ বছরেরও বেশি সময় পরে ২০১৩ সালে একটা গবেষণা করা হয় যার লক্ষ্য ছিল CCZ সমুদ্রতলের প্রাণীরা কতটা অক্সিজেন গ্রহণ করে তা মাপার। ল্যান্ডার নামক এক যান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম যা সমুদ্রতলের তলদেশে সহজেই যেতে পারে তাকে সমুদ্রের তলদেশে পাঠিয়ে, জলে অক্সিজেনের মাত্রা গভীরতার সঙ্গে কীভাবে কমেছে তা ট্র্যাক করা হয়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি উক্ত যন্ত্রটিকে সমুদ্রের ৪,০০০ মিটার (১৩,০০০ ফুট) নিচে পাঠানো হয়েছিল। যাইহোক, গবেষকেরা যা আবিষ্কার করেছিলেন তা হল সমুদ্রের তলদেশে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়েছে। এটি সুইটম্যান এবং তাঁর দলকে অবাক করেছিল। তখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে গভীর মহাসাগরে উপলব্ধ অক্সিজেন ওপরের মহাসাগর এবং ভূমি থেকে আসে, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে উদ্ভিদ, প্লাঙ্কটন এবং শৈবাল দ্বারাই এই অক্সিজেন উত্পাদিত হয়।

আরও পড়ুন-জমির ফসল কেটে দিল বিএসএফ জওয়ানেরা প্রতিবাদে সরব কৃষকেরা

ফলস্বরূপ, অক্সিজেনের মাত্রা সাধারণত গভীরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। তবে এক্ষেত্রে তা ঘটেনি।
তার পরিমাপের সরঞ্জামগুলি ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করে, সুইটম্যান সরঞ্জামটি পুনরায় ক্যালিব্রেট করেছিলেন এবং বহু বছর ধরে পরীক্ষাটি কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন— একই ফলাফলের সাথে। বছরের পর বছর ধরে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা আবিষ্কার করেন যে, সমুদ্রের তলদেশে ম্যাঙ্গানিজ নডিউলের একটি স্তর রয়েছে যা অক্সিজেন উৎপাদনের উৎস। তাঁরা এই নডিউলগুলিকে পরীক্ষার জন্য জাহাজে ফিরিয়ে এনেছিল এবং লক্ষ্য করেছিলেন যে তাঁদের একটি AA ব্যাটারির সমতুল্য বৈদ্যুতিক চার্জ রয়েছে। এই চার্জের দ্বারাই সমুদ্রের জল তড়িৎ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনে বিয়োজিত হয়ে যায়। এই সত্যতা তাঁরা তাঁদের ল্যাব পরীক্ষায় এটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এই অক্সিজেন আবিষ্কারের প্রেক্ষিতে ওয়েনস বলেছিলেন, ‘সালোকসংশ্লেষণ ব্যতীত পৃথিবীতে অক্সিজেনের আরেকটি উৎস যে আমরা পেয়েছি তার প্রগাঢ় পরিণতি এবং প্রভাব রয়েছে।’ এ ছাড়া গভীর সমুদ্রে অক্সিজেনের উৎস পৃথিবীতে কীভাবে জীবন শুরু হয়েছিল তা পুনর্বিবেচনার দরজা খুলে দেয়|

Latest article