টাইফয়েডকে বলা হয় ‘সাইলেন্ট ক্যারিয়ার’। টাইফয়েডের ব্যাক্টেরিয়া শরীরে ঢুকলেও সংক্রমিত হন না অনেকে। তবে তাঁরা সেই ব্যাক্টেরিয়ার বাহক হন। তাঁদের থেকেই রোগ অন্যদের শরীরে ঢুকতে পারে। যেমন, টাইফয়েডের জীবাণু কারও শরীরে ঢুকেছে আর তিনি যে জল খাচ্ছেন বা যে থালায় খাচ্ছেন, তাতে অন্য কেউ খেলে তা থেকেও রোগ ছড়াতে পারে। সেই ব্যক্তির মলমূত্র জলে মিশে গিয়ে সংক্রমণের কারণ হয়ে উঠতে পারে। রক্তের মাধ্যমেও বাহিত হয় টাইফয়েডের জীবাণু। টাইফয়েড কিন্তু ঋতুপরিবর্তনেরও রোগ। মূলত জলবাহিত রোগ এটা। সালমনেলা টাইফি ও প্যারাটাইফি জীবাণু থেকে টাইফয়েড রোগ ছড়ায়।
বিশেষজ্ঞের মতে টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার দু সপ্তাহ পর এই রোগকে চিহ্নিত করা যায়। এর আগে টাইফয়েড আক্রান্ত কিনা, তা বোঝা জটিল। টাইফয়েডের কারণে জ্বর হলে তা দু-তিন সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।
আরও পড়ুন-সংসদের অধিবেশন শুরু ২৫ নভেম্বর
উপসর্গ
টাইফয়েড জ্বরের একটা নির্দিষ্ট ধরন আছে। জ্বর উত্তরোত্তর বাড়বে। প্রথম দিন জ্বর মাপার পরে তাপমাত্রা যা দেখলেন, পর দিন দেখবেন, তা আর একটু বেড়েছে। ক্রমশ জ্বরের তীব্রতা বাড়তে থাকে। ১০০ ডিগ্রি থেকে জ্বর ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশিও হতে পারে।
জ্বরের পাশাপাশি ঘন ঘন পেটখারাপ, বমি এবং পেটের যন্ত্রণা হতে পারে।
প্রচণ্ড মাথাব্যথা, গলাব্যথা, পেটব্যথা হতে পারে।
অনেক রোগীর ক্ষেত্রে জন্ডিসের লক্ষণও দেখা দেয়। যদি দেখেন, টানা সাত দিনেও জ্বর কমছে না, পেটখারাপের ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছে না, সেই সঙ্গে জন্ডিসের লক্ষণ ফুটে উঠছে, তা হলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
শরীর দুর্বল হয়ে যায়। চামড়ায় লালচে দানা বেরয়।
কেন ছড়ায় টাইফয়েড
টাইফয়েড ছড়ানোর অন্যতম কারণ হল দূষিত খাবার গ্রহণ ও আর একজন টাইফয়েড-আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা। তবে জলের মাধ্যমে টাইফয়েড সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। এই রোগটি এতই জটিল প্রকৃতির যে, এতে আক্রান্ত হলে রক্তক্ষরণ, অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ, মেরুদণ্ডে সংক্রমণ এমনকী কিডনিতেও সমস্যা দেখা দেয়।
টাইফয়েড জ্বর থেকে শারীরিক আরও কিছু জটিলতাও হতে পারে। যেমন মস্তিস্কে প্রদাহ, নিউমোনিয়া, হেপাটাইটিস, লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। টাইফয়েড জ্বর শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করতে পারে।
আরও পড়ুন-মোদীরাজ্যে তৈরির আগেই ভেঙে পড়ল বুলেট ট্রেনের সেতু, সুরক্ষার প্রশ্ন তুলে দেবাংশুর নিশানায় মোদী
পরীক্ষা এবং চিকিৎসা
টাইফয়েড হয়েছে কি না তা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। ‘ওয়াইডাল টেস্ট’ নামে এক ধরনের পরীক্ষা চিকিৎসকেরা করেন। তবে তাতে ধরা পড়তে দেরি হয়। ক্ষেত্র বিশেষে ‘লিভার ফাংশন’ পরীক্ষাও করিয়ে নেওয়া হয়।
স্টুল এবং ইউরিন পরীক্ষার মাধ্যমেও জীবাণু শনাক্ত করা যায়। তবে এক্ষেত্রে তা দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে পজিটিভ হয়। সেজন্য টাইফয়েড হয়েছে কি না জানতে হলে ব্লাড কালচার করে নেওয়াটাই সেফ।
টাইফয়েড প্রতিরোধে প্রয়োজনে ভ্যাকসিন নেওয়া যেতে পারে। ইনজেকশন এবং মুখে খাওয়ার ভ্যাকসিন পাওয়া যায় তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
টাইফয়েড হলে নিজে থেকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া ঠিক নয়। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে রোগ শনাক্ত করে নির্দিষ্ট মাত্রার নির্দিষ্ট ওষুধ খেতে হবে। টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীকে ঠিক অ্যান্টিবায়োটিক দিলে রোগ ভাল হয়ে যায়। রোগীর ব্লাড কালচার দেখে সেই অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার ৫ থেকে ৭ দিন পর জ্বর কমতে শুরু করে। রোগীর অবস্থা বুঝে তবেই অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স করাতে হবে।
সতর্কতা
চিকিৎসকের মতে, রাস্তার খোলা খাবার, কাটা ফল, কাঁচা স্যালাড, শরবত খেলে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া দূষিত জল থেকেও সংক্রমণ ছড়ায়। পানীয় জল থেকেও এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্তের মলমূত্র থেকে টাইফয়েডের ব্যাক্টেরিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। বিশুদ্ধ জল খান। দরকারে জল ফুটিয়ে খান। অবশ্যই হাত ভালভাবে ধুতে হবে। পরিবারে কেউ আক্রান্ত হলে সেই ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র আলাদা করে রাখতে হবে।
খাবার গরম করে খান এবং কাঁচা শাক-সবজি খুব ভাল করে ধুয়ে তারপর রাঁধুন।
পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। তাকে হাওয়া-বাতাস খেলে এমন ঘরে রাখুন।
টাইফয়েড রোগী কী খাবেন
পর্যাপ্ত কার্বোহাইড্রেট-যুক্ত খাবার খাওয়া দরকার। ভাত হজম হয় সহজে। তাই হালকা মশলায় রান্না করা মাছ, চিকেন ও সবজি দিয়ে ভাত খাওয়া ভাল। সুজি, সেমাই, নুডুলস, রুটিও খাওয়া যায়।
তেলমশলা দেওয়া খাবার একেবারেই চলবে না। ডালের পাতলা জল খান। টাইফয়েড হলে এতটাই অরুচি হয়, যে খাওয়ার ইচ্ছা চলে যায়। তাই অল্প অল্প করে বারবার খেতে হবে। প্রাতরাশে আলুসেদ্ধ নুন-গোলমরিচ ও সামান্য মাখন দিয়ে খেতে পারেন।
টাইফয়েড থেকে সদ্য সেরে ওঠার পরেও শরীরে জলের প্রয়োজনিয়তা বেশি থাকে। তাই জলীয় খাবারের পরিমাণ বেশি হলেই ভাল।
পর্যাপ্ত জল আছে, এমন ফল খেতে হবে। তরমুজ, মুসাম্বি, শসা, জামরুল-সহ মরশুমি ফল খান। টাইফয়েড থেকে সেরে উঠতে সুষম ও সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে মাসখানেক।
টাইফয়েডের সময় রুটি খেলে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। আসলে টাইফয়েড হল পাকস্থলী-সংক্রান্ত একটি রোগ, যাতে বেশি পরিমাণে খাবার খাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। যেগুলিতে ফাইবার বেশি থাকে চিকিৎসকেরা সেই জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে বলেন।
টাইফয়েডে ডাবের জল খুব উপকারী। ডাব জলশূন্যতা ও ডায়ারিয়া প্রতিরোধ করে। ডাবের জলে থাকা অ্যামাইনো অ্যাসিড ও ডায়াটারি ফাইবার ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ডাবের জলে যে পরিমাণ পটাশিয়াম আছে, তা টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর দ্রুত চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত উপকারী।